অথবা, বাউল কারা? তাঁদের দেহাত্মবাদ ও রূপ-স্বরূপতত্ত্ব ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাউল কারা? তাঁদের দেহাত্মবাদ ও রূপ-স্বরূপতত্ত্ব বর্ণনা কর।
অথবা, বাউল কাদের বলা হয়? তাঁদের দেহাত্মবাদ ও রূপ-স্বরূপতত্ত্ব আলোচনা কর।
উত্তরা।। ভূমিকা : বাউল দর্শন বাঙালির জাতীয় দর্শন, বাঙালির চিন্তা ও মননে প্রস্ফুটিত ও বাংলার মাটিতে, বাংলার আবহে বিকশিত বাঙালির নিজের দর্শন, আপন দর্শনই হচ্ছে বাউল দর্শন, বাঙালির জীবন ও জগৎ সম্পর্কে বাস্তবমুখী নিজস্ব চিন্তাধারার সুস্পষ্ট প্রতিফলন লক্ষ করা যায় বাউল দর্শনে। আর এই বাস্তবমুখী জীবনবোধ বা দর্শনকে গড়ে উঠা একটি সংগীত আশ্রয়ী সম্প্রদায়ই হচ্ছে বাউল সম্প্রদায়। সংগীতই হচ্ছে এদের প্রাণ। আর এই সংগীত আশ্রয়ী সম্প্রদায়ের সদস্যরাই আমাদের নিকট বাউল নামে সুপরিচিত।
বাউল : বাউল শব্দটি আমাদের নিকট অতি পরিচিত একটি শব্দ। প্রায়োগিক দিক থেকে বাউল শব্দটি দ্বিবিধ অর্ধভাপক প্ৰদাম অর্ধে বাউল শব্দটি দ্বারা আমরা একটি সম্প্রদায়কে বুঝি, আর দ্বিতীয় অর্থে বাউল শব্দটি দ্বারা ঐ সম্প্রদায়ভুক্ত একজন মাত্র ব্যক্তিকে বুঝায়। অর্থাৎ বাউল শব্দের একক এবং সামষ্টিক উভয় অর্থই রয়েছে।সাধারণভাবে বাংলার এক শ্রেণির অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, একতারা আশ্রয়ী, সংসার বিরাগী, উদাসী, ধর্মোন্মাদ, ক্ষ্যাপা, আত্মকর্ম সমাহিত, ভাববিদ্ৰোহী, গায়ক, স্বাধীন ও সমন্বয়মূলক মরমি সাধকের নাম বাউল। তাই রাউল বলতেই আমাদের মানসপটে ভেসে উঠে একজন উদাসী ক্ষ্যাপা মানুষের ছবি যে পথে পথে গান গেয়ে ভিক্ষা করে বেড়ায়। গানই বাউলের প্রাণ। গানের মধ্য দিয়েই বাউল জীবনের মুক্তি খুঁজে বেড়ায়। এ মুক্তি সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক উভয়ই। গানে গানেই বাউল তার মনের মানুষকে পেতে চায়। প্রকাশ করে তার জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ও ভক্তি-যুক্তি এবং মুক্তির আকুতি। বাউলরা মূলত বাংলার অন্ত্যজ শ্রেণির লোক।
বাউলের লক্ষণ : প্রকৃত অর্থে বাউল শব্দটি দ্বারা তত্ত্বজ্ঞানী প্রেমিক, ভক্ত, পার্থিব আকর্ষণ ও সংসার লোভলালসার ঊর্ধ্বে অবস্থিত সংসারত্যাগী মরমি সাধককে বুঝালেও অধুনা আমরা যে কেউ দেহতত্ত্বের গান রচনা করলেই তাকে বাউল সম্রাট উপাধি দিয়ে বাউল সম্প্রদায়কে একটি খোলসের মধ্যে পুরে রাখছি। দেহতত্ত্বের গান রচনা করলেই যে কেউ বাউল হয়ে যায় না। বাউল হতে হলে তাদের অবশ্যই কিছু স্বকীয় লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে। আর বাউলের এই স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণের একটি তালিকা আমরা পল্লি কবি জসীমউদ্দিনের ‘বাউল’ প্রবন্ধে দেখতে পাই। এগুলো হলো :
