প্রাচীন বাংলার গ্রামের বৈশিষ্ট্য কি ছিল? আলোচনা কর।

অথবা, প্রাচীন বাংলার গ্রামের প্রকৃতি কেমন ছিল? আলোচনা কর।
অথবা, প্রাচীন বাংলার গ্রামের বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধর।
অথবা, প্রাচীন বাংলার গ্রামের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যা জান তা সবিস্তারে তুলে ধর।
উত্তরা৷ ভূমিকা :
মানব ইতিহাসের প্রথম দিকের ঘটনাগঞ্জি এত অস্পষ্ট এবং ক্ষেত্রবিশেষে ছিন্নভিন্ন যে, এগুলোকে জোড়া দিয়ে কেবল একটি অনুমান দাঁড় করা যায়। তাই সমাজবিজ্ঞানীরা প্রায়ই বলে থাকে যে, সময়ের আবর্তনে মানুষ ঠিক কোন সময়ে এবং কোন পরিস্থিতিতে স্থায়ীভাবে এক জায়গায় বাস করতে আরম্ভ করল এবং সে বসত কালক্রমে কিভাবে গ্রাম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল, এর কোন সঠিক দলিল নেই। তবে অনুমান করা হয় যে, সে সূচনাপর্বে মানুষ যখন গুহা ছেড়ে বেরিয়ে আসে, তখন তাঁর চিন্তাশীল মন দিয়ে নিজের আশ্রয়টি গড়ে তুলেছে। ছোট ছোট দলভুক্ত মানুষ যখন প্রায় স্থায়ীভাবে কৃষিকাজ করতে আরম্ভ করল, তখন বসতি গ্রামরূপে দেখা দেয়। প্রাচীন বাংলার গ্রামের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of the village of Ancient Bangla) : গ্রামীণ
বাংলাদেশের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য কিছু প্রাচীন গ্রামের সন্ধান পাওয়া যায়। এস্ব গ্রামসমূহের কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান যা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. বস্তিস্থান (Site) : সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ উঁচু ভূমিতে তার বসতি গড়ে তোলার প্রয়াস পায়। এর মূল কারণ বন্যা প্রতিরোধ করা। অন্যদিকে, নিম্নভূমি উঁচু করার জন্য তারা মাটি খুঁড়ে পুকুর তৈরি করেছে। পুকুর থেকে তারা পানি ও মাছের যোগান পেয়েছে। বাস্তস্থানকে বাসযোগ্য বা উপযোগী করে তোলার জন্য তারা আলো বাতাসের প্রয়োজনীয়তা টিকেও মাথায় রাখত বলে জানা যায়। এছাড়া এ সময় রাজা বা ধনশালীরা বড় আকারের দীঘি খনন করত। বাড়িগুলো নির্মাণ করা হতো দক্ষিণমুখী। কৃষিকাজের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজন হলো জল এবং এজন্যই সমৃদ্ধ করেছে কৃষিকাজকে। তাই দেখা যায় প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত গ্রামগুলোর অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে বিশাল কোন জলাশয়ের কাছে অথবা নদনদী, খালবিলের কাছে।
২. গ্রামের সীমানা ও আয়তন (Boundary & area of the village) : প্রাচীন কালে নদী, পাহাড়, সেতুবন্ধ উঁচু আইনের বেষ্টনী) প্রভৃতি প্রাকৃতিক অবয়বকে ঘিরে গ্রামের সীমা নির্ধারিত হতো। অধিকন্তু রাস্তাঘাট, মাঠ ইত্যাদির প্রেক্ষিতেও গ্রামের সীমা নির্ধারিত হতে দেখা যায়। গ্রামগুলোর আপেক্ষিক আয়তন সম্পর্কে প্রাচীন লিপিতে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। যেমন- রাজা লক্ষ্মণসেনের তর্পনদীঘি লিপিতে বিক্রমপুর অন্তর্গত বেলহিষ্ঠী গ্রামের আয়তন উল্লেখ করা হয়েছে। গ্রামের আলপথে ছিল জঙ্গল। গ্রামের চারপাশে ছিল ধানক্ষেত ও বাঁশঝাড়। এ বন ও বাঁশ গ্রামে সহজলভ্য ছিল বলে গ্রামীণ সভ্যতার অবদানে বাঁশ ও বেতের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি।
৩. গ্রামের আকার (Size of the village) : কৌটিল্য এর মতে, “একশ থেকে পাঁচশ কৃষক পরিবার নিয়ে দুই ক্রোশব্যাপী সীমানায় গ্রামের পত্তন হবে।” আপস্তম্ভ ধর্মশাস্ত্র অনুসারে দু’তিন ঘর থেকে আরম্ভ করে যে কোনো সংখ্যক বাড়ি নিয়ে একখানা গ্রাম গড়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশের তেঘরিয়া, পাঁচঘরিয়া, সাতঘরিয়া প্রভৃতি গ্রামের নাম এ ধরনের গ্রাম
