দর্শনে রেনেসাঁর প্রভাব আলোচনা কর।


অথবা, রেনেসাঁ দর্শনের প্রভাব আলোচনা কর।
অথবা, রেনেসাঁ দর্শনের বিস্তার ও প্রভাব আলোচনা কর।
অথবা, রেনেসাঁ কীভাবে দর্শনকে প্রভাবিত করেছে বলে তুমি মনে কর?
অথবা, দর্শনকে রেনেসাঁ কীভাবে প্রভাবিত করেছে? ব্যাখ্যা কর।
উত্তরা।। ভূমিকা :
সভ্যতার ইতিহাসে রেনেসাঁ একটি অতি তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ। মানবসভ্যতাকে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে নিয়ে আসার পিছনে রেনেসাঁ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। প্রাচীন কালে গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল প্রমুখ দার্শনিকদের শিক্ষা ও দর্শন এবং টলেমি, আর্কিমিডিস প্রমুখের আবিষ্কার মানবসভ্যতার ও আনবিজ্ঞানের বিকাশে অনন্য অবদান রেখেছে। মধ্যযুগেও জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চায় বিশেষ সাফল্য অর্জিত হয়নি। কিন্তু আধুনিক হুযুগ (১৪৫৩-১৬৯০) খ্রিস্টাব্দকাল পর্যন্ত ইতিহাসে অনন্য মহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে। এ কাল রেনেসাঁর কাল হিসেবে পরিচিত।
রেনেসাঁ : রেনেসাঁ কথাটির অর্থ হলো ‘পুনর্জন’। সাধারণত রেনেসাঁ বলতে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্য, দর্শন, শিল্পকলা প্রভৃতি সম্পর্কে জানবার এক অদম্য উৎসাহ বুঝায়। প্রাচীন সবকিছু জেনে তা যুক্তিতর্কের দ্বারা বুঝে তা হতে যা ভালো তা গ্রহণ করার আগ্রহ রেনেসাঁর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু ব্যাপকভাবে এবং মূল অর্থের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে রেনেসাঁ বলতে মনের এক নতুন স্বাধীন সাহসম্পূর্ণ চেতনা এবং বলিষ্ঠ সমালোচনা ও অনুসন্ধিৎসার মনোবৃত্তি বুঝায়। এ নবজাগরণ কেবলমাত্র প্রাচীন গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্য বা দর্শনেই সীমাবদ্ধ রইল না। অর্থনীতি, বিজ্ঞান, ভাস্কর্য, ফলিতকলা সর্বক্ষেত্রেই এক নতুন চেতনা এবং দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হলো। এরূপ নবজাগরণের সাথে মানুষের মনে এক নতুন ধর্মনিরপেক্ষ জীবন ও সমাজের আশা জাগল। এক নতুন, সহঙ্গ ও স্বাধীন আদর্শে তারা অনুপ্রাণিত হয়ে উঠল।
ঐতিহাসিক Davies রেনেসাঁ সম্পর্কে বলেছেন, “The word renaissance signifies the rebirth of the freedom loving adventurous thought of man, which during the middle ages had been fettered and imprisoned.” [The Beginning of Modern Times : Davies, P-384]
রেনেসাঁ মানুষের চিন্তাচেতনায় এমন কতকগুলো আদর্শ গড়ে তুলেছিল যা মানুষকে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণের সুযোগ দিয়েছে। প্রকৃতিবাদ, পূর্ণতাবাদ এবং মানবতাবাদ তাছাড়া আধুনিক যুগে গণতন্ত্রের উন্মেষ, রাষ্ট্রের জন্ম, রণযন্ত্র, কম্পাস প্রভৃতি আবিষ্কার এবং নব আবিষ্কৃত বাণিজ্য পথ ও নতুন ভাবধারা সব মিলিয়েই রেনেসাঁ সর্বতোভাবে ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। এজন্য রেনেসাঁকে বলা হয় জগৎ ও জীবনের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার
রেনেসাঁর বিস্তার ও প্রভাব : রেনেসাঁ প্রথম ইতালিতে শুরু হয় এবং পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করে। ক্রমে ক্রমে ইউরোপের অপরাপর দেশে বিস্তৃত হয়। ইউরোপের অন্যান্য দেশ বাদ দিয়ে ইতালিতে প্রথম রেনেসী শুরু হওয়ার কারণগুলো হলো :
১. ভৌগোলিক কারণ : ইতালির ভৌগোলিক অবস্থান রেনেসাঁ প্রস্তুতির পক্ষে বিশেষ সহায়ক ছিল। ভূমধ্যসাগরের মধ্যবর্তী তীরে অবস্থিত থাকায় ইতালি এ অঞ্চলের নিজস্ব ও সংস্কৃতির কেন্দ্র ছিল।
২. বাণিজ্যের অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি : ক্রুসেডের ফলে ইউরোপ ও আরব দেশের মধ্য যে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছিল ইতালি।ফ্লোরেন্স,স্পেলস, ভেনিস, মিলান প্রভৃতি ছিল ইতালির বাণিজ্যিক পুঁজিবাদী শহর। অর্থনীতি সেখানে খুবই সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। বাণিজ্যিক অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ফলেই ইতালির শহরগুলোতে রেনেসাঁ সমৃদ্ধি লাভ করে।
