বাংলাদেশের মাঠ প্রশাসনের প্রতিবন্ধকতাসমূহ আলোচনা কর ।

অথবা, বাংলাদেশের মাঠ প্রশাসনের সমস্যাসমূহ বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের মাঠ প্রশাসনের সমস্যাগুলো আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের মাঠ প্রশাসনের প্রতিবন্ধকতাসমূহ বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের মাঠ প্রশাসনের বাধাসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে মাঠ প্রশাসনের অসুবিধাগুলোর বর্ণনা দাও।
অথবা, বাংলাদেশের মাঠ প্রশাসনের অসুবিধাসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, কেন বাংলাদেশের মাঠ প্রশাসন যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ? ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
জনগণের মৌলিক অধিকারের সঠিক বাস্তবায়ন ও স্বাধীনতার সুফল সকলের ভোগ করার সুযোগ করে দেয়ার জন্য সরকারকে একটি বাস্তবধর্মী ও যুগোপযোগী প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে হয়। কারণ প্রশাসনিক কাঠামোই হচ্ছে রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি। বাংলাদেশে বিকেন্দ্রীকরণ নীতির ভিত্তিতে প্রশাসন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রশাসনের এ বিন্যাসকে মাঠ প্রশাসন বলা হয় ।

স্থানীয় সরকার কাঠামো : বর্তমান আধুনিক বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রচলন রয়েছে। স্থানীয় জনসাধারণের চাহিদা পূরণ, স্থানীয় সমস্যার সমাধান এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রয়োজন। সময়ের পরিবর্তনের ধারায় স্থানীয় সরকার কাঠামোতে নানাবিধ পরিবর্তন সাধিত হয়। অর্থাৎ এর সর্বক্ষেত্রে যোগ হয় নতুন মাত্রা। স্থানীয় সরকার কাঠামো যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করে সময়ের আবর্তে তার গুরুত্ব অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে স্থানীয় সরকারকে বহুবিধ কার্যাবলি সম্পাদন করতে হচ্ছে।
স্থানীয় সরকার কাঠামোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : স্থানীয় সরকার কাঠামো পর্যালোচনা কমিশন, ১৯৯১ [স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসন পুনর্গঠন) (রহিত করণ) অধ্যাদেশ, ১৯৯১। বাংলাদেশে প্রস্তাবিত স্থানীয় সরকার কাঠামোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের উপর আলোকপাত করেছে। এগুলো হচ্ছে নিম্নরূপ :
১. প্রশাসন ও উন্নয়নে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
২. প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণ।
৩. স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।
৪. স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জনপ্রতিনিধিদের সক্রিয় ভূমিকা রাখার ব্যবস্থা করা।
৫. উন্নয়নমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট এলাকা হতে সম্পদ আহরণ করা।
৬, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে জনগণের নিকট জবাবদিহি রাখার ব্যবস্থা করা।
বাংলাদেশের মাঠ প্রশাসনের প্রতিবন্ধকতাসমূহ : বাংলাদেশ উত্তরাধিকারসূত্রে যে প্রশাসন ব্যবস্থা লাভ করে তা মূলত আর্থসামাজিক অবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন ও কেন্দ্রমুখী প্রশাসন ব্যবস্থা। সুষ্ঠু, শক্তিশালী রাজনৈতিক বিকাশ ও নিরপেক্ষ প্রশাসনের অভাবে প্রশাসনকে জনকল্যাণমুখী ও দক্ষভাবে গড়ে তোলা যায়নি। নিম্নে বাংলাদেশের মাঠ প্রশাসনের সমস্যাগুলো আলোচনা করা হলো :
১. কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা থেকে প্রাপ্ত দ্বন্দ্ব : কেন্দ্রীভূত প্রশাসন ব্যবস্থায় কেন্দ্র বেশি মাত্রায় কর্তৃত্ব করে থাকে। অথচ দ্রুত অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য মাঠ প্রশাসনের হাতে যথেষ্ট কর্তৃত্ব দরকার। কেননা স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সমস্যা এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু কেন্দ্র এ সম্পর্কিত কর্তৃত্ব মাঠ প্রশাসনকে দিতে নারাজ। আর এই সমন্বয়ের অভাবে প্রশাসন তার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়।
২. সিভিল সার্ভিস ক্যাডারদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব : মাঠ পর্যায়ে কর্মরত সিভিল সার্ভিস ক্যাডারগণ তাদের চাকরির সুযোগ সুবিধার বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদেরকে অনেকে বৈষম্যের স্বীকার বলে মনে করেন। সামাজিক মর্যাদাও সব ক্যাডার কর্মকর্তাদের একরকম নয়। এ বৈষম্যমূলক সার্ভিস ব্যবস্থার কারণে ক্যাডারদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। যা মাঠ প্রশাসনের বিরাজমান সমস্যাগুলোর অন্যতম একটি সমস্যা।
৩. আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা : বর্তমানে একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও এ দুষ্টচক্র প্রশাসন ব্যবস্থার উপর ভর করে আছে। আমলারা গোষ্ঠীগত স্বার্থ সংরক্ষণে এবং মর্যাদাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য জনগণ থেকে সর্বদা নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে। এর ফলে সমগ্র প্রগতি ব্যাহত হচ্ছে।
