দার্শনিক কবি রবীন্দ্রনাথের দর্শনে ‘জীবনদেবতা’ সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, রবীন্দ্রনাথের দর্শনে জীবনদেবতার সাথে মানুষের সম্পর্ক ব্যাখ্যা কর।
অথবা, রবীন্দ্রনাথের দর্শনে জীবনদেবতার সাথে মানুষের সম্পর্ক তুলে ধর।
উত্তর।। ভূমিকা :
দর্শনের যেমন সাহিত্যেরও তেমনি উপজীৰা জগৎ ও জীবন। উভয়ের লক্ষ্য এক ও অভিন্ন, যদিও আলোচনার পদ্ধতি ভিন্ন। যেমন- দর্শন অগ্রসর হয় যৌক্তিক মূল্যায়ন ও বিচারবিশ্লেষণের পথে, আর সাহিত্য, বিশেষত কাব্য প্রধানত নির্ভর করে অনুভব ও হৃদয়ালেগের উপর। দর্শন তাঁর বিষয়বস্তুকে পরিমাপ করে যুক্তির নিরিখে। আর কাব্যের আবেদন আবেগ-আপ্লুত হৃদয়তন্ত্রীর দরবারে। কিন্তু তাই বলে উভয়ের সম্পর্ক দূরত্বের সম্পর্ক নয়, বরং খুবইম নিকট ও নিবিড়। তাই তো দেখা যায়, পৃথিবীর আদি রচনাবলির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ যুগপৎ স্বীকৃতি পেয়েছে সাহিত্য ও দর্শন বলে। বেশকিছু লেখক কবি হয়েও নন্দিত হয়েছেন, দার্শনিক হিসেবে। এ হিসেবেই রবীন্দ্রনাথ স্বীকৃতি পেয়েছেন দার্শনিক কবি হিসেবে।
জীবনদেবতা : বীন্দ্রনাথ বলেছেন যে, ধর্মে আমরা যে ঈশ্বরের পূজা করি, যে জীবনদেবতাকে চাই, তিনি নির্গুণ ব্রহ্ম কিংবা জগতের বাইরে অবস্থিত কোনো অতীন্দ্রিয় সত্তা নন। তাঁকে সর্বভূতে প্রত্যক্ষ করা যায়। প্রকৃতি জগতেই পাওয়া যায়। তাঁকে অবশ্য নিছক জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে জানা যায় না। হৃদয় দিয়ে, ভক্তি, প্রীতি ও কর্ম দিয়ে পেতে হয়। এভাবে কেবল জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে নয়। ভক্তি, প্রীতি ও কর্ম দিয়ে সে ঈশ্বরকে মানুষের গভীর সত্তায় আবিষ্কার করা যায়। তিনি মানুষেরই সীমাহীন বিস্তৃতি, মানুষের মধ্যে উপস্থিত মহামানব বা জীবনদেবতা।
জীবনদেবতা ও মানুষের সম্পর্ক : নিয়ে রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা ও মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক তুলে ধরা হলো:
১. জীবনদেবতা ও মানুষের সম্পর্ক নাট্যাভিনেতা ও নাট্য নির্দেশকের সম্পর্কের ন্যায় : রবীন্দ্রনাথের মতে, জীবনদেবতা অবস্থান করেন মানুষের মধ্যে এবং মানুষের মধ্যে থেকেই তিনি পরিচালিত করেন তাঁর জীবনকে। তিনি একই সাথে জীবনের অন্তবর্তী ও অতিবর্তী। তাঁর সাথে মানুষের সম্পর্ক অনেকটা নাট্যকার এবং নাটক নির্দেশকের সম্পর্কের অনুরূপ। “নাট্য নির্দেশকের অভিনেতার সাথে যেমন একটা প্রীতির সম্বন্ধ আছে এবং তিনি তাঁকে কিভাবে কি অভিনয় করতে হবে শিখিয়ে দিয়েছেন (যেমন- অভিনেতা ঠিকমতো অভিনয় করেছেন কিনা তা দেখে তিনি সাফে আনন্দ পেয়েছেন, অসাফল্যে বেদনা পেয়েছেন ঠিক তেমনি জীবনদেবতা জীবননাট্যের অভিনয়েও আছেন, তার বাইরেও আছেন। তিনি ব্যক্তিবিশেষের মধ্য দিয়েই তার সহযোগিতা নিয়ে নিজের ইচ্ছাটি পূরণ করতে চেয়েছেন।”
