বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীর ক্ষমতায়ন আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের পরিবেশে নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কে বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীর ক্ষমতায়ন ব্যাখ্যা কর।
অথবা, নারীর ক্ষমতায়ন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় এখনো নারীকে পর্দার অন্তরালে আটকে রাখা হয়েছে। নারী আজ নানাভাবে নির্যাতিত, সময়ের প্রয়োজনে নারী অধিকারের ব্যাপারে সারা বিশ্ব আজ সোচ্চার। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। যদিও বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় নারীদের অবস্থা প্রান্তিক, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের ধারায় নারীদের অংশগ্রহণের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। যখন থেকে তারা আর্থসামাজিক উন্নয়নের ধারায় নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছে, তখন থেকেই মূলত অধিকারবোধ সম্পর্কে সচেতন হয়েছে। আর অধিকারবোধের এ সচেতনতা থেকেই মূলত ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গটি জোরালোভাবে দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীর ক্ষমতায়ন : নিম্নে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তৃণমূল পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন আলোচনা করা হলো :
১. পারিবারিক ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন : বাংলাদেশের পরিবার, সম্প্রদায় ও সমাজে নারী ও পুরুষের সম্পর্ক নির্ধারিত হয় পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শ দ্বারা। ক্ষমতা বিন্যাসের ভিত্তিতে পারিবারিক কাঠামো পিতৃতান্ত্রিক। পারিবারিক সিদ্ধান্তে তার মতামতই প্রাধান্য পায়। সামাজিকীকরণের নিয়ম অনুসারে পারিবারিক কাঠামোতে নারী সন্তান জন্মদান ও প্রতিপালনের পাশাপাশি একজন মজুরিহীন অদৃশ্য শ্রমিকের ভূমিকা পালন করে। এমনকি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর খাদ্যাভ্যাস, শ্রমবিভাগ, পরিবারের সদস্যদের প্রতি তার সম্পর্ক ও আচরণ প্রভৃতি নির্দিষ্ট করে রেখেছে। অর্থনৈতিকভাবে নারীদের কাজের মূল্যায়ন না হওয়া এবং একই সাথে পুরুষদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে নারীরা পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় এখন পর্যন্ত নিজেদেরকে অন্তর্ভুক্ত করতে সর্বাংশে যথার্থ হয়নি।
২. স্থানীয় সরকার প্রশাসনে নারীর ক্ষমতায়ন : বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার প্রশাসনের প্রথম স্তর হলো গ্রাম তথা ইউনিয়ন পরিষদ । জাতীয় পর্যায়ে দেখা যায় যে, যারা রাজনীতিতে প্রবেশ করেছে, তারা এলিট গ্রুপ বা সমৃদ্ধশালী পরিবার থেকে এসেছে। স্থানীয় সরকারের রাজনীতিও এর থেকে পৃথক কিছু নয়। এ পর্যায়েও একই ধারা বিদ্যমান। উল্লেখ্য যে,।নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ে আমরা যে ধারাটি নিয়ে আলোচনা করছি তা শুধুমাত্র এলিট নারী শ্রেণিকে নিয়ে নয়, বরং নারীর উন্নয়ন বা নারীর ক্ষমতায়ন বলতে আমরা সাধারণ নারীদেরকেই বুঝি বলে রাখা দরকার যে, স্থানীয় সরকার বলতে আমরা গ্রাম, ইউনিয়ন, থানা, জেলা এবং বিভাগকেই বুঝাতে চাচ্ছি। ১৯৫৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত মহিলাদের স্থানীয় সংস্থায় ভোটদানের অধিকার পর্যন্ত ছিল না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিগত ৪৫ বছরে ৯টি স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৩, ১৯৭৭, ১৯৮৪, ১৯৮৮, ১৯৯৩, ১৯৯৭, ২০০৩, ২০০৯ এবং ২০১৬ সালে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে ৪৩৫০টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে মাত্র একটি ইউনিয়নে ১ জন মহিলা চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন রংপুর থেকে। ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে মাত্র ৪ জন মহিলা চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হয়েছিলেন ৪৩৫২টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্য থেকে। ১৯৮৪ সালে ৪৪০০টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে ৪ + ২ = ৬ জন এবং ১৯৮৮ সালে ৪৪০১টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে প্রার্থী সংখ্যা ছিল ১৮৫৬৬ জন। এর মধ্যে মহিলা চেয়ারপার্সন প্রার্থী ছিল ৭৯ জন এবং এতে ১জন মহিলা চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন। ১৯৯৩ সালে ৪৪৫০টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে মহিলা চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন মাত্র ২৪ জন এবং ১৯৯৭ সালে ৪৪৫০টি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে মাত্র ২৩ জন মহিলা চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন। ইউনিয়নের গণ্ডি ছাড়িয়ে আমরা যদি থানা, জেলা, বিভাগ এমনকি সচিবালয় পর্যন্ত দৃষ্টি দেই, তাহলে সেখানেও নারীদের ক্ষমতায়নের একই তথ্য পাওয়া যাবে ।
৩. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়ায় নারীর ক্ষমতায়ন : জাতীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াটি মূলত সম্পন্ন হয়। প্রত্যেকটি দেশের আইনসভায়। আইনসভায় মহিলা প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার মাধ্যমেই মহিলাদের জাতীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখতে পারে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের
নির্বাচনে ব্রিটিশ আমলের মহিলাদের সংরক্ষিত ৭টি আসন বৃদ্ধি পেয়ে ১৫টিতে উন্নীত করা হয় এবং ১৯৭৯ সালে এক সংশোধনীর মাধ্যমে একে ১৫ থেকে ৩০ এ উন্নীত করা হয়। সংবিধানের দশম সংশোধনীর মাধ্যমে ৩০টি সংরক্ষিত আসনের মেয়াদ আরো ১০ বছরের জন্য বাড়ানো হয়। ২০০১ সালে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ৩০টি আসনের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। একই সাথে সাধারণ আসনে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সংখ্যা কমে যায়। যার ফলশ্রুতিতে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৫টি আসন বৃদ্ধি করে ৪৫টি ও পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আরো পাঁচটি আসন বৃদ্ধি করে ৫০টিতে উন্নীত করা হয়। কিন্তু এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, জাতীয় পর্যায়ে মহিলা প্রতিনিধিত্বের এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় মূলত এলিট শ্রেণির প্রাধান্য একচেটিয়া। অপরদিকে, আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহ নারী ক্ষমতায়নে অধিক সোচ্চার ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন আইনি পদক্ষেপও নিয়েছে। জাতিসংঘের Economic and Social Council (ECOSOC) ১৯৯৫ সাল নাগাদ পার্লামেন্ট, রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন, স্বার্থ গোষ্ঠী ইত্যাদিতে নারীর অংশগ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ৩০% স্থাপন করেছে। কিন্তু বিভিন্ন রাষ্ট্রের ও আন্তর্জাতিক নারীর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, রাজনৈতিক দলে কাঠামোগত চরিত্রে সংসদীয় রাজনীতিতে নারীর আগমনকে নিরুৎসাহিত ও বাধাগ্রস্ত করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে উল্লিখিত প্রতিবন্ধকতাসমূহ পরিলক্ষিত হয়। কেবল বিশ্ব সম্মেলন নয়, বাংলাদেশেও স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পরিসরে যে কোনো নীতি।নির্ধারণী আলোচনায় নারীর ক্ষমতায়নকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তা সত্ত্বেও দেশজুড়ে নারী হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ার মধ্য দিয়েই নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব হবে। আর নারীর ক্ষমতায়নের পথে বাধা চিহ্নিত করে ক্ষমতায়নের উপায় অনুসন্ধান করতে হবে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%b8%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6%e0%a7%87/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*