বাঙালি দর্শনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমূহ আলোচনা কর। এগুলো খণ্ডন করা যায় কী?

অথবা, বাঙালি দর্শনের বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ রয়েছে? অভিযোগগুলোর সত্যতা বা মিথ্যাত্ব প্রমাণ কর।
অথবা, বাঙালি দর্শনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো আলোচনা ও খণ্ডন কর।
অথবা, বাঙালি দর্শনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ আলোচনা কর। এ অভিযোগগুলো কি খণ্ডন করা যায়?
উত্তর৷। ভূমিকা :
বাঙালির দর্শনচিন্তার ইতিহাস সুপ্রাচীন। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি বিজাতি ও বিদেশি শাসন কর্তৃক শাসিত হলেও নিজস্ব মননসাধনার ব্যাপারে সে সব সময়ই ছিল স্বতন্ত্র।বাঙালি দর্শনে বিভিন্ন জাতির চিন্তাধারার প্রভাব লক্ষ করা যায়। এসব চিন্তাধারার সাথে সমন্বয় ঘটিয়ে বাঙালি নিজস্ব দর্শন রচনা করেছেন। কিন্তু বাঙালি দর্শন সম্পর্কে অনেক সমালোচনা ও অভিযোগ রয়েছে। অনেকে মনে করেন বাঙালির নিজস্ব কোনো দর্শন নেই। দর্শন চর্চার জন্য প্রয়োজনীয় গুণাবলি বাঙালি চরিত মানসে নেই বলে সমালোচকদের দাবি।
বাঙালি দর্শনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমূহ: সমালোচকরা সার্বিকভাবে বাঙালির দর্শনচিন্তা সম্পর্কে আলোচনা পর্যালোচনা করে বাঙালির কোনো দর্শন নেই বলে মত দেন। তাদের অভিযোগসমূহ নিম্নরূপ :
১. লিখিত দর্শনের অপ্রতুলতা বা অভাব : বাঙালি দর্শনচিন্তার প্রমাণস্বরূপ বাংলা ভাষায় লিখিত কোন প্রাচীন দার্শনিক গ্রন্থ নেই। যেমন আছে জার্মান, ফরাসি, ইংরেজ ও গ্রিকদের। তাই বাঙালির দর্শনকে যথার্থ দর্শন বলা যায় না বলে সমালোচকরা মনে করেন।
২. দার্শনিক চিন্তার পরিসীমা সীমিত : প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাঙালি দর্শন বলতে যা কিছু বুঝায় তা মূলত মোক্ষ বা মুক্তি লাভকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এ মোক্ষ নির্বাণ, কৈবল্য বা মুক্তি লাভকে ভিত্তি করেই সকল দার্শনিক চিন্তার উদ্ভব,বিকাশ ও পরিণতি ঘটেছে। তাই বাঙালি দর্শনকে সীমিত দর্শন বলে সমালোচকরা অভিহিত করেন। তাদের মতে বাঙালি দর্শন হলো অপরিপুষ্ট দর্শন।
৩. বাঙালির দর্শন সমাজ ও জীবন বিচ্ছিন্ন দর্শন : সমালোচকরা অভিযোগ করেন বাঙালির ধর্মের ইতিহাস, সাহিত্য শিল্পকলা প্রভৃতি রয়েছে কিন্তু তা সমাজ ও জীবন বিচ্ছিন্ন দর্শন। আর তাই বাঙালির দর্শনকে প্রকৃত দর্শন বলা যায় না।
৪. জাতিগত বৈশিষ্ট্য : জাতিগত অথবা জলবায়ুগত যে কারণেই হোক না কেন বাঙালি চরিত্রে আবেগপ্রবণতা, কর্মকুণ্ঠতা, জীবনবিমুখতা, পরলোকমুখিতা প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যের প্রাধান্য রয়েছে। দর্শন চর্চার জন্য এগুলো অনেক সময় প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। কারণ দর্শন চর্চায় মানসিক দৃঢ়তা, যুক্তিনিষ্ঠা প্রভৃতি প্রয়োজন। তাই বাঙালির পক্ষে যথার্থ অর্থে দর্শন চর্চা করা সম্ভব নয় বলে সমালোচকরা মনে করেন।
