নারী সংগঠনের কার্যাবলি আলোচনা কর।

অথবা, নারী সংগঠনের কার্যাবলি বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
যে সকল সংগঠন নারীদের কল্যাণে, নারীদের দ্বারা গঠিত ও পরিচালিত হয় তাদের নারী সংগঠন বলে। নারীরা পুরুষদের সহযোগী। নারী-পুরুষ সমবায়ে মানবজাতি গঠিত। কিন্তু সভ্যতার উষালগ্ন হতে তারা (নারীরা) তাদের পুরুষ সঙ্গীর দ্বারা নির্যাতিত হয়ে আসছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীদেরকে তাদের নিজেদের স্বার্থে খেয়াল খুশিমতো ব্যবহার করে। আগের যুগে নারীদের বিক্রয় করা হতো। কোন কোন দেশে নারী শিশুদের জন্মের পর হত্যা করা হতো। তাকে কোন অধিকার দেয়া হতো না। তার শিক্ষার অধিকার ছিল না। বিংশ শতাব্দীর পূর্বে নারীদের কোন ভোটাধিকার ছিল না। সে ছিল পুরুষতন্ত্রের নিগড়ে বন্দি। আধুনিক কালেও নারীরা বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার। অনেক দেশ ও সমাজ নারী শিক্ষা ও নারী প্রগতির বিরোধী। উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় দেশে এখনও নারীরা বিভিন্ন সন্ত্রাস ও বৈষম্যের শিকার। তারা যৌন হয়রানি, মারধোর, যৌতুক, ধর্ষণ, হত্যা, ইভটিজিং ইত্যাদির শিকার। এসব সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নারীদের নিজস্ব সংগঠন গড়ে উঠেছে। এসব সংগঠনের উদ্দেশ্য হলো নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করা ও বৈষম্য দূর করা। এসব সংগঠনকে নারী সংগঠন বলে ।
নারী সংগঠনের কার্যাবলি : আধুনিককালে নারীবাদ বিকাশের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নারীবাদী সংগঠন গড়ে উঠেছে। এসব সংগঠন নারী অধিকার রক্ষার জন্য নারীদের সংগঠিত করছে। তারা নারীর সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। আধুনিক নারীবাদী সংগঠনগুলো যেসব কাজ করছে তা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. জেন্ডার সন্ত্রাস দূর করা : নারী সংগঠনের অন্যতম কাজ হলো জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণ করা।’ জেন্ডার বৈষ্যমের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নারীরা জেন্ডার সন্ত্রাসের শিকার হয়। এটা বিশ্বের নারীদের আন্দোলনের মূল ইস্যু। জেন্ডার সন্ত্রাস হলো Wife battering, rape, molestation, women trafficking, Eve-teasing ইত্যাদি।
২. নারী পুরুষের সমতা অর্জনের জন্য কাজ করা : নারী সংগঠনগুলো নারী-পুরুষ সমতার জন্য কাজ করে। অনেক দেশে নারীদের কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য করা হয়। তাদের সব কর্মে নিয়োগ করা হয় না। আবার নিয়োগ করা হলেও নারীদের কম মজুরি দেয়া হয়। কোথাও কোথাও শ্রম ঘণ্টা বাড়িয়ে দিয়ে শোষণ করা হয়। এসব বন্ধের জন্য নারী সংগঠনগুলো কাজ করে। তাদের উদ্দেশ্য হলো নারী পুরুষ সমতা অর্জন করা।
৩. নারীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস প্রতিরোধ করা : নারীরা পুরুষের বিভিন্ন সন্ত্রাসের শিকার হয়। এর মধ্যে রয়েছে ধর্ষণ, হত্যা, শ্লীলতাহানী, গুম, খুন, পাচার, যৌন হয়রানি, এসিড নিক্ষেপ ইত্যাদি। নারীরা এসব সন্ত্রাস প্রতিরোধ করে এবং এজন্য তারা ইস্যু তৈরি করে আন্দোলন সংগ্রাম করে। তাদের আন্দোলন সংগ্রামের কারণে সরকার নারীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস প্রতিরোধে এগিয়ে আসে।
৪. নারীর কর্মসংস্থান করা : আধুনিক কালে নারী সংগঠনগুলো নারীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভালো করার জন্য তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে। এসব সংগঠনে কাজ করে নারী স্বাবলম্বী হয় এবং তার দরিদ্রতা দূর হয়। এটা তার ক্ষমতায়নে সাহায্য করে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের এন.জি.ও সংগঠনগুলো যেমন- আশা, ব্রাক, গ্রামীণ ব্যাংকে বহু নারী কর্ম করে তাদের দরিদ্রতা ঘোচাচ্ছে।
৫. নারীকে আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করা : নারীবাদী সংগঠনগুলো দরিদ্র নারীদের আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে তাদের দরিদ্রতা ঘোচাচ্ছে। তারা গাভী পালন, কুটির শিল্প, জমি চাষ, শাক-সবজি চাষ ইত্যাদির জন্য ক্ষুদ্র লোন নিয়ে উপকৃত হয়।
৬. দুঃস্থ নারীকে আইনি সহায়তা প্রদান করা : নারী সংগঠনগুলো নারীকে আইনি সহায়তা দেয়। নারীরা হত্যা, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, মারধোর, তালাক, ফতোয়া ও যৌতুকের শিকার হলে নারী সংগঠনগুলো এগিয়ে আসে। তারা ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের বিনামূল্যে আইনি সহায়তা দেয়। বাংলাদেশে মহিলা আইনজীবী সমিতি ও অন্যান্য নারীবাদী সংস্থা নারীকে আইনী সহায়তা দেয়।
