বাউল মতবাদের জ্ঞানতাত্ত্বিক দিক ব্যাখ্যা কর।

অথবা, বাউল দর্শনের জ্ঞানতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নিরূপণ কর।
অথবা, বাউলদের জ্ঞানতাত্ত্বিক দর্শন তুলে ধর।
অথবা, বাউলবাদের জ্ঞানতাত্ত্বিক চিন্তাভাবনা তুলে ধর।
অথবা, বাউল দর্শনের জ্ঞানতাত্ত্বিক চিন্তা-ভাবনা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
মধ্যযুগের বাঙালির ধর্ম, দর্শন ও মননশীল চিন্তার ইতিহাসে যে মতবাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি সর্বাপেক্ষা অধিক তা হচ্ছে বাউলবাদ। কেননা বাউলবাদ বাঙালিধর্মী একান্তই বাঙালির নিজস্ব চিন্তার ফসল। তৎকালীন বাংলার বর্ণবিভক্ত সমাজের নিম্নবর্ণের অতি সাধারণ মানুষের জগজ্জীবন ভাবনার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছিল বাউলবাদে । বাউল দর্শনে সচেতনভাবে কোনো জ্ঞানতত্ত্ব বর্ণিত হয়েছে কিংবা প্রকৃত অর্থে জ্ঞানতত্ত্ব বলতে আমরা যা বুঝি এমন কোনো তত্ত্ব বাউলরা নির্মাণ করেছিলেন তা বলা চলে না। জগজ্জীবন সম্পর্কে জানতে গিয়ে বা জ্ঞান আহরণ করতে গিয়ে বাউলরা যে পদ্ধতিতে অগ্রসর হয়েছিলেন তা থেকেই বাউলবাদের জ্ঞানতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের দিকটি আমাদের সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে।
বাউলবাদের জ্ঞানতাত্ত্বিক দিক/ বৈশিষ্ট্য : দর্শনের আলোচনার যে অধ্যায়ে জ্ঞানের উৎপত্তি, স্বরূপ,প্রকৃতি, সীমা, বৈধতা, শর্ত ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয় তাই জ্ঞানতত্ত্ব নামে পরিচিত। সাধারণভাবে জ্ঞান বলতে আমরা বুঝি কোনকিছু সম্পর্কে জানা বা অবহিত হওয়াকে। কিন্তু এই জ্ঞানের উৎস কী? এ প্রশ্নের উত্তরে জ্ঞানবিদ্যায় জ্ঞানের যেসব উৎসকে স্বীকার করা হয় তন্মধ্যে মরমি অনুভূতি বা স্বজ্ঞা অন্যতম। কোনো প্রকার বিচারবুদ্ধি ছাড়া সরাসরি কোনো বস্তুকে প্রত্যক্ষ বা উপলব্ধি করার নাম স্বজ্ঞা বা মরমি অনুভূতি। আরো বিশেষ অর্থে মরমি অনুভূতি বা স্বজ্ঞা নির্দেশ করে জ্ঞেয় বস্তুর এমন এক চেতনা বা গভীর অভিজ্ঞতাকে যেখানে জ্ঞাতা অতিক্রম করে যায় অভিজ্ঞতার চলমান জগতের সব বহুত্ব ও বিরোধকে এবং একাত্মবোধ করে জীবন, জগৎ ও পরমসত্তার সাথে বাউল দর্শনের জ্ঞানতাত্ত্বিক দিকটি অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, এ মতবাদে মরমিবাদের অতি উৎকৃষ্ট বিকাশ ঘটেছে। মরমিবাদী দার্শনিকদের মতো বাউলরাও মনে করেন যে, বুদ্ধির বিচার বিশ্লেষণেও সমন্বয়ের সাহায্যে আমরা পরমসত্তাকে জানতে পারি না বা পরমসত্তার জ্ঞানলাভ করতে পারি না। সত্যিকারের তত্ত্বজ্ঞান গভীর অনুধ্যানের মধ্য দিয়ে মানবমনের মরমিশক্তির মাধ্যমেই লাভ করা যায়। শাস্ত্র ও তত্ত্বের প্রতি অনাস্থা এবং যুক্তিতর্কের অগ্রাহ্যতার মধ্য দিয়েই বাউলদের মরমি আদর্শের দিকটি আমাদের সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। বাউলদের মতে, পরমাত্মা, মনের মানুষ বা সাঁইকে জানার একমাত্র উপায় হচ্ছে মন দিয়ে উপলব্ধি করা এবং দেহ ও মনের সম্মিলনে চরম অবস্থায় উন্নীত হলেই কেবল এরূপ উপলব্ধির সন্ধান পাওয়া যায়।এ উপলব্ধির জন্যই বাউলরা দেহ ও মনের সংযোগে তন্ময় হয়ে পরম তত্ত্বের সাধনা করে। এ সাধনার মাধ্যমেই তাঁরা দেহের মধ্যে পরমাত্মা বা পরম তত্ত্বের অনুসন্ধান করেন, উপলব্ধি করতে সচেষ্ট হন। পরমসত্তার সাক্ষাৎ উপলব্ধিকেই তাঁদের জীবনের, একমাত্র ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। বাইরের জগতের আকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ যখন চরমতত্ত্বের ভাবনায় তন্ময় হয়ে পড়ে। তখনই তার মনের মরমি শক্তি জেগে উঠে আর বিশ্বের চরমতত্ত্বের সাথে ঘটে তার সাক্ষাৎ সুনিবিড় সংযোগ। সাধারণ মানুষের এ মনোবৃত্তি একটি দুর্বিজ্ঞেয় রহস্য বা মিস্ট্রি। কিন্তু পরম তত্ত্বের সাধকের কাছে এই অনুভূতিই জ্ঞানের একমাত্র উৎস। বাউলরা এ মরমি শক্তিকেই পরম তত্ত্বকে জানার উপলব্ধি করার, জ্ঞানলাভের একমাত্র বাহন হিসেবে গ্রহণ করে। তাই মরমিবাদই বাউল দর্শনের জ্ঞানতাত্ত্বিক দিক হিসেবে গণ্য।
উপসংহার : অতএব, স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে, জ্ঞানতাত্ত্বিক দিক থেকে বাউলবাদ মরমিবাদী বৈশিষ্ট্যকেই ধারণ করে। বাউলরা মরমিশক্তি বা অনুভূতি দিয়েই পরমসত্তাকে জানতে চায় উপলব্ধি করতে চায়। বাউলদের এ মরমিবাদী আদর্শের ক্ষেত্রে সুফিবাদের সুস্পষ্ট প্রভাব আছে বলেই অনেকে মনে করেন।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%9a%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a5-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6-2/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*