বাংলাদেশের গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর প্রকৃতি বা স্বরূপ বিশেষণ কর।

অথবা, গ্রামীণ বাংলাদেশে বিরাজমান ক্ষমতা কাঠামোর চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য উল্লেখ কর।
অথবা, বাংলাদেশের গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর প্রকৃতি আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর স্বরূপ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাংলাদেশের গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর প্রকৃতি বর্ণনা কর।
উত্তর ভূমিকা :
ক্ষমতা কাঠামো একটি ব্যাপক ধারণা। বিরাজমান আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় মানুষ সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণের প্রেক্ষিতে যে ক্ষমতার ধরন বন্টন দেখা যায়, তাকে বলা হয় ক্ষমতা কাঠামো। গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো।বলতে আমরা প্রধানত বুঝে থাকি, যে ব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রামের মানুষের অধিকার ও শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐতিহ্যগতভাবেই গ্রাম পর্যায়ে বাংলাদেশে বৃহৎ ভূমি গোষ্ঠী গ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে থাকে এবং তারাই গ্রামে ক্ষমতার প্রয়োগ করে আসছে।
গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর স্বরূপ : গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোকে আমরা দুটি দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করতে পারি।একটি নার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং অপরটি ম্যাক্স ওয়েবারের দৃষ্টিভঙ্গি। মার্কসীয় ধারণাতে (Marxist perspective) গ্রামীণ সমাজে উদ্ভূত শ্রেণিসমূহের অবস্থান ও পারস্পরিক সম্পর্ক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে শ্রেণিসমূহের ভূমিকা প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণ সমাজে সামাজিক শক্তিসমূহ যে কাঠামোর মধ্য দিয়ে বিকশিত হয় তাকেই গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো বলে।
অপরদিকে, ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, (Weberian perspective) গ্রামীণ উৎপাদন যন্ত্রে, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থাকে এবং কিভাবে কর্তৃত্ব স্থাপন ও প্রভাব বিস্তার করবে তার সমন্বয়ই হচ্ছে গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো। অন্যতম জার্মান সমাজবিজ্ঞানী
ম্যাক্স ওয়েবার ক্ষমতাকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, “সহজভাবে বললে দাঁড়ায় যে, নিজের ইচ্ছা অপরের উপর চাপিয়ে দেয়ার ব্যাপারটিই ক্ষমতা।” […the possibility of imposing one’s will upon the behaviour of other persons.]ওয়েবারের আলোচনা হতে আমরা তিন ধরনের ক্ষমতার কথা বলতে পারি। এগুলো হচ্ছে Legal বা আইনভিত্তিক,Traditional বা গতানুগতিক এবং Charismatic বা অতীন্দ্রিয়। আইনভিত্তিক ক্ষমতা কাঠামোয় আনুগত্য আইনের প্রতি,কোনো ব্যক্তির প্রতি নয়।দ্বিতীয় প্রকরণ গতানুগতিক কর্তৃত্বের ভিত্তি হচ্ছে বংশানুক্রমিক ক্ষমতা। আমরা এদেশের গ্রামাঞ্চলে মাতব্বর মোড়লদের ইচ্ছানির্ভর কর্তৃত্ব পরায়ণতার কথা জানি। এখানে নির্বাচনের অবকাশ নেই, একজন মোড়ল নির্বাচিত হন না,বংশানুক্রনে ক্ষমতা লাভ করেন। গ্রামীণ সমাজের ক্ষমতা কাঠানো বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে গতানুগতিক কর্তৃত্ব (Traditional authority) প্রত্যয় খুবই প্রাসঙ্গিক। কারণ গ্রামাঞ্চলে এখনও প্রতাপশালী জোতদার নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী তৈরি করে থাকে।তৃতীয় প্রকরণ Charismatic বা অতীন্দ্রিয় ক্ষমতানির্ভর কর্তৃত্ব অসম সাহসিকতা, জাদুকরি ক্ষমতা ইত্যাদি। অর্থাৎ পীর ফকিরদের তাদের অনুগতদের উপর যে প্রভাব ও কর্তৃত্ব থাকে তা মনে করে দেয়।গ্রামীণ সমাজের ক্ষমতা সম্পর্ক তথা রাজনৈতিক কাঠামো বিশ্লেষণের জন্য নিম্নোক্ত প্রত্যয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ :
১. অন্তর্ভুক্তকরণ, ২. দলাদলি, ৩. মক্কেল-নাতব্বর বা মুরুব্বি সম্পর্ক এবং ৪. শ্রেণি সম্পর্ক।
নিম্নে প্রত্যয়গুলো পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হলো
১. অন্তর্ভুক্তকরণ : গ্রামীণ কৃষক সমাজ বৃহৎ রাষ্ট্রীয় সমাজের একটি অংশ। গ্রামাঞ্চলে সম্পত্তি ব্যবস্থা বিশেষ করে ব্যবস্থা রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ও রূপায়িত হয়। এমনকি সামগ্রিক প্রাতিষ্ঠানিক আইন তৈরি হচ্ছে রাষ্ট্র কর্তৃক। অবশ্য বামীণ মূল্যবোধ, আচার আচরণ প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে। আপাতদৃষ্টিতে অন্তর্ভুক্তকরণের কারণে গ্রাম সমাজের স্বাতন্ত্র্য বা নিজস্বতা নেই। প্রকৃতপক্ষে, এ স্বাতন্ত্রের মাত্রা এতটাই বেশি হয় যে, অনেক সময় মনে কৃষক সমাজ রাষ্ট্র সমাজ থেকে বিচ্ছিন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৮৭ সালে ভারতের রাজস্থান প্রদেশে গভীদাহের একটি ঘটনা ঘটে। অথচ ভারতে সরকারিভাবে সতীদাহ প্রথা অনেক আগেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সমাজ গ্রামীণ সংস্কৃতি, মূল্যবোধকে প্রভাবিত করতে পারেনি।আসলে Little Community (গ্রাম বা কৃষক সমাজ) ও Large Community (রাষ্ট্র ও জাতি) কতটা সম্পৃক্ত হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিমাপ নেই। তথাপি বলা যায়, এ দুই অস্তিত্বের একাধিক সংযোগ সূত্র (Mediating points) আছে। বাংলাদেশের থানা প্রশাসন এ সংযোগের অন্যতম ক্ষেত্র। তাছাড়া ইউনিয়ন পরিষদও প্রতিনিধিত্বমূলক ভূমিকা পালন করে। এ সংযোগ গ্রামীণ অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি সবক্ষেত্রেই অন্তর্ভুক্তকরণের প্রক্রিয়া কার্যকর করে।
২. দলাদলি : কৃষক সমাজের উপর বিশিষ্ট লেখক হামজা আলাভি দল বা Faction এর গুরুত্ব গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো বা রাজনীতিতে এভাবে প্রকাশ করেছেন, “কৃষক সমাজে রাজনৈতিক কর্মতৎপরতার প্রেক্ষিতে দলাদলির গুরুত্ব অপরিসীম। দলের প্রধান হচ্ছে ক্ষমতাবান ব্যক্তিত্ব বা স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। এসব নেতাদের দলীয় অনুসারী হচ্ছে ভূমিহীন শ্রমিক, প্রান্তিক কৃষক, বর্গাদার বা অন্যান্য দুর্বল শ্রেণির লোকজন। এ দল আদর্শ নিয়ে নয়, বরং
সম্পদ, মর্যাদা, ক্ষমতা ইত্যাদি নিয়ে প্রতিযোগিতার প্রেক্ষিতে তৈরি হয়।মূলত গ্রামীণ ক্ষমতাবানদের দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে দলের আবির্ভাব এবং দরিদ্র লোকজন হলো দলের অপরাপর সদস্য।তবে দলের সংখ্যা গ্রামভেদে কমবেশি আছে। দলগুলো প্রাথমিকভাবে পাড়ানির্ভর সমাজকে ঘিরে তৈরি হয় এবং সমাজের মাতব্বর দলের প্রধান হিসেবে থাকে।
