বাঙালি দর্শনে রামায়ণের প্রভাব আলোচনা কর।

অথবা, বাঙালি দর্শন চিন্তায় রামায়ণের প্রভাব বা অবদান বর্ণনা কর।
অথবা, বাঙালি দর্শনতত্ত্বে রামায়ণের প্রভাব আলোচনা কর।
অথবা, বাঙালি দর্শন সৃষ্টিতে রামায়ণের ভূমিকা বর্ণনা কর।
অথবা, তুমি কি মনে কর বাঙালি দর্শনে রামায়ণের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়- আলোচনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায় যে, অন্যান্য অনেক অগ্রসরমান জাতির মত বাঙালির দর্শন চিন্তাও ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে বিভিন্নভাবে বিকশিত হয়েছে। বাঙালি দর্শন প্রাচীন, মধ্য, আধুনিক— এ তিন যুগে বিভক্ত। এ তিন যুগে বাঙালি দর্শনচিন্তা বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে। জগৎ ও জীবনের স্বরূপ ও গূঢ়ার্থ আবিষ্কার এবং যথার্থ মানবোচিত জীবনের অনুসন্ধানসহ মানুষকে নিয়ে মানুষের ভাবনা বাঙালির দর্শনচিস্তায় একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যরূপে দেখা দিয়েছে সকল যুগে।
বাঙালি দর্শনে রামায়ণের প্রভাব : নিয়ে বাঙালি দর্শনে রামায়ণের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. রামায়ণের সারবস্তু : রামায়ণে অনেক অলৌকিক, অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা, অবস্থা ও অতীন্দ্রিয় উপমার মাধ্যমে মানব পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিন্তু অভেদ্য প্রাকৃতিক বিধান ও শৃঙ্খলাকে রামায়ণে অস্বীকার করা হয় নি। যেমন- জগতের প্রতিটি প্রাণী, প্রতিটি বস্তুকে বৃদ্ধ বয়স, মৃত্যুকাল বা দেবতার বিধানের সম্মুখীন হতে হয়। পশুদের মধ্যে তিনটি দ্বন্দ্ব নির্বিকারে ও অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। মানুষকে এভাবে তাদের বিষয়ে আবির্ভূত হলে চলবে না, কারণ এগুলো
অবশ্যম্ভাবী। পৃথিবী, বায়ু, আকাশ, জল ও আলোক প্রভৃতির নিজস্ব ধর্ম অনুযায়ী তাদের চিরন্তন ধারায় হয়ে থাকে। এসব নীতি বাক্য থেকে আমরা তৎকালীন মানব ভাবনা ও দার্শনিক চিন্তার একটি প্রবল ফল্গুধারা লক্ষ্য করি।
২. মানুষকে আশাবাদী করা : রামায়ণ নৈরাশ্যবাদী মানুষের মনে আশার সঞ্চার করে। রামায়ণের মতে, নৈরাশ্যবাদ মানুষের জীবনের কর্মশক্তিকে ধ্বংস করে দেয়। তাই নৈরাশ্যবাদ মানবজীবনের আদর্শ হতে পারে না। আশাবাদ মানুষকে শান্ত, সৌম্য ও সমাহিত হতে শিক্ষা দেয়। এ আশাবাদ মানুষকে সুখ ও দুঃখের প্রতি অনাসক্ত হতে শিক্ষা দেয়। উপনিষদের জন্ম মৃত্যুর চক্র থেকে অব্যাহতি পাওয়াকে মোক্ষরূপে গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু রামায়ণে পরম পুরুষার্থরূপে
মোক্ষকে স্বীকার করা হয় নি। রামায়ণের নিম্নোক্ত নীতিবাক্যগুলো মানুষকে আশাবাদী হতে শিক্ষা দেয় :
ক. কোনো প্রাণীই দুঃখ, বিপদ থেকে মুক্ত নয়।
খ. অবিচ্ছিন্ন সুখ সহজলভ্য নয়।
গ. জীবিত থাকলে যে কোনো ব্যক্তির জীবনে শতবছর পরে হলেও সুখ আসে।
ঘ. হৃদয়হীন পাপিষ্ঠ ব্যক্তি ত্রিলোকের অধীশ্বর হতে পারে, কিন্তু সে চিরকাল বাঁচতে পারে না।
ঙ. ধ্বংসেই সকল বস্তুর পরিণতি।
চ. প্ৰকৃত সুখ একমাত্র ধর্মের মাধ্যমেই লাভ করা যায়।
৩. মানবজীবনের ত্রিবিধ লক্ষ্য : রামায়ণে মানবজীবনের ত্রিবিধ লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে ধর্ম, অর্থ, কাম। ধর্ম দ্বারা বুঝানো হয়েছে আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ, অর্থ দ্বারা ধনসম্পত্তি এবং কাম দ্বারা বুঝানো হয়েছে কামনা চরিতার্থ করা। এগুলোর মধ্যে ধর্মই মানবজীবনের পরম আদর্শ, বাকি দু’টি ধর্মের অংশমাত্র। অতিরিক্ত ধনাসক্ত ব্যক্তি যেমন এ জগতে ঘৃণার পাত্ররূপে স্বীকৃত, তেমনি অতিরিক্ত মাদকাসক্তি মানুষকে দুঃখের সাগরে পতিত করে। তাই রামায়ণে এ ত্রিবিধ উদ্দেশ্যের মধ্যে যথাযথ সমন্বয় ঘটানোর কথা বলা হয়েছে।
