পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কি? ইহার বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।

অথবা, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ বলতে কি বুঝ? বাংলাদেশে বিরাজমান পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার
অথবা, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাকে বলে? পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নিয়ামকগুলো আলোচনা কর।
অথবা, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সংজ্ঞা দাও। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্যগুলোর বর্ণনা দাও।
অথবা, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কী? পিতৃতান্ত্রিক সমাজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিবরণ দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বিধাতা আমাদের বসবাসের জন্য সুন্দর এ পৃথিবী সৃষ্টি করে দিয়েছেন। সুন্দর এ মানুষ তার নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন ও রূপান্তর করে নিয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এ কাজে
আরও সুন্দর করে গড়ে তোলার পিছনে রয়েছে মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম। মানুষের কল্যাণার্থে বিধাতা প্রদত্ত সকল জিনিসই নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণকে অস্বীকার করে শুধুমাত্র পুরুষের অবদানকে তুলে ধরার চেষ্টা চলছে এবং তুলে ধরাও হচ্ছে। সমাজব্যবস্থাকে ভাগ করে ফেলা হচ্ছে পিতৃতান্ত্রিক ও মাতৃতান্ত্রিক হিসেবে। কিন্তু প্রাচীন যুগে যখন মানুষ সবেমাত্র পশুপালন ও চাষাবাদ শুরু করেছিল, পুরুষেরা তখন পশুপালন করত আর মেয়েরা ফলমূল সংগ্রহ ও উচ্ছিষ্ট খাবার বসবাসের স্থানের চারপাশে ছড়িয়ে চাষাবাদ আরম্ভ করে। তখনকার সমাজে নারীদের প্রাধান্য থাকলেও ধীরে ধীরে লাঙ্গল, ছিল না। বিজ্ঞানের উন্নয়নের সাথে সাথে নারীরা সমাজে পুরুষের অধস্তন হয়ে পড়ে। বর্তমান পৃথিবীর সামান্য কিছু স্থানে ঢাকা প্রভৃতি আবিষ্কৃত হওয়ার সাথে সাথে এগুলো পুরুষের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। কারণ নারীর পক্ষে এগুলো চালানো সম্ভব মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকলেও তা অত্যন্ত দুর্বলভাবে টিকে আছে।
পিতৃতন্ত্র : পিতৃতন্ত্র শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল পিতা বা পিতৃতুল্য কোন ব্যক্তির কর্তৃত্ব, পিতার ক্ষমতা বা নিয়ন্ত্রণ। পিতা এখানে ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত, শুধু জনক রূপে নয়। প্রথম দিকে পিতৃতন্ত্র বলতে বোঝানো হতো বিশেষ এক পুরুষের আধিপত্যের অধীন পরিবার যে পরিবারে থাকে নারী এবং অন্যান্য কম বয়সী পুরুষ, শিশু, চাকর বাকর, দাসদাসী ইত্যাদি। ব্যাপক অর্থে অনেকে পিতৃতন্ত্রকে অভিহিত করেন পুরুষতন্ত্র বলে। আমাদের চারপাশে দেখা যায় সব ধরনের পুরুষ আধিপত্যই এ ধারণার অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন নারীবাদী তাত্ত্বিকেরা নানাভাবে এ পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্রকে ব্যাখ্যা করেছেন।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক ও নারীবাদী দার্শনিক পিতৃতন্ত্র সম্পর্কে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকজনের সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো :
প্রখ্যাত নারীবাদী মনস্তাত্ত্বিক জুলিয়েট মিচেলের মতে, “পিতৃতন্ত্র এমন একটি সম্পর্কিত ব্যবস্থা যেখানে নারী পুরুষের হাতে বিনিময়ের দ্রব্য মাত্র।” তিনি মনে করেন, এ ব্যবস্থায় পিতার এক প্রতীকী ক্ষমতা থাকে, যে প্রতীকী ক্ষমতাই নারীর হীনম্মন্যতার জন্য দায়ী। ব্যবস্থা যেখানে নারীকে নিয়ন্ত্রণ ও শোষণ করে পুরুষ। অপর নারীবাদী তাত্ত্বিক সিলভিয়া ওয়ালবির বলেছেন, পিতৃতন্ত্র সামাজিক কাঠামো ও রীতিনীতির এমন একটি
