বাঙালি দর্শন কাকে বলে? এর বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।

অথবা, বাঙালি দৰ্শন কী? বাঙালি দর্শনের বৈশিষ্ট্যসমূহ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাঙালা দর্শনের সংজ্ঞা প্রদানপূর্বক এর গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যাবলি আলোচনা কর।
অথবা, বাঙালা দর্শনের কোন কোন বৈশিষ্ট্যগুলোকে তুলে ধরবে? বাঙালি দর্শনের সংজ্ঞা প্রদানপূর্বক লেখ।
উত্তর।৷ ভূমিকা
: ‘দর্শন’ শব্দের উৎপত্তি দৃশ্ ধাতু থেকে। দৃশ্ + অনট = দর্শন। তাই শাব্দিক অর্থে দর্শন বলে কোনো কিছু দেখাকে বুঝায়। কিন্তু দর্শন শাস্ত্রে দর্শন শব্দটিকে বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। আর এ অর্থে দর্শন বলতে তত্ত্বানুসন্ধান দ্বারা জ্ঞান লাভের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাকে বুঝায়। প্রত্যেক জাতিরই নিজস্ব একটি দর্শন রয়েছে, যেমন-গ্রিক দর্শন, ইউরোপীয় দর্শন, ভারতীয় দর্শন ও মুসলিম দর্শন। তেমনি বাঙালি জাতির প্রথিতযশা ব্যক্তিবর্গের বিভিন্ন দার্শনিক সমস্যা সম্পর্কে সুচিন্তিত মতামত নিয়ে যে দর্শন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা বাঙালি দর্শন নামে সুবিদিত।
বাঙালি দর্শন : ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, অন্যান্য প্রাগ্রসর জাতির মত বাঙালির দর্শন চিন্তাও ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে বিভিন্নভাবে বিকশিত হয়েছে। বাঙালির তিন যুগে (প্রাচীন, মধ্য এবং আধুনিক) বাঙালি দর্শন বিভিন্নভাবে বিকশিত হয়ে জগৎ, জীবনের স্বরূপ ও গূঢ়ার্থ আবিষ্কার এবং যথার্থ মানবোচিত জীবনের অনুসন্ধানসহ মানুষকে নিয়ে মানুষের ভাবনা বাঙালির দর্শনচিন্তায় একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যরূপে দেখা দিয়েছে। তাই বলা যায়, বাঙালি দর্শন হলো বাঙালির ধ্যানধারণা, চিন্তা-মনন, ভাবধারা, মতামত, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদির সংমিশ্রণ। বাঙালি দর্শন নিছক দুঃখবাদী কিংবা ভাববিলাসী দর্শন নয়, বাঙালি দর্শন হলো জগৎ ও জীবনের সাথে সম্পর্কিত দর্শন। তাই বলা যায়, বাংলা ও বাংলার সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের বৈচিত্র্যময় রূপ ও রসের মাধুর্যে আপ্লুত হয়ে মরমি চেতনায় উদ্ভূত যে দর্শন জন্মলাভ করেছে, তাকেই বাঙালি দর্শন নামে অভিহিত করা যায়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন দার্শনিক বিভিন্নভাবে বাঙালি দর্শনের সংজ্ঞা দিয়েছেন। নিম্নে তাঁদের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো :
বাঙালি দর্শনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে অধ্যাপক ড. প্রদীপ কুমার রায় বলেছেন, “যে প্রজ্ঞাময় দর্শন বাংলাদেশের আবহমানকালের বিশাল পটভূমিতে প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে এ সময় পর্যন্ত বিবর্তিত হয়েছে তাই বাঙালি দর্শন।”
অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমেদ বাঙালি দর্শন সম্পর্কে বলেছেন, “বাঙালি দর্শন মুক্তি বা মোক্ষলাভকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ।”
অধ্যাপক সাইদুর রহমান বাঙালি দর্শন সম্পর্কে বলেছেন, “বাঙালি দর্শন কেবল সমদর্শন নয়, খালি পরলোকচর্চা নয়, তত্ত্ববিদ্যার নিছক রোমন্থন ও কসরত নয়, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের যে কোনো সার্থক দর্শনের ন্যায় বাঙালি দর্শনও জীবনদর্শন, উন্নত মানবজীবন প্রণয়ন ও যাপনের উপায়ানুসন্ধান।”
সুতরাং উপরের আলোচনা হতে বলা যায় যে, বাঙালি দর্শন হলো বাঙালির শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিন্তাচেতনা, মনন ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচিত জীবনদর্শন।
বাঙালি দর্শনের বৈশিষ্ট্য : বাঙালি দর্শন পর্যালোচনা করলে এর কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে এ বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো:
১. পৌরাণিক উপকথা ও ধর্ম : পৌরাণিক উপকথা হলো এক ধরনের মতবাদ। এ পৌরাণিক উপকথা ও প্রচলিত ধর্মবিষয়ক আলোচনা বাঙালি দর্শনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
