বাংলাদেশের নারী আন্দোলনে সুফিয়া কামালের ভূমিকা কী ছিল? বর্ণনা কর।

অথবা, বাংলাদেশে নারী আন্দোলনে সুফিয়া কামালের অবদান আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে নারী আন্দোলনে সুফিয়া কামালের অবদান বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের নারী আন্দোলনে সুফিয়া কামালের ভূমিকা আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী প্রয়াত শ্রদ্ধেয়া কবি সুফিয়া কামাল বরিশালের এক ঐতিহ্যবাহী বনেদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বরিশালের তৎকালীন বিশেষ সামাজিক, রাজনৈতিক, জাতীয় আবহাওয়া ও পরিবেশের এক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব তাঁর উপরে পড়েছিল। জীবনে বিভিন্ন ঘটনার সূত্রে এমন অনেক ব্যক্তিত্বের সাথে তার যোগাযোগ ঘটে, যা অধিকাংশ সময়ই তাঁকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে। শৈশব থেকেই তাঁর মাঝে এক গভীর আত্মানুসন্ধানের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তাঁর চিন্তাচেতনায় সমাজসংস্কারের আত্মানুসন্ধানের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। এ আত্মানুসন্ধান প্রবণতার জন্য পরবর্তীকালে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও নারী জাগরণে জড়িয়ে পড়েন। ফলে তিনি নারীদের জাগরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে গেছেন।
নারী আন্দোলনে সুফিয়া কামালের ভূমিকা : বেগম সুফিয়া কামাল বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের অগ্রদূত হিসেবে পরিচিত। তিনি নারীদের জন্য যেসব ভূমিকা রেখেছেন, তা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. নারী জাগরণ ও মুক্তি আন্দোলন : সুফিয়া কামাল বাংলাদেশের একজন কবি হলেও তিনি সুস্থ, উন্নত প্রগতিশীল সংস্কারবাদী জীবন চেতনাবোধের আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন। যার ফলে বিভিন্ন সংকটকালীন সময়ে, নারী জাগরণ ও মুক্তি আন্দোলনে গভীরভাবে জড়িত হয়ে পড়েন। বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক কালপর্বে স্বাধীন বাংলাদেশের নারী জাগরণ ও মুক্তির আন্দোলনে তিনি এক জাগ্রত অগ্রসর পথিকের ও বীর সেনানীর ভূমিকা পালন করেন। তিনি নারীদের প্রেরণা ও জাগরণের অগ্রপথিক ছাড়া আর কিছু নয়।
২. স্বদেশী আন্দোলনে : খুব অল্প বয়স থেকেই সে সময়ের স্বদেশী আন্দোলনের পরোক্ষ প্রভাব তাঁর উপর পড়ে। যার প্রতিফলন বরিশালের অশ্বিনীকুমার দত্ত সহ অনেক স্বদেশী আন্দোলনের ব্যক্তিত্বের ভূমিকার কথা তাঁর লেখায় পাওয়া যায়। জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরণ, স্বদেশী সংগ্রামীদের সাথে ব্যক্তিগত সাহায্য, যোগাযোগ, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন, পোশাক পরিবর্তন করে বরিশালের বিভিন্ন আন্দোলনে তিনি স্বয়ং যোগদান করেন। জমিদার পরিবারের ঐশ্বর্য ও সামাজিক মর্যাদার মাঝে থেকেও মায়ের নিঃসঙ্গ জীবন এবং পরবর্তীকালে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের পথ পরিক্রমায় সুফিয়া কামাল আমাদের এ অঞ্চলের পরিবার ও সমাজে নারীর প্রকৃত অবস্থানের পরিচয় পেয়ে যান, যা তিনি মেনে নিতে পারেন নি, ফলে
আন্দোলনের মাধ্যমে অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হন।
৩. সংগঠক হিসেবে : সুফিয়া কামাল কলকাতায় বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের গড়া সংগঠন আঞ্জুমানে খাতওয়াতীনে ইসলামের সদস্য হওয়া, বস্তিতে কাজ করা, বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র, শিশু শিক্ষাকেন্দ্র পরিচালনা করা, অল ইন্ডিয়া উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সাথে যুক্ত হয়েছেন। এ সংগঠনে থাকাকালে মেয়েদের ভোটাধিকার, স্বদেশী আন্দোলনের ও স্বাধীনতা আন্দোলনের কাজে তিনি যোগদান করেন। তাঁর আত্মসচেতনতার বিকাশ ঘটে এ সংগঠনের মাধ্যমে। এ সংগঠনের মাধ্যমে তিনি দাবি আদায়ে ভূমিকা পালন করে থাকেন।
