অথবা, বাউল রূপ স্বরূপতত্ত্ব সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাউল দর্শনের রূপ-স্বরূপ তত্ত্ব কী?
অথবা, বাউল দর্শনের আলোকে সংক্ষেপে রূপ-স্বরূপ তত্ত্ব তুলে ধর।
অথবা, বাউল রূপ-স্বরূপ তত্ত্ব সংক্ষেপে বর্ণনা কর।
উত্তরা।৷ ভূমিকা : বাংলার এক শ্রেণির অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত একতারা আশ্রয়ী ভাববিদ্রোহী গায়ক, স্বাধীন ও সমন্বয়মূলক মরমি সাধকদের আত্মোপলব্ধিমূলক চিন্তাধারার নাম বাউল দর্শন। বাউল দর্শন মূলত সাধনভিত্তিক। শাস্ত্রে বাউলদের কোনো আস্থা নেই। তাঁরা দেহ ও মনের সাধনার মধ্য দিয়েই আত্মার উপলব্ধি করতে চান। আর এ সাধনার ক্ষেত্রে বাউল দর্শনে যেসব তত্ত্বকে অনুশীলন ও স্বীকার করা হয় তন্মধ্যে রূপ-স্বরূপতত্ত্ব অন্যতম।
রূপ-স্বরূপতত্ত্ব : রূপ-স্বরূপতত্ত্ব বাউল ধর্ম ও সাধনার অপরিহার্য অঙ্গ। বাউল মতে, রূপ বাইরের একটা আকার মাত্র। এ রূপাশ্রিত নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে যে সত্তার বাস সেটাই স্বরূপ। অর্থাৎ রূপের মধ্যেই স্বরূপের বাস। কিন্তু এ স্বরূপকে প্রাপ্তির উপায় কি? বাউল মতে কোনো আকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে চিরন্তন আকারহীন সত্তার মধ্যে বিলীন হলেই স্বরূপপ্রাপ্ত হওয়া যায়। আর এ স্বরূপপ্রাপ্ত অবস্থাকেই বাউল দর্শনে জ্যান্তে মরা অবস্থা বলা হয়। বাউল সাধনার মূল লক্ষ্যই হলো রূপ থেকে স্বরূপে হওয়া অর্থাৎ জ্যান্তে মরা অবস্থা প্রাপ্ত হওয়া। এ অবস্থা প্রাপ্তির জন্য বাউলদের সাধনা নরনারীর দৈহিক মিলনের মধ্য দিয়েই শুরু হয়। আর এ মিলন যখন কামরসোত্তীর্ণ হয়ে যথার্থ প্রেমে রূপ নেয় তখনই স্বরূপের সন্ধান পাওয়া যায়। এ স্বরূপের সাধনায় মানুষকে পথ দেখাতে সক্ষম একমাত্র মানুষই যিনি এ সাধনার মাধ্যমে স্বরূপের সন্ধান পেয়েছেন। বাউল সাধনার পথে তিনিই হলেন গুরু। দেহের সারবস্তু শুক্রকে অর্থাৎ ‘গুরু ধন’ ‘মহাজনের মালা’ বা ‘পুঁজি’ অথবা বিন্দুকে ধারণ করার পথ একমাত্র গুরুই দেখাতে সক্ষম। নানা রিপুর তাড়নার মধ্যে বিন্দুকে কিরূপে রক্ষা করা সম্ভব গুরুই সে পথ দেখান। এ বিন্দু রক্ষাই বাউল সাধনার মূলভিত্তি। কিন্তু রূপকে আশ্রয় করে যে স্বরূপ তার বৈশিষ্ট্য কি? বাউল মতে, স্বরূপের তিনটি অংশ। প্রথমত, ভোক্তা বা পুরুষ ’ দ্বিতীয়ত, ভোগ্য বা প্রকৃতি, তৃতীয়ত, পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনে এক অদ্বয় অবস্থা। যে অদ্বয় অবস্থায় স্বরূপ ধরা পড়ে তার কথা বলতে গিয়ে বাউলরা বলেন, “কেবল স্ত্রী পুরুষে রমণ করা নয়, আত্মায় আত্মায় রমণ হলে রসিক তারে কয়।” ভোক্তারূপী পুরুষ ও ভোগ্যারূপী প্রকৃতির মিলনের মাধ্যমে উভয়ের সম্মিলনে যে অনির্বচনীয় অদ্বয় অবস্থা সৃষ্টি হয়, সে অবস্থ প্রাপ্তিই বাউল সম্প্রদায়ের পরম উদ্দেশ্য। দেহভিত্তিক সাধনার মাধ্যমে রূপকে অতিক্রম করে স্বরূপের সন্ধান পাওয়ার মাধ্যমেই এ অবস্থা প্রাপ্তি ঘটে। এ অবস্থাকেই বাউলরা স্বভাব ছেড়ে ভাবে প্রবেশ করা বলেন। এ ভাবই হলো মহাভাব। রূপ থেকে স্বরূপে ঊর্ধ্ব গমনের জন্য বাউলরা আরোপ সাধনা করে। এ সাধনার মাধ্যমে সাধারণ প্রাকৃত মানব মানবী তাদের স্বাভাবিক ধর্মের উপর একটি স্বভাব ঊর্ধ্ব ধর্ম আরোপ করতে সক্ষম হবার সুযোগ পান। এক্ষেত্রে যদি তারা সফলকাম হন তবে তারা তাৎক্ষণিক মানবিক আনন্দের স্থলে উপভোগ করেন এক অনাবিল অপ্রাকৃত স্থায়ী আনন্দ। এটিই হলো রূপ থেকে স্বরূপে রূপান্তর ‘শ্রীরূপ স্বরূপ হয় স্বরূপ শ্রীরূপ’ বাউল দর্শন মতে, আরোপ সাধনা অবলম্বনেই সিদ্ধি পাওয়া সম্ভব আর এ সাধনায় প্রাপ্ত অপ্রাকৃত স্বরূপ সত্তাই হলো সিদ্ধ দেহ।
উপসংহার : অতএব দেখা যাচ্ছে, রূপ-স্বরূপতত্ত্ব বাউল দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু দেহকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত।স্বরূপকে পাওয়ার জন্য বাউলরা কোনো অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক সত্তার আরাধনা করে না। মানবদেহের বাস্তবরূপকে আশ্রয় করেই তাঁরা স্বরূপের সন্ধান করেন।
বাউল দর্শনের রূপ-স্বরূপতত্ত্ব সংক্ষেপে আলোচনা কর।
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079
Leave a Reply