জাতীয় স্বাস্থ্য নীতির কর্মকৌশলসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, জাতীয় স্বাস্থ্য নীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য গৃহীত কর্মকৌশলসমূহ চিহ্নিত কর।
অথবা, জাতীয় স্বাস্থ্য নীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য গৃহীত কর্মকৌশলগুলো কী কী? বর্ণনা কর।
অথবা, জাতীয় স্বাস্থ্য কর্মপদ্ধতিগুলো আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
যে কোনো দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য স্বাস্থ্য সেবার নিশ্চয়তা বিধান করা অপরিহার্য। তবুও স্বাধীনতার পর থেকে স্বাস্থ্য খাতকে প্রয়োজনমতো গুরুত্বের সাথে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়নি। স্বাস্থ্য সেবার যেসব
উদ্যোগ ও কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল, তা ছিল অপূর্ণাঙ্গ এবং অপ্রতুল। ফলে এ দেশের মানুষ বরাবরই যথাযথ স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে নানা রকম রোগ শোকে আক্রান্ত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে ভয়াবহতা অনুধাবন করে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার দেশে যথাযথ স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ন করার প্রয়োজন অনুভব করে। আর এ পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি-২০০০ (National Health Policy-2000) প্রণয়ন করা হয়। দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকরণে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতির গুরুত্ব অপরিসীম।
জাতীয় স্বাস্থ্য নীতির কর্মকৌশল : জাতীয় স্বাস্থ্য নীতির মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজের সকল স্তরের জনগণের যথাযথ স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা। জাতীয় শিশু নীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ অর্জন করার জন্য কতকগুলো কর্মকৌশল (Policy Strategies) চিহ্নিত করা হয়েছে, যা নিয়ে আলোচনা করা হলো :
১. স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ের সাশ্রয়ীকরণ : যেহেতু স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা সর্বজনীনভাবে গৃহীত, সেহেতু
এ পদ্ধতিতে ব্যাপক ও ব্যয় সাশ্রয়ী স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকরণে প্রাথমিক স্বাস্থ্য নীতিতে গ্রহণ করা হবে।
২. ঔষধ নীতি জোরদারকরণ : দেশে স্বাস্থ্য সেবার চাহিদা পূরণের জন্য জাতীয় স্বাস্থ্য নীতির সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে ঔষধ নীতিকে আরও গ্রহণযোগ্য এবং উন্নত করতে হবে। দেশে বর্তমান সময়ের চাহিদা, নিরাপত্তা, উপকারিতা, ক্রয় ক্ষমতা ও সর্বস্তরে জরুরি ঔষধের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করা দরকার। বাজারে সরবরাহকৃত ঔষধের গুণগত মান এবং ঔষধ তৈরিতে ব্যবহৃত কাঁচামালের মান নিশ্চিত করার জন্য এবং ঔষধের যথাযথ ব্যবহার করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সব রকম
পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে এবং এ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য ঔষধ প্রশাসনে প্রয়োজনমতো দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে।
৩. কর্মসূচির সাথে সমন্বয় সাধন : দেশে রোগ ব্যাধির বিস্তৃতির গতিবিধি ঘনিষ্ঠ নজরদান পদ্ধতিকে রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য কর্মসূচির সাথে এর সমন্বয় সাধন করতে হবে। একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনকে এর মূল দায়িত্ব প্রদান করতে হবে।
৪. মানসম্মত সেবা নিশ্চিতকরণ : দেশের প্রত্যেক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে রোগীর যথার্থ পরিচর্যার ক্ষেত্রে মানসম্মত সেবা নিশ্চিতকরণের মূলনীতি অনুসরণ করা হবে। এ লক্ষ্যে প্রতিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে স্বাস্থ্য সেবার গুণগত মান নিশ্চিতকরণ, মনিটরিং এবং মূল্যায়ন পদ্ধতির উপর একটি সহায়িকা সরবরাহ করা হবে।
৫. সর্বস্যসেবা পুনর্বিন্যাস কমিটি গঠন : দেশে পরিবর্তিত চাহিদা পূরণের তাগিদে স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা খাতের কর্মকৌশল সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্টের উপর ভিত্তি করে একটি স্বাস্থ্য সেবা পুনর্বিন্যাস কমিটি গঠন করা হবে, যার কাজ হবে অবকাঠামোগত অবস্থার উন্নয়ন ও সংস্থার সাধন, প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত মানবসম্পদ উন্নয়ন
পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, সংশ্লিষ্ট কর্মীদের ক্যারিয়ার গঠন পরিকল্পনা, উপকরণ এবং দ্রব্যসামগ্রীর অবস্থা যাচাই, ব্যবস্থাপনা নীতিসহ স্বাস্থ্য সেবার সার্বিক উন্নয়নে পরামর্শ দান।
৬. তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির উন্নতিকরণ : স্বাস্থ্য খাতে একটি সমন্বিত তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি এবং কম্পিউটার যোগাযোগ সমগ্র দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা গৃহীত কর্মসূচি বাস্তবায়নে, কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়নে এবং মনিটরিং করার সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করবে।