৩. কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের প্রভাব : ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে তুর্কিদের হাতে কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন হলে সেখানকার পণ্ডিতগণ তাদের বহু মূল্যবান গ্রন্থাদি নিয়ে ইতালিতে চলে আসেন। তাঁরা ইতিহাসের দর্শন, কাব্য ও ধর্মশাস্ত্রে অগাধ জ্ঞান রাখতেন। তাঁদের সাহিত্য সাধনার ফলে ইতালিতে সর্বপ্রথম রেনেসাঁ শুরু হয়।
৪. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রভাব : এ সময় ইতালিতে বহুসংখ্যক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এসব স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ধর্মনিরপেক্ষ বাস্তব জীবনের সাথে সম্পর্কযুক্ত যা রেনেসাঁর বিকাশে অধী ভূমিকা পালন করে।
৫. গির্জার ভূমিকা : রোমের গির্জা সমগ্র খ্রিস্টান ধর্মালম্বীদের একই সূত্রে আবদ্ধ করে রেখেছিল। এসব গির্জায় শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চর্চা হতো। গির্জাগুলো রেনেসাঁ সৃষ্টিতে সহায়ক ছিল।
৬. রোমান সভ্যতার সাথে যোগাযোগ : ইতালিতে রেনেসাঁ শুরু হওয়ার অপর একটি কারণ ছিল ইতালির বিভিন্ন উপদ্বীপের সাথে রোমান নগরীর ঘনিষ্ঠতা। ইতালির উপর প্রাচীন রোমান সভ্যতা ও সংস্কৃতির গভীর প্রভাব ছিল। ইউরোপের অন্যান্য দেশের সাথে রোমান সভ্যতার যোগাযোগ ছিল না। ফলে ইতালিতেই রেনেসাঁর সূত্রপাত হয়।
৭. অভিজাত শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা : ইতালির বিভিন্ন শহরের ধনী ব্যবসায়ী এবং অভিজাত শাসকগণ শিল্পকলা, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা করতো। তাদের মধ্যে ফ্লোরেন্সের মেডেসি পরিবার, মিলানের স্কোর্জা পরিবার ছিল অন্যতম।
৮. ইতালীয় মানবতাবাদীদের প্রভাব : ইতালীয় মানবতাবাদীদের মধ্যে সাহিত্যে দান্তে, পেত্রার্ক, বোকাচ্চ প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্য পাঠ করে এর সাংস্কৃতিক মূল্য নিরূপণ করেন। তাইতো Ergang বলেছেন, “Theory are creator of Italian literature author of the greatest Italian lyrics and father of Italian sore.”
৯. বিভিন্ন জাতির মিলন কেন্দ্র : ইতালি ছিল তৎকালীন ইউরোপের বহুজাতির মিলন কেন্দ্র। প্রথম রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংসের সময় (৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ) থেকে ইতালি, লোম্বার্ড, ফ্রাঙ্ক, স্যারাসেন, নর্মান ও জার্মান জাতির মিলন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। ফলে বিভিন্ন জাতির কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সেখানকার মনে নবচেতনা ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করে।আলোচ্য যুগকে রেনেসাঁ বলার কারণ : শুধু সাহিত্য ও দর্শনেই নয়, জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাদের এ জিজ্ঞাসু দৃষ্টি প্রসারিত হলো। অর্থনীতি, ভাস্কর্য, শিল্পকলা প্রভৃতি বিষয়ে এক সৃজনশীল নতুন চেতনা ও সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। এভাবেই পশ্চিম ইউরোপের মানুষের মধ্যে তার লুক্কায়িত শক্তি ও সম্ভাবনা সম্পর্কে এক ব্যাপক ও সুগভীর চেতনা জেগে উঠল। এ শক্তি ও সম্ভাবনার বাস্তব ও ফলপ্রসূ রূপ দেওয়ার জন্য মানুষ তখন তৎপর হয়ে উঠল। এজন্য আলোচ্য যুগটিকে রেনেসাঁ নবজাগরণ বা জ্ঞানের পুনরুজ্জীবন বলে অভিহিত করা হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, রেনেসাঁর প্রভাবে বা উদ্ভবের ফলে শুধু সাহিত্য ও দর্শনে নয়, জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। মানুষের ধর্মান্ধ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সাধিত হয়ে নতুন সম্ভাবনার দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচিত হতে থাকে। রেনেসাঁর ব্যাপক উন্নতির ফলশ্রুতি হিসেবে আজকে আমরা আধুনিক যুগের দর্শন পেয়েছি। তাই মানব ইতিহাসে রেনেসাঁর গুরুত্ব অপরিসীম।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a6%9e%e0%a7%8d%e0%a6%9a%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%89%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a6%b6-%e0%a6%8f%e0%a6%ac%e0%a6%82-%e0%a6%ac%e0%a6%bf/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*