নারী নির্যাতনের প্রক্রিয়া ও বিশেষত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, নারী নির্যাতনের ধরন ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।
অথবা, নারী নির্যাতনের প্রক্রিয়া ও বিশেষত্ব সম্পর্কে বর্ণনা কর।
অথবা, নারী নির্যাতনের প্রক্রিয়া ও বিশেষত্ব সম্পর্কে বিবরণ দাও।
অথবা, নারী নির্যাতনের ধরন ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা কর।
অথবা, নারী নির্যাতনের প্রক্রিয়া ও বিশেষত্ব সম্পর্কে যা জান লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা :
অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা, সংখ্যা ‘নারী নির্যাতন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। নির্যাতনে দু’টি পক্ষ থাকে। একজন নির্যাতন করে, অপরজন নির্যাতন ভোগ করে।
নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে পুরুষ-নারীকে পুরুষ আধিপত্য মেনে নিতে এবং বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করে। পিতৃতন্ত্র ও ঘটনায় এ সত্যই প্রমাণিত হয়। পিতৃতন্ত্রের মূল কথা পুরুষের আধিপত্য ও নারীর অধীনতা। নির্যাতন চালিয়ে এবং নির্যাতন দৈহিক হতে পারে, মানসিকও হতে পারে। নির্যাতনের প্রক্রিয়ার সাথে সার্বিক নির্যাতন প্রক্রিয়ার মিল আছে। নিম্নে নারী নির্যাতনের বিভিন্ন প্রক্রিয়া উল্লেখ করা হলো :
নারী নির্যাতনের প্রক্রিয়া : নারীসমাজের উপর অত্যাচার, নিপীড়ন বিভিন্ন পন্থায় সংঘটিত হয়ে থাকে।
১. মতাদর্শ : পুরুষ প্রাধান্য নারী নির্যাতনের আদর্শিক ভিত্তি। অবিবেচক, হঠকারি, বিচারবুদ্ধি বিবর্জিত, আবেগ তাড়িত, অস্থিরচিত্ত নারীকে নিজ ইচ্ছায় চলতে দিলে সমাজে বিপর্যয় ঘটে থাকে। কাজেই সমাজের প্রয়োজনে নারীকে বশে রাখতে হবে। নারীকে বশে রাখতে, নিয়ন্ত্রণে রাখতে যদি নির্যাতনের প্রয়োজন পড়ে তবে সমাজের বৃহত্তর স্বাথে, সমাজের সার্বিক কল্যাণের প্রয়োজনে নির্যাতন অপরিহার্য। কাজেই নারী নির্যাতন আদর্শের জন্য নির্যাতন।
২. প্রচারণা : নারী নির্যাতনের মতাদর্শ সমাজে গ্রহণযোগ্য করা হয়েছে ধর্ম, শিক্ষা ও পরিবারে নিরবচ্ছিন্ন প্রচারণার মাধ্যমে। চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, রেডিও, সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক ও নভেল- এমনকি বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞা মনোবিজ্ঞানে নারীর হীনতা ও অধীনতা এবং পুরুষের আধিপত্য নানাভাবে প্রচার করা হয়েছে, এখনও হচ্ছে।
৩. বাছবিচারহীন ও অনৈতিক : বয়স, স্থান, কাল নির্বিশেষে সকল নারীবস্তু নির্যাতনের সম্ভাব্য লক্ষ্য। নাবালিকা শিশু কন্যাকে শৈশবে নির্যাতনের শিকার হতে হয় খাদ্য ও চিকিৎসায় বৈষম্যের মাধ্যমে। চীনে কোমলমতি বালিকার পা ছোট রাখার জন্য লোহার জুতা পরানো হয়। পুরুষ প্রধান সমাজে নারী নির্যাতনে যে খারাপ কিছু আছে তা মনে করে না।
৪. স্বেচ্ছাপ্রণোদিত মান্যতা : ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা ও সংস্কার নারীর মধ্যে হীনম্মন্যতা সঞ্চার করেছে, যে নির্যাতনকে আত্মস্থ করে নিয়েছে। সবল স্ত্রী রুগ্ন, অক্ষম স্বামীর হাতে মার খেয়েও প্রতিবাদ করে না। কারণ সে মনে করে স্বামীর কাছ হতে প্রহার তার প্রাপ্য। সমাজ নারীর মধ্যে এমন স্বেচ্ছাপ্রণোদিত মান্যতা ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, শাশুড়ি বধূকে পীড়ন করার