৪. বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন : তিনি ১৯৪৮ সালের পর ধীরে ধীরে কাজী মোতাহার হোসেন, প্রগতিশীল শিল্পীগোষ্ঠী, সাহিত্য চক্রের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যোগদান করেন এবং নিজের বাসায় ছাত্রী নেত্রীদের নিয়ে সভা করেন। এভাবে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জাতীয়তাবাদী প্রগতিশীল আদর্শ চেতনা ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চিন্তাধারা বিকাশের আন্দোলন ও সংগঠনগুলোর সাথেও গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন।
৫. নারীর আইনগত অধিকার অর্জনে : পাকিস্তানি আমলে নারীর আইনগত অধিকার ও পরিবারে নারীর অবস্থান উন্নত করার লক্ষ্যে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপে সুফিয়া কামাল সক্রিয় নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। সুফিয়া কামাল বঙ্গীয় মুসলিম বিবাহ আইন ও তালাক রেজিস্ট্রেশন বিলের সংশোধনীর প্রতিবাদ জানানো, বিবাহ ও পারিবারিক আইন কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনা, জনমত গঠনের কাজ করেন। মহিলা প্রার্থীদের জন্য নির্বাচনী আইন সংশোধনীর প্রতিবাদে মহিলা সম্মেলন করতে উদ্যোগী হলেন সুফিয়া কামাল।
৬. পারিবারিক আইন সংশোধন : ১৯৬২ সালে মুসলিম পারিবারিক আইন সংশোধন করে নারী স্বার্থরক্ষামূলক যে ধারা যুক্ত হয়েছিল, তাতে সুফিয়ার অবদান ছিল অসামান্য। একটি প্রতিক্রিয়াশীল মহল তখন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন। একটি প্রতিক্রিয়াশীল মহল যখন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন, তখন এ নারী স্বার্থরক্ষাকারী অর্ডিন্যান্স বানচালকারীদের বিরুদ্ধে বিবৃতি, সভা, সমাবেশ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সীমিত হলেও একটি প্রতিবাদ আন্দোলন করেন। সুফিয়া কামাল এর প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে যুক্ত ছিলেন।
৭. গণঅভ্যুত্থানে : ১৯৬৮-৭০ পর্যন্ত উত্তাল গণজোয়ার ও গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাঙালি জাতির যে ঐতিহাসিক উত্তরণ সংগঠিত হলো, সে জাগরণের অগ্নিমশালবাহী চেতনা স্ফুরণের আন্দোলনের সাথে সুফিয়া কামালও যুক্ত ছিলেন। তিনি আরো অগ্রসরভাবে এগিয়ে আসলেন মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশের নারীসমাজকে তার অধিকার অর্জনের পক্ষে অগ্রণী ভূমিকা নিতে। বাঙালি জাতির সে অবিস্মরণীয় জাগরণের ফলে আত্মজাগরণ আর আত্মদানের প্রস্তুতিলগ্নে, শতমুখী কর্মপ্রচেষ্টার একটি ধারায় নারীর মানবাধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চলে, জন্ম নেয় আরেক সংগ্রামের।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সুফিয়া কামাল মহিলা পরিষদ পরিচালনা এবং নেতৃত্বদানসহ ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে নারী আন্দোলনকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন। মুক্তচিন্তার চেতনা বিকাশের সচেতন প্রয়াস গড়ে উঠা সাহিত্যিকদের সংগঠন শিখাগোষ্ঠীর সাথে যুক্ত থেকে সুফিয়া কামাল প্রায় সকল ধরনের সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও কর্মপ্রচেষ্টার সাথে যেমন জড়িত ছিলেন, তেমনি প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে সেসব দলের নেতা সংগঠকদের অনেকের সাথে তার একটি ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল। আজকের বাংলাদেশে নারী আন্দোলনের চিত্র অনেক ক্ষেত্রেই পরিবর্তিত হচ্ছে। বিশেষ করে
গত দুই দশকে বৈশ্বিক নারী আন্দোলনে জাতিসংঘের উদ্যোগে, প্রচেষ্টায়, কর্মসূচিতে, উন্নয়ন সংস্থার কার্যকলাপে অনেক ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন উদ্যোগ চলছে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a4%e0%a7%83%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%be-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4%e0%a6%bf/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*