১. যারা গুরুবাদ মানেন : ২. মানুষ ভজনে যাদের আস্থা আছে; ৩. প্রচলিত হিন্দু-মুসলমান ধর্ম পদ্ধতি যারা সূক্ষ্ম যুক্তির সাহায্যে সমালোচনা করে গলদ বের করে; ৪. যাদের গান দেহতত্ত্ব প্রধান; ৫. যারা প্রচলিত সমাজ ও নিয়মকানুন মানেন না; ৬. যারা আপন ধর্ম কথা গোপন রাখে; ৭. যারা প্রকৃতি নিয়ে সাধনা করে; ৮. যারা যৌনতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করে; ৯. যাদের গানে বাউল সুর আছে; এবং যারা আলখেল্লা পরিধান করে। পূর্ণাঙ্গভাবে এসব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী না হলে কাউকে বাউল বলা যায় না।
আত্মতত্ত্ব/ দেহাত্ববাদ : মানবদেহ ধর্ম, দর্শন ও সাধনার মূলভিত্তি। বাউলদের সকল চিন্তাধারা ও সাধন ক্রিয়ার মূলকেন্দ্র বা উৎস হচ্ছে দেহ, দেহের সাধনাই বাউল সাধনা। বাউল মতে, পঞ্চেদ্ৰীয় যুক্তদেহ সকল শক্তির আধার এবং আধ্যাত্মিক সাধনার একমাত্র অবলম্বন। দেহের তুষ্টিতেই সকল সাধনার তুষ্টি। তাই দেহতত্ত্বই বাউল দর্শনের মূলতত্ত্ব।
যাহা নাই ভাণ্ডে তাহা নাই ব্রহ্মাণ্ডে : বাউল দেহাত্মবাদের মূল বক্তব্য হলো যাহা নাই ভাণ্ডে তাহা নাই ব্রহ্মাণ্ডে; অর্থাৎ মানবদেহের বা ভাণ্ডের বাইরে আর কিছুই নেই। বাউল মতে, মানবদেহের মধ্যেই মূলতত্ত্ব, আত্মা, পরমাত্মা, পরম গুরু ও পরম তত্ত্বের বাস। তীর্থ, ধর্ম, বারোব্রত, পূজা, জপ, তপ ইত্যাদি সমস্ত কিছুই দেহ মিলে, দেহের সাধনা সর্ব সাধনার শ্রেষ্ঠ সাধনা। মানবদেহকে আশ্রয় করেই মানুষের প্রেম ও সাধন ভজন। বাউলদের মতে, এ মানবদেহ ও মানবজীবন অতি অমূল্য বস্তু কারণ মানুষ পরম তত্ত্বের প্রতিনিধি, মানুষের মধ্যেই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড ও পরমতত্ত্ব প্রতিবিম্বিত হয়। বাউলরা দেহের মধ্যেই বিশ্বের মূল উৎসের সন্ধান পান। মানবদেহ ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ড,দেহের মধ্যে যেমন পরমতত্ত্ব বা পরমাত্মার বাস তেমনি এ দেহের মধ্যে মাটি, জল, তেজ, বায়ু ব্যোম, সপ্তপাতাল, সপ্ত ঊর্ধ্বলোক, সপ্তদীপ, সপ্তসাগর সপ্ত পর্বত ইত্যাদি আছে। অর্থাৎ, এ দৃশ্যমান পৃথিবীতে যা আছে তা এদেহে আছে। সুতরাং মানবদেহ একটি ক্ষুদ্র বিশ্ব। তাইতো বাউল শিরোমণি লালন বলেন, “যে লীলে ব্রহ্মাণ্ডের পর সে লীলে ভাণ্ড মাঝার।”
