ডাহুক :কবিতা, ফররুখ আহমদ

ডাহুক

ডাহুক -ফররুখ আহমদ
রাত্রিভর ডাহুকের ডাক…
এখানে ঘুমের পাড়া, স্তব্ধদীঘি অতল সুপ্তির ।
দীর্ঘ রাত্রি একা জেগে আছি ।
ছলনার পাশা খেলা আজ পড়ে থাক,
ঘুমাক বিশ্রান্ত শাখে দিনের মৌমাছি,
কান পেতে শোনো আজ ডাহুকের ডাক ।
তারার বন্দর ছেড়ে চাঁদ চলে রাত্রির সাগরে
ক্রমাগত ভেসে পালক মেঘের অন্তরালে,
অশ্রান্ত ডুবুরি যেন ক্রমাগত ডুব দিয়ে তোলে
স্বপ্নের প্রবাল ।
অবিশ্রাম ঝরে ঝরে পড়ে
শিশির পাখার ঘুম,
গুলে-বকৌলির নীল আকাশ মহল
হয়ে আসে নিসাড় নিঝুম,
নিভে যায় কামনা-চেরাগ;
অবিশ্রান্ত ওঠে শুধু ডাহুকের ডাক ।
কোন ডুবুরির
অশরীরী যেন কোন্ প্রচ্ছন্ন পাখির
সামুদ্রিক অতলতা হতে মৃত্যু-সুগভীর ডাক উঠে আসে,
ঝিমায় তারার দীপ স্বপ্নাচ্ছন্ন আকাশে আকাশে ।
তুমি কি এখনো জেগে আছ?
তুমি কি শুনছ পেতে কান?
তুমি কি শুনছ সেই নভঃগামী শব্দের উজান?
ঘুমের নিবিড় বনে সেই শুধু সজাগ প্রহরী!
চেতনার পথ ধরি চলিয়াছে তার স্বপ্ন-পরী,
মন্থর হাওয়ায় ।
সাথী তন্দ্রাতুর ।
রাত্রির পেয়ালা পুরে উপচিয়া পড়ে যায় ডাহুকের সুর ।
শুধু সুর ভাসে
বেতস বনের ফাঁকে চাঁদ ক্ষয়ে আসে
রাত্রির বিষাদ ভরা স্বপ্নাচ্ছন্ন সাঁতোয়া আকাশে ।
মনে হয় তুমি শুধু অশরীরী সুর!
তবু জানি তুমি সুর নও,
তুমি শুধু সুরযন্ত্র! তুমি শুধু বও
আকাশ-জমানো ঘন অরণ্যের অন্তর্লীন ব্যথাতুর গভীর সিন্ধুর
অপরূপ সুর…
অফুরান সুরা…
ম্লান হয়ে আসে নীল জোছনা বিধুরা
ডাহুকের ডাকে ।
হে পাখি! হে সুরাপাত্র! আজো আমি
চিনিনি তোমাকে ।
হয়তো তোমাকে চিনি, চিনি ঐ চিত্রিত তনুকা,
বিচিত্র তুলিতে আঁকা
বর্ণ সুকুমার ।
কিন্তু যে অপূর্ব সুরা কাঁদাইছে রাত্রির কিনার
যার ব্যথা-তিক্ত রসে জমে ওঠে বনপ্রান্তে বেদনা দুঃসহ
ঘনায় তমালে, তালে রাত্রির বিরহ
সেই সুর পারি না চিনিতে ।
মনে হয় তুমি শুধু সেই সুরাবাহী
পাত্র ভরা সাকী ।
উজাড় করিছ একা সুরে ভরা শারাব-সুরাহি
বনপ্রান্তে নিভৃত একাকী ।
হে অচেনা শারাবের ‘জাম!’
যে সুরার পিপাসায় উন্মুখ, অধীর অবিশ্রাম
সূর্যের অজানা দেশে
তারার ইশারা নিয়ে চলিয়াছ একমনে ভেসে
সুগভীর সুরের পাখাতে,
স্তব্ধ রাতে
বেতস প্রান্তর ঘিরে
তিমির সমুদ্র ছিঁড়ে
চাঁদের দুয়ারে
যে সুরার তীব্র দাহে ভেসে চল উত্তাল পাথারে,
প্রান্তরে তারার ঝড়ে
সেই সুরে ঝরে পড়ে
বিবর্ণ পালক,
নিমিষে রাঙায়ে যায় তোমার নিস্প্রভ তনু বিদ্যুৎ ঝলক,
তীর-তীব্র গতি নিয়ে ছুটে যায় পাশ দিয়ে উল্কার ইশারা,
মৃত অরণ্যের শিরে সমুদ্রর নীল ঝড় তুলে যায় সাড়া
উদ্দাম চঞ্চল;
তবু অচপল
গভীর সিন্ধুর
সুদুর্গম মূল হতে তোলা তুমি রাত্রিভরা সুর ।
ডাহুকের ডাক…
সকল বেদনা যেন, সব অভিযোগ যেন
হয়ে আসে নীরব নির্বাক ।
রাত্রির অরণ্যতটে হে অশ্রান্ত পাখি!
যাও ডাকি ডাকি
অবাধ মুক্তির মতো ।
ভারানত
আমরা শিকলে,
শুনিয়া তোমার সুর, নিজেদেরি বিষাক্ত ছোবলে
তুনমন করি যে আহত ।
এই ম্লান কদর্যের দলে তুমি নও,
তুমি বও
তোমার শৃঙ্খল-মুক্ত পূর্ণ চিত্তে জীবনমৃত্যুর
পরিপূর্ণ সুর ।
তাই তুমি মুক্তপক্ষ নিভৃত ডাহুক,
পূর্ণ করি বুক
রিক্ত করি বুক
অমন ডাকিতে পারো । আমরা পারি না ।
বেতস লতার তারে থেকে থেকে বাজে আজ বাতাসের বীণা,
ক্রমে তাও থেমে যায়;
প্রাচীন অরণ্যতীরে চাঁদ নেমে যায়
গাঢ়তর হল অন্ধকার ।
মুখোমুখি বসে আছি সব বেদনার
ছায়াচ্ছন্ন গভীর প্রহরে ।
রাত্রি ঝরে পড়ে
পাতার শিশিরে…
জীবনের তীরে তীরে…
মরণের তীরে তীরে…
বেদনা নির্বাক ।
সে নিবিড় আচ্ছন্ন তিমিরে
বুক চিরে, কোন্ ক্লান্ত কন্ঠ ঘিরে দূর বনে ওঠে শুধু
তৃষাদীর্ণ ডাহুকের ডাক ।।

