ড জি সি দেবের সমন্বয়ী ভাববাদ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, জি. সি. দেবের সমন্বয়ী ভাববাদ কী?
অথবা, জি. সি. দেবের সমন্বয়ী ভাববাদ আলোচনা কর।
অথবা, জি. সি. দেবের সমন্বয়ী ভাববাদ বর্ণনা কর।
উত্তর।। ভূমিকা :
জগৎ ও জীবনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে দর্শনের ইতিহাসে দুটি প্রধান ধারার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এর একটি ভাববাদ, অপরটি বাস্তববাদ। আর এ দুটি ধারার দ্বন্দ্ব অতি সুপ্রাচীনকাল হতে চলে আসছে। চলমান জগৎ সত্তার নিরপেক্ষ অস্তিত্বে বিশ্বাসী বস্তুবাদ। এতে সাধারণ মানুষের জরুরি চাহিদার কথা স্বীকৃত। আর ভাববাদের মূলকথা হলো জড় এবং প্রত্যক্ষকে অস্বীকার করা। অর্থাৎ, ভাববাদের কাছে ইহলোকের মূল্য নেই। আর বাস্তববাদীদের কাছে পরলোক মূল্যহীন। আর এ ভাববাদের সাথে বস্তুর, চেতনার সাথে জড়ের তথা ভাববাদের সাথে বাস্তববাদের সমন্বয়সাধনই ছিল তাঁর জীবনদর্শনের মূল সুর। আর সেজন্য তিনি তাঁর দর্শনকে জীবনদর্শন তথা সমন্বয়ী দর্শন বা জীবনবাদ বলে উল্লেখ করেন।
সমন্বয়ী ভাববাদ : ড. দেব বস্তুবাদ ও ভাববাদের সনাতন পদ্ধতির সমালোচনা করেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে,মানুষের জন্য সুখী ও সুন্দর জগৎ সৃষ্টি করতে হলে ভাববাদে ডুবে থাকলে চলবে না, ভাববাদের সাথে বস্তুবাদের সমন্বয় করতে হবে এবং দর্শনকে নিয়োজিত করতে হবে সাধারণ মানুষের মাঝে। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের জীবনে দুটো দিক রয়েছে, যথা : জাগতিক ও আধ্যাত্মিক। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে নিয়ে মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবন হতে পারে না।দুটোর সমন্বয়ের ভিতরেই মানুষের সার্থক জীবন।তাই তিনি ভাববাদের নতুন প্রয়োগে বস্তুবাদের সাথে সমন্বয়ে যে ভাববাদের সৃষ্টি করেছেন তার নাম দিয়েছেন ‘সমন্বয়ী ভাববাদ’।
প্রেম ও কর্মে সমন্বয় : ড. দেবের মতে, “ভাববাদ ও জড়বাদ উভয়ই একে অপরের পরিপূরক। ভাববাদের রয়েছে প্রেমের অনুভূতি এবং বাস্তববাদের রয়েছে কর্মোদ্যম।” কর্মের সাথে প্রেমের মিলন বয়ে আনে আমাদের বাস্তব কল্যাণ।তাই তিনি ভাববাদের নতুন প্রয়োগে বস্তুবাদের সমন্বয়ে যে ভাববাদ সৃষ্টি করেছেন তার নাম দিয়েছেন ‘সমন্বয়ী ভাববাদ’। এ বিষয়টিকে ড. দেব ‘Half of the Hen’ নামক একটি নীতিগর্ভ রূপক কাহিনীর মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, মুরগি কেটে দু’ভাগ করে যে অংশ ডিম দেয়, ডিমের আশায় সে অংশগ্রহণ করে বাকি অংশ বর্জন করার মধ্যে যে মূঢ়তা
আছে, জড়বাদ বাদ দিয়ে ভাববাদ গ্রহণ করার মধ্যেও সেই একই মূঢ়তা রয়েছে। সেজন্যই তিনি পুরো মুরগিটি রাখতে চান । অর্থাৎ, ভাববাদ ও বাস্তববাদের মিলন ঘটাতে চান।
বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার সমন্বয় : ড. দেব সমন্বয়ী ভাববাদের সমর্থনে বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার ভূমিকা বিশদভাবে আলোচনা করেন। তিনি ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধির সমন্বয়সাধন করেন। ইন্দ্রিয় দিয়ে মানুষ তার বাইরের জগৎ ও তার ভিতরের জগতের বস্তু ও বিষয়ের জ্ঞান লাভ করে আর; বুদ্ধি দ্বারা মানুষ চিন্তা করে, বিচার করে, তথ্য সমীক্ষা করে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। অনুমান বুদ্ধির জ্ঞান। আর এ বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়েই নিশ্চিত জ্ঞান পাওয়া যায় বলে ড. দেব মনে করেন। ড. দেব জগতের সত্যতা স্বীকার করেন, বুদ্ধির যা মূল দাবি, ভাবনার Self-consistency, আত্মসম্পাদিকা ও অপরোক্ষ অনুভবের পরম একের জ্ঞান এভাবে তিনি অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি ও স্বজ্ঞা এ তিনটির মধ্যে সমন্বয় করতে চেয়েছেন।
ভাব ও প্রগতির সমন্বয় : ড. দেব তাঁর ‘Idealism and Progress’ গ্রন্থে ভাববাদের সাথে প্রগতির সমন্বয় করতে চেয়েছেন। তাঁর মত হলো, অধ্যাত্ম সাধনা ও সিদ্ধির সাথে মানুষের জাগতিক উন্নতির বস্তুত শেষ পর্যন্ত কোনো আত্মিক বিরোধ নেই। ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ তাঁর জীবনের আদর্শে প্রাপ্য, বাঞ্ছনীয় ও সিদ্ধি হতে পারে।
মধ্যপথ অবলম্বন : ড. জি.সি দেব এ সমন্বয়ী দর্শনের সন্ধান পেয়েছেন ‘মধ্যপথ’ অবলম্বনে। এ মধ্যপথ অবস্থিত প্রাচীন অধ্যাত্মবাদ ও আধুনিক উগ্র বস্তুবাদের মাঝখানে। মধ্যপথেই যে মানুষের সার্বিক কল্যাণ নিহিত তা তিনি বুঝাতে চেয়েছেন অতীত ইতিহাসের আলোকে। যেমন- প্রাচীনকালের গৌতম বুদ্ধ এ মধ্যপথ অবলম্বনেই সন্ধান পেয়েছিল নির্বাণের।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে আমরা বলতে পারি যে,গোবিন্দ চন্দ্র দেব একজন সমন্বয়বাদী দার্শনিক। তিনি ভাববাদের বিরোধিতার পরিবর্তে সর্বোন্নত অধ্যাত্মবাদের সাথে সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ জড়বাদের সুস্থ পুনর্মিলন দ্বারা অগ্রগতি সাধিত হবে বলে মত প্রকাশ করেন। তার মতে, জড়বাদ ও অধ্যাত্মবাদের মিলনের মধ্য দিয়েই বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*