৩. দাতা-গ্রহীতা বা মক্কেল-মাতব্বর সম্পর্ক : গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর স্বরূপ বিশ্লেষণের জন্য মক্কেল মুরুব্বি সম্পর্ক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। ইংরেজি Patron হচ্ছে, “…a person of power, status, authority and influence.” অর্থাৎ ক্ষমতাবান, মর্যাদাসম্পন্ন কর্তৃত্বপরায়ণ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিই দাতা বা মুরুব্বি হতে পারেন। পীর-আউলিয়ারা তাঁদের মুরিদদের সহযোগিতা করে থাকে। বিনিময়ে তাঁরা পায় রাজনৈতিক সমর্থন বা অন্য কোনো ধরনের উপকার। দাতা-গ্রহীতা সম্পর্ক সে জাতীয় সমাজগুলোতেই বিকাশলাভ করে বেশি, যেখানে সামাজিক বৈষম্য বেশ ব্যাপক।
অর্থনৈতিক সম্পদ, রাজনৈতিক ক্ষমতা, শিক্ষা ইত্যাদি অসমভাবে বণ্টিত। একই সাথে সমাজগুলোর বাইরের সাথে সম্পর্ক
তুলনামূলকভাবে ক্ষীণ। অর্থনৈতিক চাপ বেশি হলে, নিরাপত্তার অভাব দেখা দিলে, মক্কেল-মুরুব্বি সম্পর্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। একটি গ্রামে যদি সামাজিক সচলতা (Social mobility) কম থাকে, তবে এ সম্পর্কের বিস্তৃতি ঘটতে পারে।আমাদের দেশে জমিদারি প্রথাকে নিম্নবর্গ কৃষকের কাছ হতে জোর করে আনুগত্য আদায় করা হয়েছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের লুপ্তপ্রায় জোতদার প্রথার কথা উদাহরণস্বরূপ বলা যায়। দরিদ্র কৃষক জমি, ঋণ ইত্যাদি পেয়েছে জোতদারের কাছ হতে কিন্তু সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছে এক পর্যায়ে, আর প্রতিবাদ করলে অত্যাচারের মাধ্যমে তা থামিয়ে দেয়া হয়েছে।
৪. শ্রেণি সম্পর্ক বা শ্রেণি সংহতি : অনেকে মনে করেন যে, আমাঞ্চলের লোকজন অর্থাৎ কৃষকরা অশিক্ষিত তাই নিজস্ব স্বার্থ সম্পর্কে অসচেতন, কিন্তু বিষয়টি এতটা সরল নয়। কারণ বাংলাদেশেই অতীতে একাধিকবার কৃষক অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে।ধারণা করা হয়, কৃষিব্যবস্থায় আধুনিকীকরণের ফলে গ্রামাঞ্চলে শ্রেণি চেতনার পরিবর্তন ঘটেছে এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে শ্রেণিভিত্তিক গোষ্ঠীবদ্ধতার গুরুত্ব পেয়েছে। Hamza Alavi, T. J. Byres, James C Scott বিবিধ লেখক বিভিন্ন সমাজের প্রেক্ষিতে এ শ্রেণিভিত্তিক গোষ্ঠীবদ্ধতার উপাদান লক্ষ্য করেছেন। ভূমিহীন বা প্রান্তিক কৃষক অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছে যে, বস্তুগত স্বার্থের ভিন্নতা থাকলে রাজনৈতিকভাবে গোষ্ঠীবদ্ধ হওয়াটা মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয়।বিশিষ্ট লেখক টেরিবারার্স ভারতে সবুজ বিপ্লবের প্রেক্ষিতে গ্রামীণ রাজনৈতিক চেতনার উপর আলোকপাত করেন।রাজনৈতিক গোষ্ঠীবদ্ধতাও অনেকটা শ্রেণি চরিত্রের ভিত্তিতে হয়েছে। বিশেষ করে কৃষি প্রযুক্তির দিক থেকে অগ্রসর সমাজে কৃষকদের মধ্যে শ্রেণি দূরত্ব বেড়েছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত সংজ্ঞার আলোকে বলা যায়, গ্রামীণ ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের উৎস হিসেবে আমরা বংশমর্যাদা,কৌলীন্য, অর্থনৈতিক ক্ষমতা, লোকবল, রাজনৈতিক সংযোগ ইত্যাদিকে চিহ্নিত করতে পারি। এ বিভিন্ন উপাদান আবার পরস্পরের সাথে সংযুক্ত। গ্রামীণ কৃষক সমাজে পুঁজিবাদী উন্নয়ন সম্প্রসারিত হলে অর্থনৈতিক ক্ষমতা কর্তৃত্বের উৎস হিসেবে বিশেষভাবে কার্যকর হয়। একজন অর্থবান লোকের বংশগত কৌলীন্য না থাকলেও কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে বা রাজনৈতিক ক্ষমতার দিক থেকে তা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং বলা যায় যে, অর্থনৈতিক ক্ষমতা এক পর্যায়ে বংশ কৌলীন্য যুক্ত করে। তাই গ্রামের কৃষক সমাজে পুঁজিবাদী সম্পর্ক বিস্তৃতি লাভ করলে ক্ষমতা ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বের প্রেক্ষিতটি নতুন মাত্রায় পরিচালিত হয়।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*