বাংলাদেশের টিভি নাটকে নারীদের গতানুগতিক ভূমিকাকেই তুলে ধরা হয়- তুমি কি এর সাথে একমত? আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের টিভি নাটকে নারীদের কিভাবে উপস্থাপন করা হয় আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের টিভি নাটকে নারীর উপস্থাপন সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের টিভি নাটকে নারীদেরকে কিভাবে উপস্থাপন করা হয়? এ সম্পর্কে বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বাংলাদেশে টেলিভিশন অত্যন্ত শক্তিশালী গণমাধ্যমরূপে স্বীকৃত। কারণ টেলিভিশন একই সঙ্গে দেখা এবং শোনার কাজটি ঘটে থাকে সে সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে এত বক্তব্য প্রচারিত হয়ে থাকে। এছাড়া বিনোদনের উপকরণের অভাবের দরুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান এক বিরাট বিনোদনের খোরাক। এর মধ্যে
নাটকের দর্শক সংখ্যা অপেক্ষাকৃত বেশি কেননা নাটক অনেকক্ষেত্রে দর্শকের কাছে চলচ্চিত্রের পরিপূরক হিসেবে চিহ্নিত বাংলাদেশের টিভি নাটকে নারীদের কি ধরনের ইমেজ ফুটিয়ে তোলা হয় বা নারীদের কিভাবে উপস্থাপন করা হয় সেটা আলোচনা করাই এ প্রশ্নের উদ্দেশ্য। নিম্নে তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো :
টিভি নাটকে নারীর উপস্থাপন : টিভি নাটকে নারীকে কিভাবে তুলে ধরা হয় সে সম্পর্কে নিম্নে বর্ণনা করা হলো :
ক. বিত্তশালী উচ্ছৃঙ্খল নারী : নাটকে প্রতিফলিত বিত্তশালী ঘরের মেয়েরা সাধারণত কি ধরনের হয়? এখানে দেখানো হয় উচ্ছৃঙ্খল, প্রাচুর্যের মোহগ্রস্ত, খেয়ালি, মধ্যবিত্তের প্রতি ঘৃণা বিত্তশীল নারীর প্রকৃতি। ধরেই নেওয়া হয় প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হওয়া নারী এ চরিত্রের হবে। তাই প্রায়ই টেলিভিশনের নাটকে এমনটি দেখা যায়। অথচ সব বিত্তশীল শ্রেণীর নারীই যে এমন নয় তা উল্লেখ করা হয় না।
খ. মধ্যবিত্ত মায়ের চরিত্র : মধ্যবিত্ত মায়ের চরিত্র আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। এ ধরনের চরিত্র শান্তি রক্ষায় অগ্রণী, সমঝোতায় আসার প্রয়াসী অর্থাৎ একটি সুবোধ চরিত্র। এদের মাতৃত্বকে তুলে ধরা হয় অর্থাৎ এদের স্নেহময় মা হিসেবে গতানুগতিক ভূমিকায় তুলে ধরা হয় যারা মাতৃত্বের সুষমমণ্ডিত। দেখানো হয় সন্তান, স্বামী, সংসারই তাদের *সবকিছু। সংসারে তাদের প্রধান ভূমিকা দেখানো হয় রান্নাবান্না করা।
গ. আদর্শ নারী • নাটকে সাধারণত এমনভাবে অঙ্কন করা হয় যে, নারী যতই বিত্তশীল শ্রেণীর রূপে, গুণে অনন্যা, আত্মমর্যাদাশীল, ব্যক্তিত্ববান হোক না কেন একটা পর্যায়ে তারা পুরুষের কাছে সমর্পিত হবেই । বিয়ের পর নারী স্বামীর ঘর এবং মর্যাদার সঙ্গে খাপখাইয়ে নিতে চেষ্টা করে এবং সে শ্রেণীভুক্ত হওয়াও সে শ্রেণীর মূল্যবোধের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার চেষ্টা করে। এটাই উচিত বলে মনে করা হয়। এ ধরনের নারীকে ‘আদর্শ নারী’ বলা হয়। এর বিপরীত হলেই সে নারী সমাজের চোখে ‘আদর্শ’ নয়। নারীকে শুধু স্বামীই নয়, শ্বশুরবাড়ির সকলের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়। এজন্য নারীকে পুরুষের পক্ষ থেকে অনেক অপমানজনক বাক্যও হজম করতে হয় কষ্ট করে।
ঘ. সর্বংসহা নারী : নারীরা সবকিছু নীরবে সহ্য করে অর্থাৎ সে সর্বংসহা এ রকম চরিত্র নাটকে দেখানো হয়। যেমন- রাবেয়া খাতুনের নাটক ‘শেষ চিঠি’ তে নারীর এরূপ ইমেজ দেখানো হয়েছে। এ নাটকে স্বামী স্ত্রীকে উপরে উঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। স্ত্রী সব নীরবে সহ্য করে, বাপের বাড়ি জানায় না। পরে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। অর্থাৎ নারীকে ধরিত্রীর মত সর্বংসহা মনে করা হয়।