দেহেই মনের মানুষের বাস : বাউল মতে, মানবদেহের মধ্যেই মনের মানুষ আলেক সাঁই, তথা স্রষ্টা বা আল্লাহর অধিষ্ঠান। বাউল সাধক স্রষ্টা বা আল্লাহকে বাইরের জগতে খুঁজে পান না। তিনি নিজের মধ্যে তথা মানবদেহের মধ্যে স্রষ্টার অস্তিত্বকে অনুভব করেন। যে সত্তা বাইরের শব্দে, গন্ধে, বর্ণে এবং অসংখ্য ছন্দ ভঙ্গিতে ইন্দ্রিয় গ্রামকে অধিকার করে আছে সেই সত্তাই অন্তরে ইন্দিয়াতীত রূপে কেবল মানসবৃত্তে পরম বিস্ময়ে স্ফুটিত। এ পরম সুন্দর বাউলের অন্তরে সৃষ্টি করে ভাবের উন্মাদনা, তাকে করে ভাবের উন্মাদ, প্রেমের পাগল। বাউল আপনাকে হারিয়ে ফেলে সবকিছু একাকার হয়ে যায়। বাউলের দেহভিত্তিক সাধনায় তাই এ স্রষ্টার মাঝে বিলীন হয়ে যাওয়ার মরমি সুর বেজে উঠে। এ সুরই বিধৃত হয়েছে লালনের গানে যেখানে লালন বলেছে-
“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়,
ধরতে পারলে মন বেড়ী দিতাম তার পায়।”
আবার তিনি বলেন,
“হায় চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি,
ভেদ পরিচয় দেয় না আমায় ঐ খেদে ঝরে আঁখি।
এই খাঁচা মানবদেহ, পাখি রুহ বা আত্মা। দেহের খাঁচায় জীবনব্যাপী আত্মা নামের পাখি পোষার পরও তার পরিচয় সহজে জানা যায় না, এ দুঃখে লালনের আঁখিতে অশ্রু ঝরে। তাইতো এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন উপনিষদে আবার সে কথাই আপন ভাষায় বলেছে নিরক্ষর, অশাস্ত্রজ্ঞ বাউল। সে আপন দেবতাকে জানে আপনার মধ্যেই, তাকে বলে মনের মানুষ, মনের মাঝে করে অন্বেষণ, “অতএব, পরমাত্মা বা মনের মানুষের সন্ধানে মানবদেহের মধ্যে অন্বেষণের সাধনাই বাউল সাধনা বা বাউল দেহাত্মবাদ।
রূপ-স্বরূপতত্ত্ব : রূপ-স্বরূপতত্ত্ব বাউল ধর্ম ও সাধনার অপরিহার্য অঙ্গ। বাউল মতে, রূপ বাইরের একটা আকার মাত্র। এর রূপাশ্রিত নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে যে সত্তার বাস সেটাই স্বরূপ। অর্থাৎ রূপের মধ্যেই স্বরূপের বাস। কিন্তু এ স্বরূপকে প্রাপ্তির উপায় কি? বাউল মতে, কোনো আকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে চিরন্তন আকারহীন সত্তার মধ্যে বিলীন হলেই স্বরূপপ্রাপ্ত হওয়া যায়। আর এ স্বরূপপ্রাপ্ত অবস্থাকেই বাউল দর্শনে বলা হয় জ্যান্ত মরা অবস্থা। বাউল সাধনার মূল লক্ষ্যই হলো রূপ থেকে স্বরূপে উত্তীর্ণ হওয়া, অর্থাৎ জ্যান্ত মরা অবস্থা প্রাপ্ত হওয়া। এ অবস্থা প্রাপ্তির জন্য বাউলদের সাধন
