নেতৃত্বের সংজ্ঞা দাও। নেতৃত্বের ধরনসমূহ উলেখ কর।

অথবা, নেতৃত্ব বলতে কী বুঝ? নেতৃত্বের শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর।
অথবা, নেতৃত্ব কী? নেতৃত্বের প্রকারভেদ বর্ণনা কর।
অথবা, নেতৃত্ব কাকে বলে? নেতৃত্বের প্রকারভেদ আলোচনা কর।
অথবা, নেতৃত্বের সংজ্ঞা দাও। নেতৃত্বের শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর।
অথবা, নেতৃত্বের ধারণা কী? নেতৃত্বের ধরনসমূহ আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
নেতৃত্ব হচ্ছে সর্বজনবিদিত একটি সামাজিক প্রক্রিয়া যা সমাজস্থ মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে আচার ব্যবহারে কমবেশি নেতৃত্বের ছোয়া প্রতিফলিত হয়। অর্থাৎ মানব আচরণ নেতৃত্ব সম্পন্ন। মানুষের মানবীয় কার্যকলাপের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিকে হিসেবে বিবেচিত হয় নেতৃত্ব। বস্তুত নেতৃত্ব ব্যতিরেকে কোনো সামাজিক এককই তার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারে না।
নেতৃত্বের ধারণা : বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীসহ জ্ঞানের অন্যান্য শাখার অজস্য গবেষক গবেষণা চালিয়েছেন নেতৃত্বের প্রকৃতি ও স্বরূপ নির্ধারণের জন্য। তারা প্রত্যেকেই নেতৃত্বে কোনো না কোনো বিশেষ দিকের প্রতি অধিক মাত্রায় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাদের মতামত ও ধারণার মধ্যে পাঁচটি ধারণা বহুল প্রচলিত। এগুলো নিয়ে উপস্থাপন করা হলো :
১. নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে মেরুকরণ। কেন্দ্রে অবস্থিত নির্দিষ্ট ব্যক্তিই নেতা। (Leader) হিসেবে স্বীকৃত।তিনি তার আচরণ দ্বারা অন্যদের প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন।
২. নেতাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের অগ্রদূত যোগ্য ইত্যাদি হিসেবে প্রচার করা হয়। নেতা নিজেও তার সদস্যদের সে দিকে ধাবিত করান।
৩. সামাজিক বিভিন্ন প্যারামিটারের মাধ্যমে নেতাকে নেতা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান যেটা দল বা গোষ্ঠীর অন্তর্গত সদস্যরা তার বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি বিচার ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে নেতৃত্বের ভার অর্পণ করে।
৪. নেতা তার গুণাবলির দ্বারা দলকে বিন্যাস করে থাকেন । প্রতি দলের পরিচালনার জন্য অসংখ্য পরমমান থাকে। নেতা তার দলকে নির্দিষ্ট পরমমানের দিকে ধাবিত করেন।
৫. নেতৃত্বমূলক আচরণ নেতৃত্বকে নির্দেশ কিংবা তার মানদণ্ড নির্ধারণ করে। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যমণ্ডিত আচরণ রয়েছে যা নেতা প্রদর্শন করে থাকে।
নেতৃত্বের সংজ্ঞা : নিম্নে কয়েকজন খ্যাতনামা দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী কর্তৃক প্রদত্ত নেতৃত্বের সংজ্ঞা উপস্থাপন
করা হলো :
চেস্টার আই. বার্নার্ড (Chester I Bernard) বলেন, “নেতৃত্ব বলতে ব্যক্তিবর্গের এমন আচরণ বা গুণকে বুঝায় যার মাধ্যমে তারা সংগঠিত কার্য প্রচেষ্টায় জনগণকে বা তাদের কার্যকলাপ পরিচালিত করে।”
এইচ. ডি. ডুনেল (H. D. Dunel) বলেন, “সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের জন্য জনগণকে সহযোগী হতে বা উদ্যমী ও প্ররোচিত করার কাজকেই নেতৃত্ব বলে।”
সেকলার হডসন (Seckler Hodson) বলেন, “নেতৃত্ব বলতে প্রতিষ্ঠানে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কোনো সাধারণ কর্ম প্রচেষ্টায় সমবেতভাবে কর্ম সম্পাদন করতে মানুষকে প্রভাবিত ও উৎসাহিত করাকে বুঝায় ।”
প্রফেসর এইচ. কুঞ্জা এবং সি. অডোনাল (Prof. H Kunja & C. Odonal) বলেন, “নেতৃত্ব হলো জনগণকে প্রভাবিত করার এমন এক প্রক্রিয়া বা কলা যার মাধ্যমে তারা দলীয় লক্ষ্য অর্জনে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়।”

নেতৃত্বের ধরনসমূহ (Types of leadership) : ক্ষেত্র বিশেষে নেতৃত্ব ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি দৃষ্টিকোণের আলোকে নেতৃত্বের ধরন রূপায়িত হতে পারে।গ্রামীণ সমাজ জীবনের পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে নেতৃত্বকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় । যথা :