ক-বিভাগ

ফররুখ আহমদ কত সালে জন্মগ্রহণ করেন?
উত্তর : ১৯১৮ সালের ১০ জুন।
ফররুখ আহমদ কত সালে মৃত্যু বরণ করেন?
উত্তর : ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর।
ফররুখ আহমেদ কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?
উত্তর : মাগুরা জেলার মাঝআইল গ্রামে।
ফররুখ আহমেদ কোন আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন?
উত্তর : ইসলামি ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনে।
‘ইসলামি রেঁনেসাসের’ কবি বলা হয় কাকে?
উত্তর : ফররুখ আহমদকে।
ফররুখ আহমদের প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম কী?
উত্তর : ‘সাত সাগরের মাঝি’ (১৯৪৪)।
ফররুখ আহমদের অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের নাম কী?
উত্তর : সিরাজাম মুনীরা (১৯৫২), নৌফেল হাতেম (১৯৬১), হাতেমতায়ী (১৯৬৬)।
ফররুখ আহমদের সনেট সংকলন রচনা কোনটি?
উত্তর : ‘মহূর্তের কবিতা’ (১৯৬২)।
ফররুখ আহমদের শিশুতোষ রচনা কোনগুলো?
উত্তর : পাখির বাসা, নতুন লেখা, হরফের ছড়া, ছড়ার আসর, হে বন্য স্বপ্নেরা, হাবেদা মরুর কাহিনী প্রভৃতি।
ফররুখ আহমদ সাহিত্যকর্মের জন্য কোন কোন পুরস্কার লাভ করেন?
উত্তর : ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ (১৯৬০), পাকিস্তান সরকারের প্রেসিডেন্ট পুরস্কার ‘প্রাইজ অব পারফরমেন্স’ (১৯৬১), ‘আদমজী
পুরস্কার’ (১৯৬৬), ‘ইউনেস্কো পুরস্কার’ এবং মরণোত্তর ‘একুশে পদক’।
ফররুখ আহমদের রচিত কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য কী?
উত্তর : আরবি-ফারসি শব্দের নিপুণ ব্যবহার, বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের অভিনবত্ব।
‘ডাহুক’ কবিতায় কোন কবিতার প্রভাব আছে?
উত্তর : ইংরেজি সাহিত্যে স্কাইলার্ক পাখিকে অবলম্বন করে রচিত হয়েছে অনেক বিখ্যাত কবিতা। ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও শেলীর বিখ্যাত
কবিতা ‘টু এ স্কাইলার্ক’- মূলত এ কবিতা দুটির প্রভাব ‘ডাহুক’ কবিতায় স্পষ্ট।
‘ডাহুক’ কবিতায় কোন পাড়ার কথা বলা হয়েছে?
উত্তর : ঘুমের পাড়া।
‘ডাহুক’ কবিতায় কোন জাতীয়/কার পাশা খেলা পড়ে থাকে?
উত্তর : ছলনার।
‘ডাহুক’ কবিতায় বিভ্রান্ত শাখে কার ঘুমের কথা বলা হয়েছে?
উত্তর : মৌমাছির।
‘ডাহুক’ কবিতায় অভ্রান্ত ডুবুরি ডুব দিয়ে কী তোলে?
উত্তর : স্বপ্নের শৈবাল।
‘ডাহুক’ কবিতায় ঘুমের নিবিড় কে কে শুধু সজাগ প্রহরী?
উত্তর : ডাহুক সজাগ প্রহরী।
‘ডাহুক’ কবিতায় ডাহুকের ডাকে কী ম্লান হয়ে আসে?
উত্তর : নীল জোছনা বিধুরা ।
‘ডাহুক’ কবিতায় কবি ডাহুক পাখিকে কী বলে সম্বোধন করেছে?
উত্তর : সুরাপাত্র।
ডাহুক’ কবিতায় পূর্ব দিগন্তে কী জেগেছে?
উত্তর : আলোর গান।
‘গুলে বকৌলি’ কী?
উত্তর : মধ্যযুগের বাংলা কাব্য ।
‘বেতসেবন’ কী?
উত্তর : বেতের বাগান।
‘শারাব-সুরাজি’ কী?
উত্তর : মদ যে পাত্রে রাখা হয়।
‘তনুমন’ কী?
উত্তর : দেহমন।
‘তৃষাদীর্ণ’ কী?
উত্তর : তৃষ্ণায় কাতর ।

