বাংলাদেশের নারীর আইনগত অধিকার সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশে নারীর নৈতিক ও আইনগত অধিকারের বিবরণ দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা :
আদিম যুগে নারী-পুরুষের সমান অধিকার থাকলেও পরবর্তীকালে বিবর্তনের ধারায় নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য দেখা দেয়। কালক্রমে নারী তার ন্যায্য অধিকার হারিয়ে পুরুষের অধীন হয়ে পড়ে। বর্তমানে নারীর অধীনতা বিষয়টি দেশে বিদেশে বিশেষভাবে আলোচিত হচ্ছে। জন স্টুয়ার্ট মিল এ সম্পর্কে বলেছেন, “নারীর অধীনতা নেই যে, অন্যান্য দেশের মতো নারীসমাজ ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। আইনই একমাত্র নারীর নৈতিক অধিকার রক্ষা ও এক সামাজিক মতবাদের বিশ্বাস মাত্র। এটি সম্পর্ক নয়। বাংলাদেশে নারীর অধিকার সমালোচনায় একথা বলতে দ্বিধা নিরাপত্তা রক্ষার সহায়ক।
বাংলাদেশে নারীর আইনগত ও নৈতিক অধিকার : বাংলাদেশ সংবিধানের ২৬, ২৭, ২৮ এবং ২৯নং ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশের সকল নাগরিক আইনের চোখে সমান এবং রাষ্ট্র কর্তৃক যে আইনগুলো প্রণয়ন করা হয় স আইনে নারী ও পুরুষ উভয়ই সমান। কিন্তু ধর্মীয় আইন মতে, বাংলাদেশের নারী এবং পুরুষ সবাই সমান নয়, এবং পুরুষের আইনগত অধিকারের ক্ষেত্রে অনেক বৈষম্য দেখা যায়। নিম্নে নারীদের আইনগত ও নৈতিক অধিকার বরং নারী আলোচনা করা হলো :
১. মুসলিম বিবাহ আইন : বাংলাদেশে মুসলিম বিবাহ আইন নারীদের অধিকারের একটি প্রধান দলিল। নিম্নে এর বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো:
প্রথমত, বিবাহ আইনে মেয়ের বয়স ১৮ বছর এবং পুরুষের ২১ বছর হতে হবে দ্বিতীয়ত, ছেলে কর্তৃক মেয়েকে বিবাহকালে অবশ্যই দেনমোহর দিতে হবে। এ দেনমোহর আবার দু’ধরনের। যথা :
ক. আশু দেনমোহর : বিয়ের সাথে সাথে এ দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। আশু দেনমোহর অলংকার এবং বস্ত্রের মাধ্যমে পরিশোধ করা যায়।
খ. বিলম্বিত দেনমোহর : এ দেনমোহর বিয়ের পরেও শোধ করা যায়। তৃতীয়ত, বিবাহ অবশ্যই রেজিস্টার্ড হবে। চতুর্থত, কাবিনে মহিলার বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার থাকতে হবে।
২. বিবাহবিচ্ছেদ আইন : মুসলিম বিবাহবিচ্ছেদ আইনে মহিলাদের অধিকারগুলো হলো :
ক. স্বামী কর্তৃক কাবিনের টাকা পরিশোধ করতে হবে।
খ.তিন মাস পর্যন্ত মহিলাদের ভরণপোষণ দিতে হবে। তবে বর্তমানে দুস্থ মহিলাদের ক্ষেত্রে আদালত কর্তৃক সারা জীবনই ভরণপোষণ দানের আদেশ দিতে পারেন।
গ.ছেলেসন্তান মহিলাদের সাথে সাত বছর এবং মেয়েসন্তান বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত মহিলার সাথে থাকতে পারবে।
ঘ. আইনগতভাবে মুসলিম মহিলারাও নির্দিষ্ট কিছু কারণে স্বামীকে তালাক দিতে পারবে। যেমন- প্রথমত, স্বামী নিরুদ্দেশ হলে : চার বছর যাবৎ স্বামী নিরুদ্দেশ হলে স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আদালতের ডিক্রি
পেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, ভরণপোষণে ব্যর্থ হলে : কোন স্বামী যদি তার স্ত্রীকে তিন বছর পর্যন্ত ভরণপোষণ না দেয় তবেই স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিতে পারে।
তৃতীয়ত, স্বামীর কারাবরণ : সাত বছর কিংবা তদূর্ধ্ব সময়ব্যাপী স্বামী কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে সেক্ষেত্রে স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদের জন্য ডিক্রি লাভের অধিকারী হবে।
চতুর্থত, স্বামীর পুরুষত্বহীনতা : স্বামীর পুরুষত্বহীনতা হানাফী আইন অনুসারে বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হিসেবে গৃহী হবে। তবে স্ত্রীকে প্রমাণ করতে হবে যে, বিবাহের সময়ে স্ত্রী এ বিষয়ে জ্ঞাত ছিল না।
পঞ্চমত, স্বামীর পাগলামি : স্বামী দু’বছর যাবৎ পাগল থাকলে বা কুষ্ঠরোগে অথবা ভয়ানক ধরনের কোন ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদের ডিক্রি পাওয়ার অধিকারী হবে।