অভিযোগ খণ্ডন : বাঙালি দর্শন সম্পর্কে যেসব প্রশ্ন ও আপত্তি উত্থাপন করা হয়েছে তা যথার্থ নয়। বাঙালি দার্শনিক ও পণ্ডিতগণ সমালোচকদের বক্তব্যকে নিম্নোক্তভাবে খণ্ডন করেছেন :
১. লিখিত দর্শন : বাঙালি দর্শনের উপর প্রাচীনকালে অসংখ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে। ন্যায়কন্দলী, অদ্বয়সিদ্ধি, তত্ত্ববোধ,তত্ত্বসংবাদিনী প্রভৃতি দার্শনিক গ্রন্থে বাঙালির দর্শন চর্চার প্রমাণ মেলে। এছাড়া কাব্য সাহিত্যও বাঙালি দর্শন চর্চার পরিচয় বহন করে। মধ্য ও আধুনিক যুগেও অসংখ্য দার্শনিক গ্রন্থ রচিত হয়েছে এবং বর্তমান সময়ে তা সমৃদ্ধ দার্শনিক ভাণ্ডারে পরিণত হয়েছে। তবে বাংলা ভাষার বিকাশের প্রাথমিক স্তরে সংস্কৃত ভাষায় দর্শন চর্চা করতেন বাঙালি দার্শনিক ও পণ্ডিতগণ। কারণ সংস্কৃত ভাষা ছিল তখনকার সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষা। তাই বলে বাঙালি দর্শনকে যথার্থ দর্শন বলা যায় না এমন বক্তব্য গ্রহণ করা যায় না।
২. বাঙালির দার্শনিক চিন্তার পরিসীমা : সমালোচনাকারীরা বাঙালি দর্শনকে মোক্ষ বা মুক্তি কেন্দ্রিক বলে মনে করেন এবং নির্দিষ্ট পরিসীমায় এর অবস্থান বলে ঘোষণা দেন। কিন্তু তাদের এ অভিযোগ ঠিক নয়। কারণ বাঙালি দর্শনে বস্তুবাদী ও ভাববাদী দুটি ধারা রয়েছে। বস্তুবাদী অনেক দার্শনিক সম্প্রদায় মোক্ষের ধারণার পরিবর্তে জাগতিক ধ্যানধারণার কথা প্রচার করেন। তাছাড়া দর্শনের প্রতিটি শাখা বাঙালি দার্শনিকরা তাদের চিন্তাভাবনার অন্তর্ভুক্ত হিসেবে বিবেচনা করেছেন। বাঙালি দর্শনে বস্তুবাদ, ভাববাদ, মানবতাবাদ, উপযোগবাদসহ দর্শনের সকল মতবাদই কমবেশি লক্ষ করা যায়। তাই বাঙালি দার্শনিক চিন্তার পরিসীমা সীমাবদ্ধ এরূপ অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়।
৩. সমাজ ও জীবন বিচ্ছিন্নতা : এ প্রসঙ্গে বলা যায়, বাঙালি দর্শন সম্পূর্ণভাবে সমাজ ও জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। বাঙালির জীবনবাদিতার পরিচয় প্রাচীনকাল থেকেই পাওয়া যায়। প্রাচীন অনার্য বাঙালি সমাজে পারলৌকিক জীবনবিমুখ বস্তুবাদী চার্বাক বা লোকায়তরা পার্থিব দর্শন বা জীবনবাদী দর্শন প্রচার করে। তারা ভোগ বিলাসের উপর গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজন হলে ঋণ করে হলেও ঘি খাওয়ার কথা বলতো। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি জাতি সমাজে বসবাস করতো, সমাজে বর্ণভেদ ছিল যা ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিকভাবে প্রমাণিত। তাই কোনক্রমেই বাঙালি জাতির দর্শনকে সমাজ ও জীবন বিচ্ছিন্ন বলা যায় না। সমাজ ও জীবনকে কেন্দ্র করেই বাঙালির চিন্তাভাবনা আবর্তিত হয়েছে।