নরনারীর দৈহিক মিলন দিয়েই শুরু হয়। আর এ মিলন যখন কামরসোত্তীর্ণ হয়ে যথার্থ প্রেমে রূপ নেয় তখনই স্বরূপের সন্ধান পাওয়া যায়। এ স্বরূপ সাধনায় মানুষকে পথ দেখাতে সক্ষম একমাত্র মানুষই যিনি এ সাধনার মাধ্যমে স্বরূপের সন্ধান পেয়েছেন। বাউল সাধনার পথে তিনিই হলেন গুরু দেহের সারবস্তু শুক্রকে, অর্থাৎ ‘গুরু ধন’ মহাজনের মালা’ বা ‘পুঁজি’ অথবা ‘বিন্দু’কে ধারণ করার পথ একমাত্র গুরুই দেখাতে সক্ষম। নানা রিপুর তাড়নার মধ্যে বিন্দুকে কিরূপে রক্ষা করা সম্ভব গুরুই সে পথ দেখান। এ বিন্দু রক্ষাই হলো বাউল সাধনার মূলভিত্তি। কিন্তু রূপকে আশ্রয় করে যে স্বরূপ তার বৈশিষ্ট্য কি? বাউল মতে স্বরূপের তিনটি অংশ। প্রথমত, ভোক্তা বা পুরুষ, দ্বিতীয়ত, ভোগ্য বা প্রকৃতি, তৃতীয়ত, পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনে এক অদ্বয় অবস্থা, যে অদ্বয় অবস্থায় স্বরূপ ধরা পড়ে তার কথা বলতে গিয়ে বাউলরা বলেন, কেবল স্ত্রী পুরুষে রমণ করা নয়, আত্মায় আত্মায় রমণ হলে রসিক তারে কয়।” ভোক্তারূপী পুরুষ ও ভোগ্যরূপী প্রকৃতির মিলনের মাধ্যমে উভয়ের সম্মেলনে যে অনির্বচনীয় অদ্বয় অবস্থা সৃষ্টি হয়, সে অবস্থা প্রাপ্তিই বাউল সম্প্রদায়ের পরম লক্ষ্য। দেহভিত্তিক সাধনার মাধ্যমে রূপকে অতিক্রম করে স্বরূপের সন্ধান পাওয়ার মাধ্যমেই এ অবস্থা প্রাপ্তি ঘটে।এ অবস্থাকেই বাউলরা স্বভাব ছেড়ে ভাবে প্রবেশ করা বলেন । এ ভাবই হলো মহাভাব। রূপ থেকে স্বরূপে ঊর্ধ্ব গমনের জন্য বাউলরা আরোপ সাধনা করে। এ সাধনার মাধ্যমে সাধারণত প্রকৃত মানব মানবী তাদের স্বাভাবিক ধর্মের উপর একটি স্বভাব ঊর্ধ্ব ধর্ম আরোপ করার সুযোগ পান। এক্ষেত্রে যদি তারা সফলকাম হন তবে তারা তাৎক্ষণিক মানবিক আনন্দের স্থলে উপভোগ করেন এক অনাবিল অপ্রাকৃত স্থায়ী আনন্দ। এটিই হলো রূপ থেকে স্বরূপে রূপান্তর ‘শ্রীরূপ স্বরূপ হয় স্বরূপ শ্রীরূপ’। বাউল মতে, আরোপ সাধনা অবলম্বনেই সিদ্ধি পাওয়া সম্ভব। আর এ সাধনায় প্রাপ্ত অপ্রাকৃত স্বরূপ সত্তাই হলো সিদ্ধ দেহ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, বাউল বাংলার একটি লোকজ সম্প্রদায়। পোশাক-পরিচ্ছদ, চাল-চলন, আচার ব্যবহার, ধর্মবিশ্বাস, কর্মসাধনা ইত্যাদির দিক দিয়ে যারা সমাজে বসবাসকারী অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র। যারা আপনভাবে মশগুল ও উন্মাদ তারা বাউল । বাউলরা স্বকীয় সাধন পদ্ধতির অনুসারী। সকল বাউলরা একই সাধন প্রণালির অনুসারী, একই তত্ত্বের উপাসক। আর বাউলদের এই সাধন পদ্ধতিরই অপরিহার্য দুটি অঙ্গ হলো দেহতত্ত্ব ও রূপস্বরূপ তত্ত্ব। মূলত
বাউলদের সকল সাধন অঙ্গেরই মূলভিত্তি দেহ।
বাউল কারা? তাঁদের দেহাত্মবাদ ও রূপ-স্বরূপতত্ত্ব আলোচনা কর।
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079
Leave a Reply