২. ব্রহ্মতত্ত্ব : ব্রহ্মতত্ত্ব হলো জগৎ সৃষ্টি বিষয়ক আলোচনা। বাঙালি দর্শনের একটি উল্লেখযোগ্য আলোচ্যবিষয় হলো ব্রহ্মতত্ত্ব।
৩. উপনিষদ : উপনিষদ হলো জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনা। উপনিষদকে বেদান্ত বলা হয়। উপনিষদে জ্ঞানবিষয়ক দার্শনিক তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ স্থান পেয়েছে। বাঙালি দর্শনে এর প্রভাব রয়েছে।
৪. উদারনীতি : উদারনীতি বাঙালি দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। বাঙালি দর্শনচিন্তায় উদারনীতি প্রভাব বিস্তার করেছে।
৫. দ্বিকোটিক চিন্তা : এটা অনেকটা পৌরাণিক বিষয়। কোনো বিষয় সম্পর্কে আমাদের চিন্তার অস্পষ্ট সিদ্ধান্ত দানে সঠিক উত্তরটি বেছে নেওয়ার অপারগতাই এর উৎস I
৬. প্রাক বৈদিক চিন্তাধারা : বাঙালি দর্শনের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি প্রাচীন চিন্তাধারাকে পরিত্যাগ করে না।এটাতে সভ্যতার আদিলগ্নের বহু ধ্যানধারণা ও সংস্কারের সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়।
৭. বেদ বিরোধী চিন্তাধারা : ভারতীয় দর্শন মূলত বেদকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে, কিন্তু বেদের ব্যাখ্যাকে বাঙালি দার্শনিকরা নির্দ্বিধায় মেনে না নিয়ে নিজস্ব স্বকীয়তা ও সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে জগৎ ও জীবনের ব্যাখ্যা প্রদান করেছিলেন।
৮. দেশজ উপকরণ : বাঙালি দর্শনের একান্ত দেশজ উপকরণের মধ্যে রয়েছে লোকায়ত দর্শন, বৈষ্ণব দর্শন ইত্যাদি। আবহমান বাংলার বস্তুবাদী চিন্তাধারাই এ লোকায়ত দর্শন।
৯. চৈতন্য দেবের প্রভাব : বাংলায় চৈতন্য আন্দোলন এ দেশের দর্শনের একটি বড় উপাদান। নবম শতাব্দী থেকেই রাধাকৃষ্ণের ভক্তিবাদী দর্শন প্রচলিত ছিল। চৈতন্য দেবের যুগে এ ভক্তিবাদই প্রেমবাদে পরিণতি লাভ করে।
১০. রেনেসাঁ যুগের প্রভাব : উনিশ শতকের রেনেসাঁ যুগ থেকে বাঙালি দর্শনে পাশ্চাত্য জীবন চেতনা ও দার্শনিক ধ্যানধারণার জন্য মুক্তবুদ্ধির জাগরণ ঘটে। বাঙালি দর্শনেও এ নতুন প্রবাহ নবদিগন্তের উন্মোচন করে।
১১. বাউল ও মরমি চিন্তাধারা : ? তন্য উত্তর যুগে সপ্তদশ শতাব্দীতে বাউল দর্শনের ধারাস্রোত শুরু হয়। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ছিল বাঙালি দর্শনের মূল ধার৷৷ এ দর্শন আসলে ধর্মীয় দর্শন।আরও সহজ কথায় বলা যায়, একান্তই বাংলার মরমি চিন্তাধারা।
১২. সুফি ও ইসলামি চিন্তাধারা : বাঙালি দর্শনে প্রাচীন ও মধ্যযুগে ইরানের সুফি দর্শন ও মুসলিম দর্শন বিশেষ প্রভাব সৃষ্টি করে। এ সময় সুফিবাদ বাংলায় প্রবেশ করে। সুফিবাদের উন্মেষ ঘটে নবম ও দশম শতাব্দীতে এবং চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত এ ইসলামি দর্শন বাংলায় জোরালোভাবে অবস্থান করে।
১৩. পাশ্চাত্যের প্রভাব : বাঙালি দর্শনের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো পাশ্চাত্যের প্রভাব। পাশ্চাত্য দেশের বিভিন্ন দার্শনিক ভারতবর্ষ তথা বাংলাদেশের সাথে যোগাযোগ করেন এবং বাঙালি থেকে জ্ঞানবিজ্ঞানের বহু পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে তাঁরা তাঁদের জ্ঞানের প্রসার ঘটান। তাই পরবর্তীকালে বাঙালি দার্শনিকদের মধ্যে পাশ্চাত্যের প্রভাব পড়ে।
১৪. নৈতিক বিশ্বাস : ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য নৈতিক দর্শন বিশেষ করে উপযোগবাদ বাঙালি দর্শনে প্রবেশ করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, স্বাধীনতা উত্তরকালে বাঙালিদের দর্শনচর্চা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের বাঙালি দর্শনের মধ্যে যেমন লালন দর্শন বহুব্যস্ত হয়ে আছে, আবার বিরাট রবীন্দ্র দর্শনসহ অগণিত লোককবিদের মরমি দর্শন এবং অতি আধুনিককালের ড. গোবিন্দচন্দ্র দেবের দর্শনও বহুল আলোচিত বিষয়। তাই সবশেষে বলা যায়, বাঙালি দর্শনে যেমন বহিরাগত চিন্তাধারার প্রবেশ লক্ষণীয়, তেমনি এটা নিজস্ব উপকরণেও সমৃদ্ধ।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a5%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6-%e0%a6%a6/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*