জন্য পুত্রকে প্ররোচিত করে।
৫. নির্যাতনকারী ও নির্যাতিত : পুরুষ নির্যাতন করার অধিকারী এবং নির্যাতন সহ্য করা নারীর কর্তব্য। এ বোধ জাগ্রত করে নারীকে প্রতিবাদ বা প্রতি আক্রমণ থেকে বিরত রাখা হয়েছে। পুরুষ নির্যাতনকারী এবং নারী নির্যাতনের নীরব শিকার এ যেন চিরন্তন নিয়ম। সবল স্ত্রী দুর্বল স্বামীর প্রহার খেয়ে পাল্টা প্রহার করে না, স্বামীর গঞ্জনার জবাব দেয়া স্ত্রী বেয়াদবি মনে করে।
নারী নির্যাতনের বিশেষত্ব : নারী নির্যাতনের কতিপয় বিশেষত্ব আছে, যা বর্ণনা করলে নারী নির্যাতনের স্বরূপ বুঝা যায়। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. নারী নির্যাতনের সর্বজনীনতা : নারী নির্যাতন সর্বজনীন কোন আর্থসামাজিক ভৌগোলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ নয়।
কে নারীকে নির্যাতন করে? জবাবে বলা যায় পুরুষ। বয়স, ধর্ম, বর্ণ, নরগোষ্ঠী নির্বিশেষে পুরুষ। সকল সম্প্রদায়, উচ্চ মধ্য, নিম্নবিত্ত, ধনী, নির্ধন, শিক্ষার সকল স্তরের পুরুষ নারী নির্যাতন করে। তারা বিবাহিত, অবিবাহিত, তালাকপ্রাপ্ত পরিত্যক্ত। নির্যাতনকারী পুরুষের মধ্যে সরকারি কর্মচারী, সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, ব্যবসায়ী, পুঁজিপতি, ডাক্তার, উকিল,
ধর্মযাজক, পেশাজীবী, ব্যবস্থাপক, নির্বাহী কর্মকর্তা, কেরানি, বেকার সবাই আছে।
২. গোপন রাখার প্রবণতা : নারী নির্যাতনের ঘটনা সাধারণত গোপন করা হয়, জনসমক্ষে প্রচার হতে দেয়া হয় না।পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নির্যাতনের ঘটনার সংখ্যা ন্যূনতম। পিতৃতন্ত্রের ঐতিহ্যে লালিত নারী নির্যাতনকে জীবনেরবাস্তবতা মনে করে এবং প্রতিবাদ না করে ঢেকে রাখে। সাম্প্রতিককালে নারী আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে কিছু কিছু ঘটনা প্রকাশ হতে শুরু করেছে।
৩. সামাজিকীকরণ : সামাজিকীকরণ একটি প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি তার সংস্কৃতি কর্তৃক সমুচিত বলে পরিগণিত নিয়মকানুন, ভূমিকা ও সম্পর্কসমূহ শিক্ষা করে। এ প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি সমাজের চিন্তাধারা ও আচরণ নিজের বলে গ্রহণ এবং নিজের মধ্যে আত্মস্থ করে নেয়। নারী যে তার সেক্স ভূমিকা শেখে ও অনুশীলন করতে বাধ্য হয় তা এ সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ারই ফল।
৪. শাস্তিহীনতা : নারী নির্যাতন মামলায় শাস্তির ঘটনা বিরল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্যাতনকারী পুরুষ বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। সামাজিক পরিবেশ সচরাচর নারী নির্যাতনকে ঘরোয়া ব্যাপার বলে গণ্য করে। স্ত্রীকে প্রহার বা তার সাথে দুর্ব্যবহার, অফিসে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি, এসব ঘটনাকে সমাজে বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আমল দিতে চায়
না। কর্মস্থল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির সাথে ভবিষ্যৎ কর্মজীবন ও ছাত্রজীবন জড়িত, বিধায় কোর্ট কাচারিতে না গিয়ে মিটিয়ে ফেলা হয়।