এছাড়াও সমাজ জীবনে আরো কয়েকটি বিশেষ ধরনের নেতৃত্ব দেখতে পাওয়া যায়। নিম্নে সেগুলোর সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোকপাত করা হলো :
i. প্রভুত্বব্যঞ্জক নেতৃত্ব (Authoritarian leadership) : প্রভুত্ব ব্যঞ্জক নেতৃত্ব গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের সম্পূর্ণ বিপরীত নেতৃত্ব। এখানে সাধারণের মতামতের তেমন কোনো মূল্যায়ন হয় না। নেতা নিজেই নীতিমালা প্রণয়ন করে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে শুরু করে সমস্ত ব্যাপারে নেতার মতামতই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এখানে নেতা অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। তার কাছে অন্যের মতামত এর প্রতি গুরুত্ব দেয়া এক বিরল ঘটনা। তাই জনসাধারণও এই ধরনের নেতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় যা নেতাদের অকাল বোধনে পরিণত হয়।
ii. ঐশ্বরিক নেতৃত্ব (Charismatic leadership) : এই ধরনের নেতৃত্বে নেতার মধ্যে অলৌকিক গুণাবলির মহাসমাবেশ ঘটে থাকে। তারা তাদের চারিত্রিক গুণাবলির দ্বারা সাধারণ জনগণকে সম্মোহিত করে রাখে। নেতা তার ব্যক্তিগত গুণাবলি, বৈশিষ্ট্য, আদর্শ ও মূল্যবোধের কারণে অন্যের কাছে ঐশ্বরিক ক্ষমতা ও পূজনীয় ব্যক্তি হিসেবে প্রতিভাত হন। উদাহরণস্বরূপ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (স), ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধদেব, যিশুখ্রিস্ট প্রমুখের নাম প্রণিধানযোগ্য। সাধারণ মানুষ তাদের ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তাদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বকে অর্থাৎ তাদের দেখানো পথকে মেনে নিয়েছিল।
iii. আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্ব (Bureaucratic leadership) : প্রশাসনিক উচ্চক্রমের কোনো এক বিশেষ অবস্থানে যে নেতৃত্ব অবস্থান করে তাকেই আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্ব বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এখানে ক্ষমতার কাঠামো একটা নির্দিষ্ট স্তূপরেখায় পরিচালিত ও নির্ধারিত হয়। এ ধরনের নেতৃত্ব সুষ্ঠু ক্ষমতার বিন্যাস নির্ভর। নিয়মতান্ত্রিকভাবে আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্ব পরিচালিত হয় বলে Max Weber একে “Legal Rational Bureaucratic Leadership.” বলে অভিহিত করেছেন।
iv. সংস্কারক (Reformer) : সমসাময়িক সামাজিক অবস্থার কোনো বিশেষ দিক সংস্কারের উদ্দেশ্যে বৃহত্তর জনসমষ্টিকে সচেতন করার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করা সমাজ সংস্কারমূলক নেতৃত্বের অন্যতম কাজ। এ সমস্ত নেতাগণ চিন্তা ও চেতনে এক বৈপ্লবিক রকমের জাগরণ সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজের গতানুগতিক কাঠামোয় পরিবর্তন আনেন। তারা মূলত সমাজের কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণাগুলোকে নির্মূল করার জন্য বদ্ধপরিকর হন। উদাহরণস্বরূপ বেগম রোকেয়ার কথা বলতে পারি যিনি নারী শিক্ষার জন্য কাজ করে গেছেন। তৎকালীন সামাজিক কুসংস্কারের বেড়াজাল ভেঙে পর্দার ভিতর থেকে নারী সমাজকে বাইরের জগতে নিয়ে এসেছেন। এছাড়া রাজা রামমোহন রায়, আব্রাহাম লিংকন, মার্টিন লুথার কিং, হাজী শরিয়তুল্লাহসহ আরো অনেক সমাজসংস্কারকগণ তাদের নেতৃত্বের মাধ্যমে সমাজকে আলোকিত করেছেন।
v. এলিট নেতৃত্ব (Elite leader) : এলিট বলতে সমাজের উচ্চ পর্যায়ের/স্তরের মানুষকে বুঝায়। এরা এদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে দক্ষ ও পারদর্শী হয়ে থাকে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতা ও যোগ্যতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। সমাজে তাদের সম্মানের জায়গাটাও অনেক প্রশস্ত। তারা তাদের যে কোনো কাজ দক্ষ ও নিপুণভাবে সম্পন্ন করে থাকে। কোনো কাজ সুন্দর, সুসামঞ্জস্যপূর্ণ ও দক্ষতার সাথে করার মাধ্যমে তারা নেতৃত্বের বিকাশ