২. জীবনদেবতা ও মানুষ একে অপরের উপর নির্ভরশীল : জীবনদেবতা অসীম ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু অসীম জগৎকে বাদ দিয়ে তিনি থাকতে পারেন না। লীলা উপভোগের আকাঙ্ক্ষা থেকেই বিশ্ব সৃষ্টি। আর এ প্রেমলীলা প্রকাশের জন্য ঈশ্বরেরও ভক্তকে প্রয়োজন আছে।” মোটকথা অসীম ঈশ্বর ও সসীম মানুষ উভয়ে পারস্পরিক সম্বন্ধে আবদ্ধ, একে অপরের উপর নির্ভরশীল। ঈশ্বর অসীম, কিন্তু তাই বলে সসীম, অবাস্তব ও শক্তিহীন নয়। অসীম ঈশ্বর সসীম জীবের মাধ্যমেই কাজ করেন। কিন্তু তবু তাদের ইচ্ছার ও কর্মানুষ্ঠানের স্বাধীনতা আছে এবং তাদের বাস্তবতা ঈশ্বরে সম্পূর্ণ লীন হয়ে যায় না। এ যেন বারিবিন্দু ও সমুদ্রের সমৃদ্ধ। বিন্দুরূপ সসীম মানুষ ব্যাকুলতা অনুভব করে সমুদ্ররূপ ঈশ্বরের জন্য। সসীম অসীমের এ ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধই ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “অসীম সে চায় সীমার নিবিড় সঙ্গ, সীমা হতে চায় অসীমের মাঝে হারা।”
৩. বিশ্বক্রিয়া ও ঐশীক্রিয়া : বিশ্বক্রিয়ার সাথে ঐশীক্রিয়া ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। কারণ স্রষ্টা তাঁর আনন্দরূপ সত্তাকে অভিব্যক্ত করেন সমগ্র সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে। আবার সৃষ্ট মানুষও স্রষ্টার আনন্দলীলায় অংশগ্রহণ করে তার জ্ঞান, প্রেম ও কর্মের মাধ্যমে। এদিক থেকে বিশ্বক্রিয়ার সাথে ঐশীক্রিয়া ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। তবে মানবসত্তায় প্রেয়বোধ ও শ্রেয়বোধ এ দু’টি উপাদান রয়েছে।
৪. শ্রেয়বোধ ও প্রেয়বোধ : শ্রেয়বোধের মধ্য দিয়ে মানুষ ক্রমান্বৰে৷ বিকাশ লাভ করে, তার মনুষ্যত্বকে অর্জন ও উপলব্ধি করে। অন্যদিকে জ্ঞান, বুদ্ধি ও সত্যিকারের উপলব্ধির অভাবে অত্যন্ত শক্তি বা প্রেয়বোধের প্ররোচনায় মানুষ তাঁর সে উচ্চতর মানবিক অনুভূতি হারাতে থাকে এবং পরিণামে পরিপূর্ণ মনুষ্যত্বের উপলব্ধি থেকে বঞ্চিত হয়। শেষ ও শো, শুভ ও অশুভের এ লড়াই জগৎ সংসার ও মানবজীবনে নিয়ত ক্রিয়াশীল। এতে জয়ী হন তারাই, যাঁরা শত প্রতিকূলতা ও মানুষী সীমাবদ্ধতার মধ্যেও জ্ঞান, প্রীতি, কর্মের সামঞ্জস্য বিধানে অটল থাকেন।
৫. প্রেমের সম্পর্ক : রবীন্দ্রনাথের মতে, “একক মনুষ্যত্বের মধ্যে মুক্তি নেই। মুক্তি নিহিত সমগ্র মানব সংসারের পূর্ণ প্রকাশে। একটি প্রদীপ যেমন রাতের অন্ধকার দূরীভূত করতে পারে না, তেমনি একক ব্যক্তির চেষ্টায়ও সমাজের ব্যাপক কল্যাণ সাধিত হয় না। এর জন্য প্রয়োজন সকল মানুষের সমবেত প্রচেষ্টা। এটাই মানুষের পূর্ণতার সাধনা। এ সাধনায় মানুষকে সহায়তা করার জন্যেই যুগে যুগে আবির্ভূত হয়েছেন বহু মহৎপ্রাণ মহাপুরুষ।”
