নারী জাগরণে বেগম রোকেয়ার সাহিত্য কতটুকু ভূমিকা রাখে?

অথবা, নারী জাগরণের পথিকৃৎ হিসেবে বেগম রোকেয়ার সাহিত্যের মূল্যায়ন কর।
অথবা, বেগম রোয়ার সাহিত্য সাধনা ব্যাখ্যা কর।
উত্তরা।। ভূমিকা :
বাংলাদেশের নারী জাগরণের ইতিহাসে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নাম শ্রদ্ধার সাথে স্বরণীয়। বাংলার নারী জাগরণের ক্ষেত্রে তিনি যে অবদান রেখেছেন তা নিঃসন্দেহে অবিস্মরণীয়। তাঁর সমগ্র জীবনব্যাপী আন্ত রিত সাধনা ছিল অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ স্বগোত্রীয় মুসলিম নারীসমাজের সর্বাঙ্গীণ মুক্তি। নারীমুক্তির মাধ্যমে দেশ ও জাতির কল্যাণের উদ্দেশ্যে তিনি স্বীয় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে, বাংলার কূপমণ্ডুক মুসলমান নারীসমাজকে তিনিই সর্বপ্রথম মুক্তিমন্ত্রে উজ্জীবিত করেন। তিনিই প্রথম মুক্তি পথে বাংলার মুসলমান নারীসমাজকে আলোর দিশা দেখিয়েছেন। এ কারণে তিনি মুসলিম বাংলার নারী জাগরণের ইতিহাসে আলোর দিশারী হয়ে থাকবেন।
পরিচয় : বেগম রোকেয়া উনিশ শতকের শেষভাগে ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার অন্তর্গত পায়রাবন্দ নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বেগম রোকেরা যে বংশের কন্যা তা সাবির’ বংশ নামে খ্যাত। তাঁর পিতার পুরো নাম মুহম্মদ নূহ সাবের আবুল কামু সাবের জহিরুদ্দিন মুহম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের। বেগম রোকেয়ার মায়ের নাম বাহাতান্নেছা সাবের চৌধুরানী। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বেগম রোকেয়ার সাহিত্য সাধনা : বেগম রোকেয়ার শ্রেষ্ঠ পরিচয় সমাজকর্মী হলেও তাঁর সাহিত্যচর্চা মোটেও অনুল্লেখযোগ্য নয়। সমাজের গ্লানিময় দিকের চিত্র শিক্ষিত সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই তিনি সাহিত্যচর্চা করেন। নারী ও নারীর মানসিক মুক্তিই ছিল তাঁর সাহিত্যচর্চার আসল উদ্দেশ্য। তাঁর সাহিত্য মুসলিম নারী জাগরণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তাঁর সাহিত্য সাধনার স্বরূপ অনুধাবন করলে দেখা যায়,নারীসমাজের
পশ্চাৎপদতা, অশিক্ষা, কূপমণ্ডূকতা, গোঁড়ামি, কুসংস্কার, অবরোধ প্রথার প্রতি অসহায় আত্মসমর্পণ প্রভৃতি চিত্র। সমাজের কল্যাণ ও নারী জাগরণের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে যুগে একমাত্র বেগম রোকেয়াই লেখনী ধারণ করেছিলেন। সেকালে বাংলার বুসলমান সমাজে এমন কোন সৃষ্টিধর্মী সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটে নি যার লেখনীর প্রভাবে বাঙালি মুসলমানদের সামাজিক জীবনে কোন বড় রকমের পরিবর্তন সাধিত হতে পারে। সেদিক বিচার করে একথা নিঃসংশয়ে বলা যায় যে, বেগম রোকেয়ার সাহিত্য সাধনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এক ঘটনা। অবরোধ প্রথার বিভীষিকা, পর্দার নামে অমানবিক অবরোধ প্রথা, স্ত্রীশিক্ষা বিরোধী মনোভাব এবং সমস্ত প্রকার সামাজিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে মসী ধারণ করে তিনি আপসহীন সংগ্রাম চালিয়েছিলেন। সমাজজীবনে এর প্রতিক্রিয়া হয়েছিল শুভ। বেগম রোকেয়ার শক্তিশালী লেখনীই যে প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তন সাধন করে অগ্রগতির পথে যাত্রারম্ভ করেছিল তা অনস্বীকার্য।
নারী সাহিত্য : আধুনিককালের নারী সাহিত্যের সর্বপ্রথম রচয়িত্রী বেগম রোকেয়া। বেগম রোকেয়ার পূর্ববর্তীকালে ও সমকালে যে কয়েকজন মুসলিম মহিলা সাহিত্যচর্চা করেছিলেন তাঁদের নাম হাতে গোনা যায়। এদের কেউই বেগম রোকেয়ার ন্যায় নারী সাহিত্য রচনায় সার্থকতার পরিচয় দিতে পারেন নি। সাহিত্য রচনা করার মত শিক্ষা ও সাধনা মুসলিম সমাজে আজও দুর্লভ। কিন্তু পুরুষ রচিত সাহিত্যেও নারী জীবনের ছাপ আজ পর্যন্ত পড়ে নি। সে সঙ্কটময় মুহূর্তে শত দুর্বলতা সত্ত্বেও সাহসে ভর করে লেখনী ধারণ করেছিলেন বেগম রোকেয়া অন্তরের এক গভীর প্রেরণায়। তাঁর বুকোমল অন্তরের সে সুগভীর প্রেরণাটি হলো নারীমুক্তির মাধ্যমে জাতীয় জাগরণ। জাতির সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সাধনের প্রয়াসে তিনি সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে পশ্চাৎপদ মুসলমান সমাজে বিশেষ করে মুসলমান নারীসমাজে জাগরণের বাণী বহন করে এনেছেন। নারীর সর্ববিধ সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তিনি লেখনী চালনা করেন। তাঁর মনের উদ্দেশ্য ছিল অন্ততপক্ষে হতভাগ্য মুসলমান সমাজ তাঁর এক বিপুল অংশের বাস্তব সমস্যা সম্পর্কে সজাগ হোক। তাঁর এ বিশিষ্ট চিন্তাধারার প্রতিফলনের জন্য প্রবন্ধই ছিল উপযুক্ত বাহন।