ঙ. নারীর সতীত্ব : সতীত্বই জীবনের সবকিছু এ ধরনের একটা চিত্র নাটকে ফুটিয়ে তোলা হয়। এটা নারীর জীবনে অমূল্য সম্পদ। সতীত্ব হারালে তার আর কিছুই থাকবে না। গণমাধ্যম টেলিভিশন এ বক্তব্যের প্রতি তার সহায়ক ভূমিকা সবল রাখে। কিন্তু এটা প্রচারিত হয় না যে, দুর্ঘটনা সবসময়ই দুর্ঘটনা। সুতরাং একে গ্রহণ করে নেওয়ার মত মানসিকতা নারী-পুরুষ তথা সমাজের সকলের মধ্যেই সৃষ্টি করা উচিত। এজন্য নারীর জীবন বৃথা হয়ে যাবে এটা প্রচার করা উচিত নয়।
চ. অসহায়, দুর্বল নিষ্ক্রিয় নারী : নাটকে নারী চরিত্র শুধুমাত্র অবলা, দুর্বল এবং পুরুষের উপর নির্ভরশীল। চলচ্চিত্রের মত টেলিভিশন নাটকেও নারীকে ‘যৌন আবেদনময়ী’ চিত্রায়নের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। নারীকে চিত্রায়ন করা হয় গৃহবধূরূপে যাদের বেশিরভাগই রান্নঘরে ব্যস্ত, নিষ্ক্রিয়রূপে গল্প করা, স্বামীর সঙ্গে কথা বলা ছাড়া অন্য কাজ নেই; কর্মঠ নারীর চরিত্র কম দেখানো হয়। ত্যাগী গৃহবধূর প্রদর্শন হচ্ছে প্রাধান্যশীল। সব ক্ষেত্রেই দেখানো হয় যে পুরুষ নারীর তুলনায় শ্রেষ্ঠ । এটা নারীর ভূমিকার বিকৃত ব্যাখ্যা বলা যায়। নাটকগুলো বেশিরভাগই পুরুষমুখী ।
ছ. সংগ্রামী নারীর চিত্রায়ন কম : নাটকে নারীকে মা, গৃহবধূ, প্রেমিকা, সতী সাধ্বী, স্বামীর প্রতি নিবেদিতপ্রাণ, সমর্পিতা ইত্যাদিরূপে চিত্রায়িত করা হয়। আর পুরুষকে সবসময় শ্রেষ্ঠ, ব্যক্তিত্ববান, সৎ, কর্তৃত্ববাদী, দায়িত্বপরায়ণ, বুদ্ধিমান হিসেবে দেখানো হয়। অন্যদিকে, নারীর জন্য পজিটিভ দিকগুলো যেমন- কর্মঠ নারী, ব্যক্তিত্বসচেতন, দায়িত্বপরায়ণ, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা, সংগ্রামী নারীর চিত্রায়ন নাটকে খুব কম। এটা হচ্ছে নারী ও সমাজচিত্রের একটি নেগেটিভ দিক।
জ. প্রেমিকা হিসেবে নারী : নাটকগুলোতে নারীর প্রেমিকা রূপকেও প্রাধান্য দেখা হয়। যেখানে পুরুষকে ভালোবাসাই তার প্রধান কাজ। এক্ষেত্রে বিটিভি-তে প্রচারিত ‘প্রতিশ্রুতি’ নাটকের উদাহরণ দেওয়া যায়। এখানে ‘বৃষ্টি’ আরিফ তাকে ভালোবাসে না তবুও নামক চরিত্রটি দেখানো হয়েছে যেখানে সে আরিফ নামে একটা ছেলেকে ভালোবাসে,
‘বৃষ্টি’ আরিফকে’ভালোবাসে। নাট্যকার এখানে দেখাতে চেয়েছেন যে, নারীরা ভালোবেসেই তৃপ্ত, প্রতিদানে কি পাচ্ছে সেদিকে নজর দেয় না। বাংলাদেশে প্রচারিত টিভি নাটকগুলোতে নারীদের গতানুগতিক ভূমিকাই তুলে ধরা হয় অর্থাৎ নারীদের পজিটিভ চিত্রায়নের চেয়ে নেগেটিভ চিত্রায়নই বেশি করা হয়। তাই আমি “বাংলাদেশের টিভি নাটকে নারীদের গতানুগতিক ভূমিকাকে তুলে ধরা হয়”—এ মতবাদের সাথে একমত পোষণ করি।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, যে, গণমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশন যেহেতু মূল্যবোধের পুনরুৎপাদনকারী হিসেবে আমাদের কাছে উদ্ভাসিত, যে মূল্যবোধ নির্যাতনের পরিচয় বহন করে। সুতরাং বিকল্প মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত, প্রচলিত করার জন্য বিকল্প দিকনির্দেশনার প্রয়োজন। আর সে প্রয়োজনেই সচেতন নারীসমাজকে গণমাধ্যমের এ বিশেষ দিকটি সম্পর্কে উৎসাহিত করতে হবে এবং এগিয়ে আসতে হবে। গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষকেও সচেতন করতে হবে যাতে তারা নারীর নেগেটিভ ইমেজ প্রচার না করে। টেলিভিশনে যদি নারীর ইতিবাচক চিত্রায়ন করা হয় তাহলে সমাজে নারীর প্রতি মানুষের মনোভাব পরিবর্তন হবে এবং একটি জেন্ডার সংবেদনশীল সমাজ গড়ে উঠবে।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*