রবীন্দ্রনাথ জগৎ সংসারকে দেখেছেন এক নিরবকাশ প্রেমের লীলা হিসেবে। আর মানুষকে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন জ্ঞান, প্রেম ও কর্মের মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপন করতে। জ্ঞান থেকে পাওয়া যায় সত্যপথে চলার নির্দেশ। কিন্তু নিছক জ্ঞানের মধ্যে প্রেম ও কর্মের উদ্যান নেই। জীবনে কল্যাণের প্রেরণা আসে প্রেম থেকে। তাই জ্ঞান ও কর্মকে সার্থক করে তুলতে হলে প্রেম অপরিহার্য। মনে রাখতে হবে জ্ঞানহীন কর্ম মানুষকে অধঃপতিত করে পশুত্বের স্তরে। আর প্রেমহীন কর্ম তাকে চালিত করে হিংস্রতার দিকে। বুদ্ধিবৃত্তির অবলম্বনে, জ্ঞানের পথে অগ্রসর হলে আমাদের মনে জাগে বিশ্বের অখণ্ডতাবোধ।সে বোধ থেকে যখন সঞ্চারিত হয় প্রীতি, তখনই আমরা অনুপ্রাণিত হই পরহিত সাধনে। এ প্রেম-প্রীতিসঞ্জাত কর্ম পরিচালিত হয় না সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তা দ্বারা, বরং তাই মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে বিশ্বমানবতাবোধে। কর্মের সাথে যখন যথার্থ সংযোগ ঘটে প্রীতির তখন পরহিতে মানুষ পায় সে নির্মল আনন্দ; যা যা পেয়ে থাকেন, তাঁর সন্তানের সেবা করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, রবীন্দ্রনাথের দর্শনের সর্বজনীন আবেদনের কথা বলতে গিয়ে প্রবোধচন্দ্র সেন যথার্থই বলেছেন, “রবীন্দ্রনাথ এমন এক ধর্ম, এমন এক জীবনদর্শনের পক্ষপাতী, যাতে জ্ঞান, প্রেম ও কর্ম মিলিত হয়েছে, যাতে উপনিষদের ন্যসাধনা, বৌদ্ধধর্মের মৈত্রীকরুণা ও খ্রিস্টধর্মের প্রেমভক্তি একত্র সমন্বিত হয়েছে, অথচ যা সর্বতোভাবেই আধুনিক শিক্ষিত মব উপযোগী। সে মন একান্তভাবেই সাম্প্রদায়িক ভেদ-বিভেদ, আচার পদ্ধতি ও আনুষ্ঠানিকতার বিরোধী”। জ্ঞান, প্রেম, কর্মের সমন্বয়ে মানুষের মধ্যে যে অসীমের প্রেরণা, সে প্রেরণাকে নিজের জীবনে, সমাজে, রাষ্ট্রে তথা সমগ্র বিশ্বে প্রয়োগ করেই মানুষ পারে তার মনুষ্যত্বকে বিকশিত করতে। সীমার মধ্যে অসীমের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ পেতে। আর এজন্যই তো নিদারুণ দুঃখ-দুর্দশা, বহু ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে মহাজ্ঞানী মহামানবের৷ সোৎসাহে এগিয়ে গিয়েছেন তাঁদের সকল কর্মকাণ্ডের সাথে প্রীতির সংযোগ ঘটাতে, উদ্যোগী হয়েছেন ব্যাপক ও স্থায়ী মানবকল্যাণ প্রতিষ্ঠার মহান ব্রতে।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*