নারীর উপর পুরুষের আধিপত্য অনুমোদন করে এবং নারীকে পুরুষের সম্পত্তি বলে গণ্য করে। সুতরাং বলা যায় যে, পিতৃতন্ত্র এমন একটি মতাদর্শ বা পুরুষকে নারীর তুলনায় শ্রেষ্ঠ ও শক্তিশালী বলে মনে করে।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য : পিতৃতন্ত্রের রূপ বা বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন সমাজ এবং ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায় ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। এমনকি সমাজের শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণভেদে নানারকম হয়। কিন্তু পিতৃতন্ত্রের প্রকাশ ও প্রয়োগগত তারতম্য সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী এর মূল মর্মটি অর্থাৎ নারীর উপর পুরুষের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অপরিবর্তনীয় রয়েছে। দাস, সামন্ত, পুঁজিবাদ সকল সমাজব্যবস্থাতেই এ পিতৃতন্ত্র নানাভাবে বহাল রয়েছে। নিম্নে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হল :
১. পুরুষপ্রধান সমাজ : পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য হল পুরুষপ্রধান সমাজ। এ ব্যবস্থায় পুরুষেরাই শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে। তাদের দ্বারাই সবকিছু পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। পারিবারিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রেই পুরুষের প্রাধান্য বিদ্যমান থাকে। এ ধরনের সমাজব্যবস্থায় নারীদের ভূমিকায় কোন গুরুত্বই দেয়া হয় না।
২. বংশ পরিচয় বাবার নামে : পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ছেলেমেয়েদের বংশ পরিচয়ে মায়ের কোন উল্লেখ থাকে না। বাবার বংশ পরিচয়ের দ্বারাই তাদের বংশ পরিচয় নির্ধারিত হয়। সমাজে পিতার সন্তান হিসেবেই তারা পরিচিতি লাভ করে, যা দশমাস দশদিন গর্ভে ধারণ করে এবং জন্মের পর অক্লান্ত পরিশ্রমের দ্বারা তিল তিল করে মানুষ করলেও এক্ষেত্রে তার ভূমিকার কথাটা উহাই থেকে যায়।
৩. নারী বিয়ের পর স্বামীর পরিচয়ে থাকে : পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল বিয়ের পূর্বে নারীরা পিতার তত্ত্বাবধানে থাকে এবং বিয়ের পর সে চলে যায় স্বামীর তত্ত্বাবধানে। এখানে তার নিজস্ব কোন সত্তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। তার নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ বলে কোন কিছু মূল্যায়ন করা হয় না। স্বামীর অনুমতি ছাড়া সে কোন কিছু
পারে না। স্বামী কর্তৃক তার উপর যা কিছু চাপিয়ে দেয়া হয় সে তা করতে বাধ্য থাকে।
৪. সম্পত্তির উত্তরাধিকারে কন্যা পুত্র অপেক্ষা কম পায় : পুত্র এবং কন্যা উভয়েই পিতামাতার সন্তান হওয়া সত্ত্বেও এবং অনেক ক্ষেত্রে পিতামাতার বিভিন্ন ব্যাপারে মেয়েদের অবদান বেশি থাকা সত্ত্বেও সম্পত্তির ক্ষেত্রে তাদের অধিকার তুলনায় কম। যেমন আমাদের দেশে পিতামাতার সম্পত্তি ভাই যতটুকু পাবে বোন পাবে তার অর্ধেক আবার অনেক ক্ষেত্রে তারা এ অর্ধেক অংশটুকুও ভোগ করতে পারে না।
৫. পুত্রসন্তানের আকাঙ্ক্ষা : পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পুরুষের ভূমিকাই যেহেতু মুখ্য, তাই এখানে পুত্র সন্তানের আকাঙ্ক্ষাটাও তীব্র। পুত্রসন্তানকে এখানে ভবিষ্যতের অবলম্বন হিসেবে দেখা হয়। আর এ কারণে অনেক সময় দেখা যায়। যে, কোন নারী যদি পুত্রসন্তান ধারণে অক্ষম হয় তখন তার উপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। অথচ এ অক্ষমতা জন্য নারীরা আদৌ দায়ী নয়।