৪. জাতিগত বৈশিষ্ট্য : সমালোচকরা বাঙালি জাতিকে আবেগপ্রবণ, কল্পনাশ্রয়ী, ভক্তিবাদী প্রভৃতি বলে অভিহিত করেন এবং এদের পক্ষে যথার্থ দর্শন রচনা সম্ভব নয় বলে মত দেন। কিন্তু বাঙালি জাতির মধ্যে দর্শন চর্চার সকল গুণাবলিই প্রাচীনকাল থেকে ছিল। বাঙালির চরিত্র মানসে একদিকে রয়েছে হৃদয়বৃত্তি, ভাবাবেগ, তেমনি রয়েছে প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি, পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর দক্ষতা, মননশীলতা, ধৈর্য, যুক্তিবাদিতা প্রভৃতি গুণাবলি। প্রাচীন বাঙালি দর্শন থেকে বর্তমান বাঙালি দর্শন পর্যন্ত অসংখ্য দার্শনিক যুক্তি বা ন্যায়শাস্ত্র রচনা করেছেন। ষোলো শতকের দিকে নবদ্বীপে ন্যায়শাস্ত্রের ব্যাপক চর্চা হয়।
৫. বিশ্লেষণী দর্শন চর্চা : সমালোচকরা অভিযোগ করেন বাঙালি দর্শন বিশ্লেষণধর্মী নয়। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে প্রাচীন দর্শন শাস্ত্র চর্চা থেকে আমরা জানতে পারি বাঙালি দার্শনিকদের মধ্যে পক্ষে বিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের রীতি প্রচলিত ছিল। বেদের প্রামাণ্য অবিশ্বাস থেকে আস্তিক্যবাদী ও নাস্তিক্যবাদী দর্শনের সূচনা হয়। ষড়দর্শনকে কেন্দ্র করে বাঙালি দার্শনিকরা যেসব দার্শনিক আলোচনা করেছেন বা টীকাভাষ্য রচনা করেছেন তা বিচার-বিশ্লেষণ বিযুক্ত নয়। বাঙালি দর্শন মূলত যুক্তি ও বিচার বিশ্লেষণ নির্ভর। নব্য ন্যায় দর্শনে যুক্তি ও বিশ্লেষণ ছিল প্রধান বৈশিষ্ট্য।
৬. বিভিন্ন দর্শনের প্রভাব : বাঙালি দর্শনের উপর মার্কসবাদ, অস্তিত্ববাদ, প্রয়োগবাদ, যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদ, বিশ্লেষণী দর্শন, অধ্যাত্মবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদের সুস্পষ্ট প্রভাব রয়েছে। তাই আমরা বাঙালি দর্শনকে অযথার্থ দর্শন বলতে পারি না। কারণ প্রতিষ্ঠিত দার্শনিক তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত চিন্তন প্রক্রিয়া অনুরূপ দর্শন চর্চারই সাক্ষ্য বহন করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি,বাঙালি দর্শনের বিরুদ্ধে সমালোচকরা যেসব যুক্তি দিয়েছেন তা যথার্থ নয়। এসব যুক্তি ভুল তথ্যের উপর নির্ভর করে প্রদান করা হয়েছে। বাঙালির দর্শন বিভিন্ন দর্শনের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। পাশ্চাত্যের মতো সমৃদ্ধ দর্শন না হলে বাঙালির নিজস্ব দর্শন রয়েছে এ সম্পর্কে কোনো বিতর্ক নেই। তবে বাঙালি দর্শনকে নিয়ে সমালোচকদের সব অভিযোগ একেবারে অমূলক নয়। তথ্যের অপ্রতুলতা, দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতির কারণেই বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। তবে বাঙালির দার্শনিক ঐতিহ্য পর্যালোচনা করে বাঙালি দর্শনকে যথার্থ দর্শন বলা যেতে পারে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a5%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6-%e0%a6%a6/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*