খ-বিভাগ

প্রশ্ন॥১৷ কবি ফররুখ আহমদ সম্পর্কে তোমার মতামত দাও।
প্রশ্ন॥২॥ ‘ডাহুক’ কবিতার মূলভাব লেখ।
প্ৰশ্ন।৩।এখানে ঘুমের পাড়া স্তব্ধদীঘি অতল সুপ্তির! দীর্ঘ রাত্রি একা জেগে আছি।”- ব্যাখ্যা কর।
প্রশ্ন॥৪॥ “সামগ্রিক অতলতা হতে মৃত্যু সুগভীর ডাক উঠে আসে, ঝিমায় তারার দীপ স্বপ্নাচ্ছন্ন আকাশে আকাশে।”— ব্যাখ্যা কর।
প্রশ্ন॥৫॥ “ঘুমের নিবিড় বনে সেই শুধু সজাগ প্রহরী। চেতনার পথ ধরি চলিয়াছে তার স্বপ্নপরী মন্থর হাওয়ায়।”— ব্যাখ্যা কর।
প্রশ্ন॥৬॥ মনে হয় তুমি শুধু অশরীরী সুর! তবু জানি তুমি সুর নও, তুমি শুধু সুরযন্ত্র! তুমি শুধু বও আকাশ জমানো ঘর অরণ্যের অন্তলীন ব্যথাতুর গভীর সিন্ধুর।”—ব্যাখ্যা কর।
প্রশ্ন॥৭॥ “হে পাখি। হে সুরাপাত্র আজো আমি চিনি নি তোমাকে।”- ব্যাখ্যা কর।
প্রশ্ন॥৮॥ “হয়তো তোমাকে চিনি, চিনি ঐ চিত্রিত তনুকা, বিচিত্র তুলিতে আঁকা বর্ণ সুকুমার।”— ব্যাখ্যা কর।
প্রশ্ন॥৯॥ “ডাহুকের ডাক সকল বেদনা যেন সব অভিযোগ যেন হয়ে আসে নীরব নির্বাক।”- ব্যাখ্যা কর।
প্রশ্ন॥১০॥ “ভারানত আমরা শিকলে, শুনি না তোমার সুর, নিজেদেরি বিষাক্ত ছোবলে তনুমন করি যে আহত।”- ব্যাখ্যা কর।
প্রশ্ন॥১১৷ “এ ম্লান কদর্যের দলে তুমি নও, তুমি বও তোমার শৃঙ্খলমুক্ত পুণ্যচিত্তে জীবন-মৃত্যুর পরিপূর্ণ সুর।”— ব্যাখ্যা কর।
প্ৰশ্ন৷১২৷ “তাই তুমি মুক্তপক্ষ নিভৃত ডাহুক পূর্ণ করি বুক, রিক্ত করি বুক অমন ডাকিতে পার। আমরা পারি না।”— ব্যাখ্যা কর।

গ-বিভাগ

প্রশ্ন।১।ফররুখ আহমদ রচিত ‘ডাহুক’ কবিতার সারমর্ম ভাবার্য/মূলভাব/ ভাববস্তু নিজের ভাষায় লেখ।
প্রশ্ন॥২॥ ‘ডাহুক’ কবিতায় ফররুখ আহমদের বেদনা ভারাক্রান্ত যে কবিসত্তার প্রকাশ ঘটেছে তার স্বরূপ বিশ্লেষণ কর।
প্ৰশ্ন।৩৷ ফররুখ আহমদ রচিত ‘ডাহুক’ একটি অনবদ্য আধুনিক কবিতা আলোচন কর।
প্রশ্ন॥৪॥ রূপক কবিতা কাকে বলে? রূপক কবিতা হিসেবে ‘ডাহুক’ এর সার্থকতা বিচার কর।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*