বেগম রোকেয়ার সাহিত্যরাজি : কোম রোকেয়া রচিত সাহিত্য সংখ্যায় বিপুল না হলেও বৈচিত্র্যে ভরপুর। তাঁর গ্রন্থগুলোর মধ্যে- মতিচুর (১ম ও ২য় খণ্ড), Sultana’s Dream (সুলতানার স্বপ্ন), পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কোম রোকেয়া কবিত্ব প্রতিভারও অধিকারিণী ছিলেন। সংখ্যায় কম হলেও উন্নতমানের কয়েকটি কবিতাও রচনা করেছেন। যথা : বাসিফুল, শশধর, নলিনী ও কুমুদ, কাঞ্চনজঙ্ঘা, সওগাত, নিরুপম বীর, চাঁদ প্রভৃতি। এ প্রসঙ্গে লেখিকার ভাতাভষ্মী, তিনকুড়ে, পরীটিবি, বলিগর্ত, পঁয়ত্রিশ মণ খানা, বিয়ে পাগলা বুড়ো প্রভৃতি ব্যঙ্গধর্মী রচনাগুলো উল্লেখযোগ্য।
পর্যালোচনা : কোম রোকেয়ার নারীমুক্তির উৎস নিহিত তাঁর সমাজচিন্তা,সাহিত্যচিন্তা ও শিক্ষাদর্শনে। পরাধীন বাংলার মুসলমান জাতির সামগ্রিক কল্যাণের স্বার্থে নারীসমাজের দুর্গতি মোচনের প্রতি ছিল তাঁর সজাগ দৃষ্টি। এজন্য তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন নারীসমাজে অবনতির কারণসমূহের। পুরুষ ও নারীকে বেগম রোকেয়া পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী ও শত্রু বলে মনে করতেন না। পরিবার ও সমাজজীবনে নারী ও পুরুষের ভূমিকা সম্পর্কে বেগম রোকেয়ার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্বচ্ছ। তিনি গভীরভাবে এ সত্যে বিশ্বাস করতেন যে, নারী ও পুরুষ সমাজদেহের দু’টি চক্ষুস্বরূপ। একটি চোখ নষ্ট হলে যেমন মানুষের কাজকর্মে নানা বিঘ্ন সৃষ্টি হয়, তেমনি সমাজদেহের একটি চোখ নষ্ট হলে সমাজেরও উন্নতিমূলক কাজে
বিভিন্ন বাধার সৃষ্টি হয়। সমাজের এক অংশের জাগরণ ছাড়া অন্য অংশের জাগরণ অসম্ভব। সামাজিক কর্মকাণ্ডে নারী ও পুরুষের সমান ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমেই সম্ভব সমাজের সার্বিক উন্নতি সাধন। এ সত্য উপলব্ধি করেই বেগম রোকেয়া নারী জাগরণে তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি তাঁর সাহিত্যকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন।
বক্তব্য : জীবিত ও মৃতদের মধ্যে মুসলমান সাহিত্যিকের সংখ্যা খুবই কম। মীর মোশাররফ হোসেন, পণ্ডিত রেয়াজউদ্দীন, কায়কোবাদ, কাজী ইমদাদুল হক ও মিসেস আর. এস. হোসেন সাহিত্য সমালোচনার মাপকাঠিতে বেগম রোকেয়ার সৃষ্ট সাহিত্যরাজিকে ত্রুটিমুক্ত বলা যাবে না। তবুও একথা বলা যায় যে, শত ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যের গুণে বেগম রোকেয়ার সাহিত্য সাধনা অনন্য মর্যাদার অধিকারী। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, আধুনিক বাংলা সাহিত্যে বেগম রোকেয়া এক উল্লেখযোগ্য আসনের অধিকারী। অশিক্ষা ও অজ্ঞানতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন অবরোধবন্দিনী বাংলার মুসলমান নারীসমাজের পশ্চাৎপদতা ও ভাগ্য বিড়ম্বনা তাঁর দরদি চিত্তকে গভীরভাবে আলোকিত করেছিল। নারী জাগরণের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়েই তিনি শক্তিশালী হাতে লেখনী ধারণ করেছিলেন। নারীমুক্তি ছিল তাঁর আজীবনের স্বপ্ন ও সাধনা। একজন সমাজ সচেতন লেখিকা হিসেবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি অক্ষয় হয়ে থাকবেন। নারী জাগরণে তাঁর সাহিত্যকর্মের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a6%b6-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%ac%e0%a7%87%e0%a6%97%e0%a6%ae-%e0%a6%b0%e0%a7%8b%e0%a6%95%e0%a7%87/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*