৫. উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে : নারী নির্যাতনের দোষ নারীর উপর চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য। নারী ধর্ষিত হলে অপরাধ হয় নারীর, সে সমাজ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়। ধর্ষক পুরুষের কিছু হয় না। সে বহাল তবিয়তে সমাজে ও পরিবারে বসবাস করে। পুরুষ প্রধান সমাজ নারীর উপর পুরুষের নির্যাতন জায়েজ করার জন্য বানোয়াট কথা রানিয়েছে এবং নারী নির্যাতনের জন্য পুরুষের যেন শাস্তি না হয় তার নিশ্চিত ব্যবস্থা করে রেখেছে।
৬. নারী নির্যাতনের সাথে সেক্স এর সম্পর্কহীনতা : চূড়ান্ত বিশ্লেষণে নারী নির্যাতন সেক্সজনিত নয়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, নারী নির্যাতন যৌন হতাশা বা যৌনক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ নয় এবং সমাজ বিনির্মিত পুরুষসুলভ বৈশিষ্ট্য বা পুরুষসুলভ সুবিধা জাহির করার ইচ্ছা থেকে নারী নির্যাতনের বাসনা জাগ্রত হয়। প্রতিটি পুরুষ এ ধারণার মধ্যে লালিতপালিত হয় যে, তার মধ্যে এমনকিছু উপাদান থাকা সমুচিত, যা নিয়ন্ত্রণে থাকবে বটে, কিন্তু প্রয়োজনে বাঁধন খুল ছেড়ে দিতে হবে। এ উপাদানটি নির্যাতনের উপর পরিপুষ্টি লাভ করে।
মূল্যায়ন : নারীকে পুরুষের অধীনতা পাশে আবদ্ধ রেখে নারীর উপর পুরুষের সর্বময় প্রভুত্ব বজায় রাখার জন্য পিতৃতন্ত্রের অস্ত্র নারী নির্যাতন। একে মূল্যায়ন করা যায় এভাবে, প্রথমত, শত শত বছর এ ধারণা লালন করা হয়েছে যে, দৈহিক শক্তি বলে স্ত্রীকে শাস্তি দেয়ার বা তাকে নিয়মানুবর্ত করার অধিকার স্বামীর আছে। দ্বিতীয়ত, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীকে হীন নিকৃষ্ট জ্ঞান করা হয়। এ প্রসঙ্গে Elizabeth Cad Stanton তাঁ ‘The Woman’s Bible’ (P-66) গ্রন্থে বলেছেন, “Violence and its corollary bear serve to terrorise females and to maintain the patriarchal definition of women’s place.” নির্যাতন ও তার আনুষঙ্গিক ভীতির দ্বারা নারীকে আতঙ্কিত এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অধস্তন অবস্থানকে সুদৃঢ় করা হয়। তৃতীয়ত, সন্ত্রাসীদের দ্বারা আরও নাজেহাল হওয়ার ভয়ে অনেক পরিবার আজ নারী নির্যাতনের হৃদয় বিদারক ঘটনাকেই অস্বীকার করতে সদা সতর্ক থাকছে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, নারী নির্যাতনের উল্লিখিত প্রক্রিয়াগুলো বিশেষভাবে লক্ষণীয় ! ব্যাপক অর্থে নির্যাতনের রূপগুলোর মূলোৎপাটন না করলে নারীমুক্তি আসবে না। নারী ও পুরুষের জেন্ডার সুষ ও সমতাপূর্ণ বিকাশ ঘটবে না। দৈহিক ও মানসিকভাবে নারী নির্যাতনের সাথে আমরা সবাই পরিচিত। খবরের কাগজের পাতায় নারী ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, এসিড নিক্ষেপ, যৌতুকের জন্য নিগ্রহ, এমনকি হত্যা ইত্যাদি খবর নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। যৌন হয়রানি নারীকে ব্যক্তিগতভাবে ও সমষ্টিগতভাবে পুরুষের চেয়ে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে নিকৃষ্ট করে রাখে এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পুরুষ প্রাধান্য নিশ্চিত করে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%80-%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%a4%e0%a6%a8%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%af/
https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%80%e0%a6%b0-%e0%a6%85/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*