৭. নারীর দরিদ্র্য দূর করা : নারীবাদী সংগঠন নারীকে দরিদ্রতা হতে মুক্তি দিতে কাজ করে। এজন্য তারা নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে। তাকে বিভিন্ন কর্মের উপযোগী প্রশিক্ষণ দেয়। এর মধ্যে রয়েছে সেলাইয়ের কাজ শিখানো, এমব্রডারী কাজ শিখানো, সাজসজ্জা ও বিউটি পার্লারের কাজ শিখানো, বিভিন্ন কুটির শিল্পের কাজ শিখানো। এর মাধ্যমে নারী নিজেই তার আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে সংসারে সচ্ছলতা আনে।
৮. নারী শিক্ষার ব্যবস্থা করা : নারী উন্নয়নে সর্বাগ্রে প্রয়োজন নারী শিক্ষার ব্যবস্থা করা। অনেক সংগঠন এ ব্যাপারে স্কুল পরিচালনা করে এবং বয়স্ক নারীদের স্বাক্ষরতা শিক্ষায়। শিক্ষা ব্যবস্থা নারীকে অধিকার সচেতন করে তোলে। ফলে সে তার অধিকার সচেতন হয় এবং সমাজে তার ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়।
৯. নারীকে অধিকার সচেতন করে তোলা : নারী সংগঠনগুলো নারীকে অধিকার সচেতন করে তোলে। এজন্য তারা নারীদের সংগঠিত করে তাদের নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করে। এজন্য তারা আন্দোলনের জন্য বিভিন্ন ইস্যু তৈরি করে। এসব ইস্যুর ভিত্তিতে আন্দোলন পরিচালিত হয়।
১০. নারীর মানবাধিকার রক্ষা করা : নারী সংগঠনের অন্যতম কাজ হলো নারীর মানবাধিকার রক্ষার জন্য কাজ করা । কেউ মানবাধিকার লংঘন করলে সংগঠনগুলো সরব হয়ে উঠে এবং মানবাধিকার রক্ষার জন্য আন্দোলন সংগ্রামে রত হয় এবং আইনি লড়াই শুরু করে। ফলে মানবাধিকার রক্ষিত হয়।
১১. হত্যা, ধর্ষণ ও ফতোয়ার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা : নারীবাদী সংগঠনগুলো নারীদের হত্যা, ধর্ষণ ও ফতোয়ার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে। এসব বন্ধের জন্য প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে। সম্প্রতি ভারতের দিল্লিতে বাসে একজন মহিলাকে গণধর্ষণের বিরুদ্ধে নারী সংগঠনের প্রচেষ্টায় সারা ভারত ব্যাপী তীব্র আন্দোলন শুরু হয়েছে। ফলে ভারত সরকার ধর্ষকদের গ্রেফতার করে বিচারের কাঠগড়ায় হাজির করেছে। সারা ভারত তাদের কঠোর শাস্তির দাবি করছে।
১২. নারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা : নারী সংগঠনগুলো নারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করে। ফলে তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি পায়। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে নার্সিং, কারিগরি প্রশিক্ষণ, কুটির শিল্প তৈরির প্রশিক্ষণ, মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, গবাদি পশু পালন ইত্যাদি। এসব প্রশিক্ষণ নারীর কর্মসংস্থানে সাহায্য করে।
১৩. নারী ইস্যু বিষয়ে সেমিনার ও ওয়ার্কসপের আয়োজন করা : নারী সংগঠনগুলো নারীর ইস্যু নিয়েও কাজ করে। এজন্য তারা নারী উন্নয়ন, টার্গেট অর্জনের জন্য সেমিনার ও ওয়ার্কসপের আয়োজন করে। এতে নারীদের প্রতি গণচেতনা বৃদ্ধি পায়। আর এই গণচেতনা নারী উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
১৪. নারীর স্বার্থ বিরোধী কর্মকাণ্ড ও আইন প্রতিরোধ করা : নারী সংগঠনগুলো নারীর স্বার্থ বিরোধী কর্মকাণ্ড ও আইন প্রতিরোধ করে। বাংলাদেশের নারীবাদী সংগঠনগুলো মৌলবাদ ও ফতোয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও ফতোয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রামশীল। এজন্য বাংলাদেশের হাইকোর্ট ফতোয়াকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ফতোয়া এখন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ।
১৫. সালিশ মীমাংসা : সালিশ মীমাংসার মাধ্যমে নারীবাদী সংগঠনগুলো স্বামী-স্ত্রীর যৌতুক, মোহরানা ও খোরপোষ সমস্যার মীমাংসা করে। “Bangladesh Legal Aid and Services Trust (BLAST).” ১৯৯৯ সাল হতে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ৪,৬৯৯টি বিরোধ মীমাংসা করেছে। খোরপোষ ও মোহরানা বাবদ ২০০৩-২০০৪ সালের মধ্যে ১৮,৬২৭,৩১৯ টাকা আদায় করেছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, নারী সংগঠনগুলো বহুবিধ কার্য সম্পাদন করে। তাদের কার্যক্রম বিশ্বব্যাপী। সারা বিশ্বব্যাপী তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত্ব। তারা দুঃস্থ নারীদের কল্যাণে কাজ করে এবং তাদের পুনর্বাসনের জন্য সাহায্য ও কর্মসূচি গ্রহণ করে। এসব সংস্থা তাদের কর্মসংস্থানের ও শিক্ষারও ব্যবস্থা করে। তারা প্রচার, প্রপাগান্ডার মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারী ইস্যুসমূহ তুলে ধরে। তাদের কর্মকাণ্ডে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা কমে আসে এবং নারীর পক্ষে গণচেতনা সৃষ্টি হয় বা নারী উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a4%e0%a7%83%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%be-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4%e0%a6%bf/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*