বিন্যাসের সাক্ষ্য বহন করে। বাস্তুভিটা ও ক্ষেত্রভিটা ছিল সব গ্রামেরই প্রধান অঙ্গ। প্রাচীন লিপিগুলো সাক্ষ্য দেয় প্রত্যেকটি গ্রামেরই উর্বর ভূমি, গর্তভূমি, তলভূমি, গোচারণভূমি, ইট্ট, হাট্ট, বিপনি, গোপট, গোপাট, পুষ্করিণী ও গোপথ ছিল।
৪. রাজনীতিক ও অর্থনীতিক কাঠামো (Political & economic structure) : প্রাচীন গ্রামগুলো সামগ্রিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বনির্ভর ও স্বভোগী ছিল অর্থাৎ, গ্রামবাসীদের প্রয়োজনের প্রায় সবকিছুই নিজেরা উৎপাদন করত। বাইরের সথে সম্পর্ক স্থাপনে তারা ছিল স্বাধীন। যেসব গ্রামের অবস্থান ছিল কোন গুরুত্বপূর্ণ রাজপথ বা প্রশস্ত নদীর কিনারে,
সেসব গ্রাম রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত, সেসব গ্রামে সরকারি কোন আমলার স্থায়ী দফতরও থাকা বিচিত্র ছিল না।
৫. ভূমির স্বত্ব (Land tenureship) : প্রকৃতিপ্রদত্ত সম্পদ ভূমিকে নিয়েই ভূমির স্বত্বাধিকার উৎপত্তি হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ভূমির স্বত্ব ছিল গোষ্ঠীগত। প্রথা অনুযায়ী সমস্ত জমিই ছিল সমাজের। অর্থাৎ, ভূমিতে কোন ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। এ প্রসঙ্গে ব্যাডেন পাওয়েল বলেছেন, “কর্ষিত জমির এক তৃতীয়াংশের উপর গোষ্ঠীগত মালিকানা থাকলেও দুই তৃতীয়াংশের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা প্রযোজ্য ছিল।” কার্ল মার্কসের মতেও বৃহত্তর ভারতের গ্রামের জমি প্রধানত যৌথ মালিকানায় ভোগ করা হতো। বাস্তুভূমি, খিলভূমি এবং ক্ষেত্রভূমি এ তিনটি পর্যায়ে প্রাচীন গ্রামের ভূমির বিন্যাসে বিদ্যমান ছিল।
৬. গ্রামের বৃত্তি (Occupation of the village) : প্রাচীন কালের গ্রামগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় এক এক বৃত্তি আশ্রয় করে সমশ্রেণির লোকদের নিয়ে একটি পাড়া গড়ে উঠত। এ ধরনের পাড়া বা গ্রাম প্রাচীন কৌম সমাজেরই দান। প্রাচীন কালে প্রধানত তিন ধরনের গ্রাম পাওয়া যায়। যেমন-
ক. মিশ্রগ্রাম : এ গ্রামের অধিবাসীদের পেশা বা বৃত্তি ছিল মূলত কৃষি। মিশ্রগ্রামকে চাষি গ্রামও বলা যায়
খ. শিল্প গ্রাম : শিল্প গ্রাম বলতে কামার, কুমার, তাঁতি, ছুতার প্রভৃতি শিল্পী বা কারিগরদের (artisan) নিয়ে গঠিত গ্রামকে বুঝানো হয়।
গ. প্রান্তগ্রাম : লোকালয় থেকে অনেক দূরে অবস্থিত গ্রামকে বলা হতো প্রান্তগ্রাম। অনেকে মনে করেন এ ধরনের গ্রাম ছিল অনিশ্চিত ও নিরাপত্তাহীন।
৭. সামাজিক কাঠামো ও এর পারিসরিক বিন্যাস (Social structure & its spatial pattern) : অতীতে উপমহাদেশের গ্রাম তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত ছিল। গ্রামের কেন্দ্র ছিল প্রাচীরবেষ্টিত অবস্থায়। প্রাচীরের বাইরে গ্রামের মানুষ একসাথে জমি চাষ করত। এছাড়া খণ্ডখণ্ড জমি প্রত্যেক পরিবারের জন্য বণ্টন হতো।
উপসংহার : উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, মানুষের প্রাচীন বসতি হচ্ছে গ্রাম। জলাশয় নিকটবর্তীস্থানে প্রাচীন গ্রামগুলো গড়ে উঠেছিল। প্রাকৃতিক ভূদৃশ্যাবলি গ্রামের সীমানা ও আয়তনে ভূমিকা রাখত। এছাড়া কৃষি বা ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল অর্থনৈতিক কাঠামো। এছাড়া ভূমির গোষ্ঠীগত মালিকানা, পেশা বা বৃত্তির বিচিত্রতা প্রভৃতি প্রাচীন
আবাদভূমির সাহায্যে নির্ধারণ হতো গ্রামের আকার। উৎপাদন স্বয়ংসম্পূর্ণতার (Sufficiency of production) উপর
বাংলার গ্রামগুলোতে বিদ্যমান ছিল।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*