৬. খাদ্য বণ্টনে মেয়েদের প্রতি বৈষম্য : এ ধরনের সমাজব্যবস্থায় মনে করা হয় যেহেতু ছেলে সন্তানেরাই সমাজের ভবিষ্যত কর্ণধার, তাই খাদ্য বণ্টনের ক্ষেত্রে তাদেরকেই প্রাধান্য দেয়া উচিত। আমাদের সমাজব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য করল আমরা দেখি যে মাছের মুড়োটা মা ছেলের পাতেই তুলে দেন, আর মেয়েদের ভাগ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জোটে হাড়ির
তলার খাবার টুকুন। খাদ্য বণ্টনে এরূপ বৈষম্যের কারণে বেশিরভাগ মেয়েরাই অপুষ্টিতে ভোগে। আর এরই ফলশ্রুতিতে দেখা যায় যে, সন্তান জন্মদানের সময় এসব পুষ্টিহীন মহিলাদের অধিকাংশেরই মৃত্যু ঘটে।
৭. মেয়েদের উপর কেবল পারিবারিক দায়দায়িত্ব চাপানো হয় : পিতৃতন্ত্রে মনে করা হয় যে, গৃহের বাইরে মেয়েদের কোন কাজ থাকতে পারে না। তাদের কাজ কেবল সন্তান লালনপালন আর রান্নাবান্নার মধ্যেই সীমিত। এহেন মানসিকতার ফলস্বরূপ নারীদেরকে এক প্রকার গৃহবন্দী অবস্থাতেই জীবনযাপন করতে হয়।
৮. মেয়েদের শিক্ষার প্রতি অনিহা : পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মনে করা হয় যে, মেয়েরা যতই শিক্ষিত হোক তারা সারা জীবনই স্বামীর সেবা, সন্তান লালনপালন, রান্নাবান্না এবং ঘরসংসার সামলানোর বাইরে কোন দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। তাই দেখা যায় পিতা যতটুকু আগ্রহ নিয়ে তার পুত্রসন্তানটিকে স্কুলে পাঠাচ্ছেন, কন্যাসন্তানটির শিক্ষার ব্যাপারে ঠিক ততটুকুই অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছেন। যার ফলে নারীশিক্ষা ব্যাপারটি থেকে যাচ্ছে অবহেলিত।
৯. নারী নির্যাতন : পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারী নির্যাতন একটি সাধারণ চিত্র। এখানে নারীকে তার প্রতিটি পদক্ষেপ
ফেলতে হয় স্বামীর নির্দেশ অনুসারে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পুরুষেরা নারীকে তার ভোগ্যপণ্য হিসেবে মনে করে তাকে
যথেচ্ছাভাবে ব্যবহার করে থাকে। যৌতুকসহ বিভিন্ন কারণে নারী প্রতিনিয়তই পুরুষের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়ে যাচ্ছে। নারী নির্যাতনের যেসব রূপ লক্ষ্য করা যায় তার মধ্যে ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, হত্যা, পুড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি অন্যতম ।
১০. ‘বহুবিবাহ : পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল বহুবিবাহ। এখানে বিয়ের ব্যাপারে পুরুষের একাধিক বিয়ের সুযোগ থাকলেও নারীদের তা নেই এবং সমাজের দৃষ্টিতে নারীর দ্বিতীয় বিবাহ দৃষ্টিকটু। অথচ পুরুষেরা প্রথম স্ত্রীর অনুমতি না নিয়েই বা জোর করে অনুমতি আদায় করে নির্দ্বিধায় একাধিক বিবাহ করে যাচ্ছে। আর এর ফলে
বৃদ্ধি পাচ্ছে পারিবারিক অশান্তি ও বিবাহবিচ্ছেদ।
১১. গর্ভধারণে নারীর ইচ্ছাকে প্রাধান্য না দেয়া : গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে পুরুষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত থাকে। এক্ষেত্রে নারীর যদি কোন সমস্যা থাকে বা তার ইচ্ছা বা অনিচ্ছা থাকে তাকে গৌণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
১২. তালাকের অধিকার : পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় তালাকের ব্যাপারে স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে কিন্তু স্ত্রীর তালাক দেয়ার অধিকার নেই।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বহুবিধ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্ক রা যায়। এ ব্যবস্থায় সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রে মেয়েরা তাদের প্রাপ্য অধিকার ও স্বাধীনতা খুব কমই ভোগ করতে পারে। মেয়েদের এ অধীনতা আরও প্রকট হয়ে দেখা দেয় যখন একজন নারী রাস্তাঘাট, ঘর,
শিক্ষাক্ষেত্র, অফিস-আদালত সব জায়গায় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%80%e0%a6%b0-%e0%a6%85/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*