৪. বিভাগগুলোর মাঝে সমন্বয়হীনতা : মাঠ প্রশাসনের সমস্যাসমূহের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিভিন্ন বিভাগের মাঝে সমন্বয়ের অভাব যা মাঠ প্রশাসনের সফলতার সাথে অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। কারণ মাঠ প্রশাসনের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আঞ্চলিক বিভাগে বিভাগীয় কর্মকর্তাগণ কাজ করেন। কিন্তু এ বিভিন্ন বিভাগের কর্মসম্পাদনের জন্য কেন্দ্র কর্তৃক প্রণীত নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সর্বাগ্রে যেটি প্রয়োজন তা হলো বিভাগের মাঝে সমন্বয়সাধন। অথচ বাংলাদেশের মাঠ প্রশাসনের ক্ষেত্রে এ সমন্বয়হীনতা বেশি দেখা যায়।
৫. দলীয়করণের মানসিকতা : ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল সবসময় প্রশাসনকে দলীয় লক্ষ্যে, দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়। প্রায়ই তারা সন্দেহ করেন যে প্রশাসন তাদের স্বার্থরক্ষা করছে না। দলীয় স্বার্থে প্রশাসনকে ব্যবহার করার লক্ষ্যে প্রশাসনের উপর চাপপ্রয়োগ করে ও প্রভাব খাটানোর ফলে প্রশাসনের নৈর্ব্যক্তিকতা ক্ষুণ্ন হয়। এতে ক্ষমতাসীন দলের সাথে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হলে অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বদলি, পদোন্নতির ক্ষেত্রে বাধা ইত্যাদি সৃষ্টি করা হয়। বলপূর্বক অবসর গ্রহণ করানোর দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের প্রশাসনে আজও বিদ্যমান আছে।ফলে নিরপেক্ষভাবে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন দায়িত্ব পালন করতে পারছে না।
৬. প্রেশার গ্রুপ ও এলিট শ্রেণি : স্থানীয় প্রেশার গ্রুপ ও এলিট শ্রেণি সবসময় প্রশাসনের প্রভাব খাটিয়ে শ্রেণি স্বার্থ রক্ষা করতে চায়। বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসন ব্যবস্থায় এলিট শ্রেণি একটা শক্তিশালী প্রেশার গ্রুপ হিসেবে অবতীর্ণ হয়।মাঠ প্রশাসনকে সর্বদা এ চাপ মোকাবিলা করে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে কাজ করতে হয়।
৭. বিরোধী দলের স্বার্থে দ্বন্দ্ব : বিরোধী দল মনে করে প্রশাসন সরকারি দলের স্বার্থ রক্ষা করছে। এ মনোভাবের কারণে তারা প্রতিনিয়ত প্রশাসনের উপর চাপ প্রয়োগ করে কাজে অসহযোগিতা করে। ধর্মঘট, হরতাল, ঘেরাও, মিছিল মিটিং ইত্যাদির মাধ্যমে প্রশাসনে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে চায়। এ সমস্ত চাপ মোকাবিলা করে প্রশাসনকে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
৮. অর্থ সংক্রান্ত : মাঠ প্রশাসনের আয়ের উৎস থেকে যে পরিমাণ অর্থ সংগৃহীত হয় তা দ্বারা মাঠ পর্যায়ের উন্নয়নমূলক প্রয়োজনীয় কাজ নির্বাহ করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে যথেষ্ট অর্থের প্রয়োজন। যার ফলশ্রুতিতে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের মুখাপেক্ষী হতে হয়। এ জন্য বাজেট প্রণয়নে মাঠ প্রশাসনের স্বাধীনতা বিঘ্নিত হয়।
৯. জনপ্রতিনিধিদের প্রভাব : নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ তাদের প্রভাব খাটানোর জন্য মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উপর প্রভাব ফেলে। এর ফলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে মাঠ প্রশাসন তাদের কার্যসম্পাদন করতে ব্যর্থ হয়। এক্ষেত্রে প্রশাসনের উপর জনপ্রতিনিধিদের অযাচিত প্রভাবে কাজের ব্যাঘাত ঘটায়।
১০. দুর্নীতি : অর্থ আত্মসাৎ, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, বাংলাদেশের মাঠ প্রশাসন ব্যবস্থার একটি নিত্যনৈমিত্তিক চিত্র। সাধারণ ব্যাপারে ও নৈতিকতার অবক্ষয় কর্মকর্তাদের স্বাভাবিক চরিত্রের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তৃতির কারণে মাঠ প্রশাসনের উপর জনগণের আস্থার ভিত্তি নেই। কাজেই সাধারণ মানুষ সহজে প্রশাসনের নিকট যেতে চায় না।
১১. নেতৃত্বের অভাব : মাঠ প্রশাসনের প্রশাসনিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে উপযোগী জ্ঞানের অভাব, সংশ্লেষণের অভাব, পারিবারিক পটভূমি, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশ্বায়নের সাথে যোগাযোগের অভাব, দেশের স্বার্থ অপেক্ষা ব্যক্তি স্বার্থ ও দলীয় স্বার্থকে অধিক গুরুত্ব দেয়া প্রভৃতি কারণে মাঠ পর্যায়ে দক্ষ নেতৃত্ব সৃষ্টি করা যাচ্ছে না।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, একটি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মাঠ প্রশাসনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মাঠ প্রশাসনের সর্বত্তরে সমস্যায় জর্জরিত। প্রশাসকদের আমলাতান্ত্রিক মনোভাবের পরিবর্তন এবং জনগণের সুষ্ঠু অংশগ্রহণের মাধ্যমে মাঠ প্রশাসন সফলভাবে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে এটাই সবার কাম্য।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a4%e0%a7%83%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a5%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*