৪. ধর্মের ব্যবহার : রামায়ণে ধর্ম শব্দটি কখনো কারণ অর্থে কখনো লক্ষ্য অর্থে, ব্যবহৃত হয়েছে। শাস্ত্রানুমোদিত বিধান এবং সমাজ ও নীতি সম্বন্ধীয় যে কোনো ধরনের কর্তব্য কর্মকে রামায়ণে ধর্ম বলে অভিহিত করা হয়েছে। ভারতীয় দর্শন ও সংস্কৃতিতে ধর্ম শব্দটি এক বিশেষ অর্থের মর্যাদা পেয়ে আসছে। ধর্ম শব্দের মূলে আছে ‘ধূ’ যার অর্থ ধারণ করা। এ অর্থে ধর্ম বলতে বুঝায় ‘সহায়ক’ বা কোনো ‘অবলম্বন’ কিংবা কোনো বিধি বা অনুশাসনকে। বর্তমানে ধর্ম বলতে বুঝায় কোন বস্তুর অন্তর্নিহিত স্বভাব বা কোনো প্রচলিত রীতি, কিংবা কোনো ধর্মীয় অনুশাসন বা কর্তব্যকে। সুতরাং বলা যায়, যা পৃথিবীকে ধারণ করে আছে তাই ধর্ম।
৫. ধর্মের কল্যাণ : ধর্ম থেকেই বৈষয়িক সুযোগ সুবিধা বা সুখ উদ্ভব হয়, ধর্মের কল্যাণেই মানুষ প্রার্থিত বিষয় লাভ করতে পারে। তাই ধর্মই জগতে নির্ধারণ শক্তিরূপে প্রণম্য। যিনি ধর্মকে রক্ষা করেন ধর্মও তাঁকে রক্ষা করে। ত্রিবর্গের মধ্যে ধর্মই মানুষের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। ধর্মের সার্থক চর্চা মানুষকে মহৎ করে তুলে।
৬. নৈতিকতার উপর গুরুত্বারোপ : রামায়ণে নৈতিকতাকে ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গরূপে বিবেচনা করা হয়েছে। বস্তুত মানুষের স্বরূপ, লক্ষ্য ও পরিণতি জগতে তার কর্তব্য, অকর্তব্য প্রভৃতির ব্যাখ্যায়। রামায়ণ নৈতিকতার উপর এত বেশি গুরুত্বারোপ করেছে যে, অনেকে রামায়ণকে একটি ‘কাব্যে রূপান্তরিত নীতি-জিজ্ঞাসা’ বলেও আখ্যায়িত করেছেন।
৭. মানবতার প্রতি গুরুত্বারোপ : সকল জীবের দয়া, আত্মসংযম, ধৈর্য, অপরের ত্রুটি সম্বন্ধে সহনশীলতা,আতিথেয়তা, আশ্রয় প্রার্থী শত্রুকেও আশ্রয় দান, চিন্তা, মন ও কর্মের বিশুদ্ধতা প্রভৃতি মানবিক গুণাবলি অর্জন করার জন্য প্রত্যেক মানুষকে উৎসাহিত করা হয়েছে। রামচন্দ্রের বনবাস গমনের মাধ্যমে আমরা সত্যবাদিতার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারি। পিতৃসত্য পালন করার জন্য তিনি রাজসিংহাসন ত্যাগ করে বনবাসী জীবন বরণ করে নিয়েছেন। শ্রীরামচন্দ্র সর্বদাই বলেছেন, সত্য অপেক্ষা আর শ্রেষ্ঠ কোনো আদর্শ নেই ।
৮. জ্যেষ্ঠ এবং কনিষ্ঠদের প্রতি কর্তব্য : পিতামাতা, আচার্য, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, পতি ও প্রভুর প্রতি ভক্তি এবং কনিষ্ঠদের প্রতি স্নেহশীল হয়ে জীবন পরিচালনার জন্যও মানুষের প্রতি রামায়ণ উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে। মানুষ হিসেবে পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন প্রভৃতির প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে রামায়ণে উল্লেখ আছে।
৯. নারীর মর্যাদা : নারীর মর্যাদার প্রতি রামায়ণে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। রামায়ণ মতে, এক দ্বার গ্রহণ এবং সতীত্ব নারী জাতির শ্রেষ্ঠ গুণের অন্যতম। কৈশোরে, যৌবনে এবং বার্ধক্যে নারী জাতি যেন পুরুষ কর্তৃক উপযুক্ত সম্মান পায় সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। স্ত্রীকে স্বামীর অর্ধাঙ্গিনী এবং ধর্ম জীবনে স্ত্রীকে স্বামীর সহধর্মিণীরূপে অভিহিত করা হয়েছে। রামায়ণে বলা হয়েছে, স্ত্রী সর্বদাই স্বামীর আদর ভালোবাসা পাওয়ার অধিকারী।
১০. নৈতিক ন্যায় অন্যায় নির্ধারণ : রামায়ণে মানুষকে নৈতিক ন্যায় অন্যায় নির্ধারণের সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলো
বিবেচনা করার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে :
ক. পারলৌকিক কল্যাণ,
খ. শিষ্ট লোকের অনুমোদন,
গ. অন্য লোকের নীতির উপর প্রভাব এবং
ঘ. নিজের সদাসদ বিবেকবুদ্ধি ও আত্মসম্মান।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা হতে বলা যায় যে, রামায়ণ মানুষকে নিরাশাবাদী হতে আশাবাদী করেছে,মানুষের জীবনের লক্ষ্য ধর্ম, অর্থ ও কাম এ তিনটিকে ঘোষণা করেছে এবং মানুষের জীবনের নৈতিকতার বিভিন্ন দিক সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। রামায়ণ হতে বাঙালি দর্শন এসব বহু বিষয় গ্রহণ করে সমৃদ্ধ হয়েছে। তাই বাঙালি দর্শনে রামায়ণের প্রভাব অপরিসীম।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a5%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6-%e0%a6%a6/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*