ঘটিয়ে থাকে।
vi. আরোপিত ও অর্জিত নেতৃত্ব (Ascribed and achieved leadership) : যখন নেতৃত্ব গোষ্ঠীর উপর, বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া হয় তখন সেই নেতৃত্বকে আরোপিত নেতৃত্ব বলে অভিহিত করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি সৈন্যাধ্যক্ষের নেতৃত্ব তার উপর আরোপ করা হয়ে থাকে। অন্যদিকে, যখন নেতৃত্ব গোষ্ঠীর ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্ভূত হয়, তখন তাকে অর্জিত নেতৃত্ব বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। যেমন কোনো রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক সম্পাদকের কিংবা সাধারণ
সম্পাদকের দায়িত্ব হচ্ছে অর্জিত নেতৃত্ব।
vii. গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব (Democratic leadership):গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব বলতে বুঝায় এমন এক ধরনের নেতৃত্বকে যেখানে সকল সদস্যের সমর্থন নিহিত। এ ধরনের নেতা সকলের নিকট আদর্শ রূপে প্রতীয়মান হয়ে থাকেন।তিনি গোষ্ঠীর সকল সদস্যের মতামতের প্রতি গুরুত্ব পোষণ করেন এবং শ্রদ্ধাশীল। তিনি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত সকল সদস্যের পরামর্শকে মাথায় নিয়ে পথ চলেন। যে কোনো সংকটের মুহূর্তে তিনি সাধারণ মানুষকে পাশে পান কেননা সাধারণ মানুষ তাকে খুব ভালোবাসেন।
viii. প্রশাসনিক নেতৃত্ব (Administrative leadership) : প্রশাসনিক নেতা কোনো না কোনো প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেন। তিনি ঐ প্রশাসনের দ্বারা আরোপিত নির্দিষ্ট কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলেন। অর্থাৎ প্রশাসনিক নেতৃত্ব বিধিনিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ। তিনি ঐ সমস্ত নির্দিষ্ট রীতিনীতি যথাযথভাবে পালন না করলে তার নেতৃত্ব হুমকির সম্মুখীন হয় এবং তিনি নেতৃত্ব হারাতেও পারেন। তিনি মূলত তার প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা, পরিকল্পনা ইত্যাদির জন্য কাজ করেন এবং যথাযথভাবে পরিচালনা করেন।
ix. বিশেষজ্ঞ (Expert) এসব নেতারা নিজেদের বিষয়ে চূড়ান্ত রকম পারদর্শী হয়ে থাকেন। বিজ্ঞান, শিল্পকলা, অর্থশাস্ত্র, সমাজ নীতি বা অন্য যে কোনো বিষয়ে সৃজনশীলতার অবদানে বরেণ্য ব্যক্তিদেরও স্ব-স্ব ক্ষেত্রে নেতা বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এরা মূলত জ্ঞানের শাখাকেন্দ্রিক দক্ষতা অর্জন করে। এদের নেতৃত্ব প্রধানত শিক্ষা ও দর্শনকেন্দ্রিক অর্থাৎ অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবস্তুগত হয়ে থাকে। যেমন পদার্থবিজ্ঞানে আইনস্টাইন, কাব্যে রবিঠাকুর, শেক্সপীয়র প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গ এ ধরনের নেতৃত্বের উদাহরণ।
x. বুদ্ধিজীবী নেতা (Intellectual leader): চিন্তা জগতে ব্যাপকভাবে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বুদ্ধিজীবী তাত্ত্বিকেরা এ পর্যায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তি। এরা বৃদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে জ্ঞানবিজ্ঞানের নতুন দ্বার উন্মোচন করে থাকে। তাদের সাধনায় মেধা ও মননের যুগপৎ সন্নিবেশ ঘটে থাকে যা তাদেরকে অন্য রকম এক নেতৃত্বের উচ্চতায় আসীন করে। যেমন- কার্ল মার্কস, লেনিন, ডারউইন, বেঞ্জামিন প্রমুখ তাত্ত্বিকেরা তাঁদের চিন্তা চেতনার উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে নেতৃত্বকে বশ করেছেন।
উপসংহার : উপযুক্ত আলোচনার নিরিখে বলা যায় যে, স্থান-কাল পাত্রভেদে ব্যক্তির দক্ষতা, যোগ্যতা প্রভৃতির মাপকাঠিতে নেতৃত্বের রূপরেখা রচিত হয়ে থাকে। কখনো এটা কোনো নির্দিষ্ট এলাকা বা দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কখনো দেশ-কালের গণ্ডি পেরিয়ে অসীম অবস্থান করে। তাই নেতৃত্বের ধরনেও দেখা যায় নানা বৈচিত্র্যতা।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*