ষষ্ঠত, নিষ্ঠুর আচরণ : নিয়মিত যদি স্বামী স্ত্রীর উপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালাতে থাকে, তবে এ অবস্থায় স্ত্রীর বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার আছে।
সপ্তমত, স্বামীর অসৎ চরিত্র : স্বামী যদি এমন জীবনযাপন করে থাকে যা সমাজের চোখে ঘৃণা বা হেয় প্রতিপন্ন হয়, তাহলে স্ত্রী এসব কারণে বিবাহবিচ্ছেদের ডিক্রি পেতে পারে। উপর্যুক্ত কারণে একজন স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার লাভ করতে পারে।
৩. সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইন : নিম্নে উত্তরাধিকার আইনে নারীর সম্পত্তির অধিকার বর্ণনা করা হলো :
ইসলামি আইনে সম্পত্তির অধিকার :
ক. যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান অর্থাৎ পুত্র, কন্যা বা পৌত্র, পৌত্রীর একজনও থাকে তবে মা মৃত ব্যক্তির সম্পূর্ণ সম্পত্তির এক-ষষ্ঠাংশ অংশ পাবেন।
খ. যদি মৃত ব্যক্তির পুত্র, কন্যা, পৌত্র, পৌত্রী কেউ না থাকে, তবে মা সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ পাবেন।
গ. যদি মৃত ব্যক্তির পুত্র, কন্যা, পৌত্র, পৌত্রী,. কেউ না থাকে, তবে স্ত্রী ও মাতাপিতা সম্পত্তির ওয়ারিশ হবে। এক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রীর অংশ দেয়ার পর যা থাকবে তার এক-চতুর্থাংশ মা পাবেন।
ঘ. মৃত স্বামীর পুত্র, পৌত্রাদি না থাকলে স্ত্রী এক-চতুর্থাংশ পাবে।
চ. স্বামীর পুত্র, পৌত্রাদি থাকলে স্ত্রী এক-অষ্টমাংশ সম্পত্তি পাবে।
ছ. এক কন্যা থাকলে এবং পুত্র না থাকলে সে অর্ধেক সম্পত্তি পাবে।
ছ.দুই বা ততোধিক কন্যা থাকলে এবং কোন পুত্র না থাকলে তারা মোট সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ পাবে।
জ. কন্যার সাথে পুত্র থাকলে কন্যার অংশ কমে আসবে এবং প্রত্যেক পুত্র কন্যার দ্বিগুণ অংশ পাবে।
ঝ. মৃত ব্যক্তির পুত্র, কন্যা, পৌত্রাদি কিছু না থাকলে মাত্র একজন বোন থাকলে সে সম্পত্তির অর্ধ অংশ পাবে।
ঞ. একাধিক বোন থাকলে তারা দুই-তৃতীয়াংশ পাবে।
হিন্দু আইনে নারীর সম্পত্তির অধিকার : হিন্দু আইনে নারীর সম্পত্তির অধিকারসমূহ নিম্নরূপ :
১. ১৯৩৭ সালে সম্পত্তিতে হিন্দু নারীর অধিকার সংক্রান্ত আইন পাস হওয়ার পর হতে বিধবা, একের অধিক বোন হলে সবাই একত্রে এক পুত্রের সমান অংশ জীবন স্বতে পাবে।
২.কন্যার মধ্যে অবিবাহিত কন্যার প্রথম দাবি। পরে পরবর্তী কন্যা অথবা পুত্র সম্ভাব্য কন্যাদের দাবি। বন্ধ্যা, পুত্র সন্তানহীনা, বিধবা কন্যা এবং যেসব কন্যার কেবল কন্যাসন্তান আছে তারা উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত।
৩. হিন্দু আইনে পিতা বর্তমান থাকলে মাতার কোন সম্পত্তির অধিকার নেই।
খ্রিস্টান আইনে নারীর সম্পত্তির অধিকার : এ আইনে মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকলে বিধবা দুই-তৃতীয়াংশ সম্পত্তি পাবে এবং বাকি এক-তৃতীয়াংশ সন্তানরা পাবে। এ আইনে মৃতব্যক্তির কোন সন্তান সন্ততি না থাকলে এবং তার উক্ত সম্পত্তির মূল্য যদি পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে হয়, তবে বিধবা সমস্ত সম্পত্তি পাবে। আর যদি সম্পত্তির মূল্য পাঁচ হাজার টাকার বেশি হয়, তবে বিধবা পাঁচ হাজার টাকা মূল্যেরও সম্পত্তি পাবে এবং বাকি অংশেরও অর্ধেক পাবে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বিভিন্ন ধর্মে নারীর আইনগত অধিকারে অসংগতি আছে। এ ব্যাপারে অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের পরিবর্তিত আইন অনুসরণ করলে কিছুটা বৈষম্যের লাঘব হতে পারে। আর সমাজের কর্তব্য হলো এসব আইন বাস্তবায়নের দায়িত্ব গ্রহণ। নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে নারী-পুরুষের সমঅধিকার নিশ্চিত করতে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%80%e0%a6%b0-%e0%a6%85/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*