৭. বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনকে সম্পৃক্তকরণ : দেশে স্বাস্থ্য সেবার পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নকরণে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল প্রাকটিশনার্স এসোসিয়েশন, আয়ুর্বেদীয়, ইউনানী এবং হোমিওপ্যাথি ফেডারেশন প্রভৃতি পেশাজীবী সংগঠনকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
৮. প্রতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ : দেশের ডাক্তারদের ব্যবস্থাপনা দক্ষতা বৃদ্ধি করার জন্য ব্যবস্থাপনা এবং প্রশাসনিক বিষয়ের উপর যথোপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৯. ন্যূনতম ফি নেয়ার ব্যবস্থা : দেশের সরকারি হাসপাতাল এবং ক্লিনিকের একটি ন্যূনতম ফি নেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে কিন্তু সমাজের দরিদ্র ও অসামর্থ্য রোগীদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা লাভের ব্যবস্থাও থাকবে।
১০. অবকাঠামোগত এবং পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন : গ্রামাঞ্চলে এবং শহরে সেবার বৈষম্য কমিয়ে আনার লক্ষ্যে অবকাঠামোগত এবং পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করতে হবে। সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা ও স্বাস্থ্যকর্মীদের তাদের স্ব-স্ব কর্মস্থলে উপস্থিতি এবং সর্বোত্তম মাত্রায় সেবা প্রদান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা এবং সামাজিক পরিবেশের উন্নয়ন সাধন করা হবে।
১১. নন প্রাকটিস ভাতা প্রদান : যেসব সরকারি চিকিৎসক এবং প্রশিক্ষণার্থী সার্বক্ষণিক ও আবাসিক পদে এবং জরুরি বিভাগে কর্মরত তাদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস হতে বিরত রেখে নন-প্র্যাকটিস ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে।
১২. সকলের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ : দেশে স্বাস্থ্য সেবার সাথে সম্পৃক্ত সকলের জবাবদিহিতা আরও জোরালো করা হবে। এ লক্ষ্যে একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হবে, যার মাধ্যমে জবাবদিহিতা আরও বেশি মাত্রায় নিশ্চিত হয় এবং প্রয়োজনে কাজে অবহেলা করার জন্য দ্রুতগতিতে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।
১৩. স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক কাউন্সিল গঠন : জাতীয় পর্যায়ে দেশের সরকার প্রধানের নেতৃত্বে একটি স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক কাউন্সিল গঠন করা হবে। এ কাউন্সিল জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি বাস্তবায়ন করার জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতা এবং উপদেশ প্রদান করবে।
১৪. সরকারি উৎসাহ প্রদান : স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এবং এর বিভিন্ন পদ্ধতির কার্যকারিতা, ক্লিনিক্যাল সেবাসমূহ, রোগ নির্ণয় প্রক্রিয়া, জনগণের সামাজিক এবং অভ্যন্তরীয় দিকগুলো, মহামারী প্রভৃতি বিষয়ের উপর গবেষণা কর্মকে সরকারিভাবে উৎসাহ প্রদান করা হবে।
১৫. পলিসি প্লানিং সেল গঠন : বিভিন্ন প্রজেক্ট, কার্যক্রম এবং কর্মকাণ্ডের মধ্যদিয়ে এ ধরনের কার্যক্রম গ্রহণের প্রবণতা বর্জন করতে হবে। স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এজন্য একটি পলিসি প্লানিং সেল গঠন করবে, যার দ্বারা কার্যকর ও স্থায়ী সমন্বয় প্রতিষ্ঠিত করা যায়।
১৬. ক্লাফেট কেন্দ্রিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদান : জাতীয় স্বাস্থ্য নীতির লক্ষ্য হবে ব্যক্তি তথা ক্লায়েন্ট কেন্দ্রিক স্বাস্থ্য সেবা এবং প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করা, যেন যার যা চাহিদা সে চাহিদা মোতাবেক সেবা বেছে নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ ধারার ব্যবস্থা জাতীয় স্বাস্থ্য নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হিসেবে বিবেচিত হবে এবং এতে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের
হার কমে যায়।
১৭. আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রদান : দেশের জনগণের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য মেডিকেল কলেজ এবং সংশ্লিষ্ট হাসপাতালসমূহের ব্যবস্থাপনার উন্নতি সাধন করা হবে এবং এগুলোর সব রকম কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য অধিকতর আর্থিক এবং প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রদান করা হবে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, দেশের সর্বস্তরের জনগণের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের লক্ষ্যে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ন করা হয়। আর জাতীয় স্বাস্থ্য নীতির নির্ধারিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে অর্জন করার জন্য উপরে বর্ণিত কর্মকৌশল অবলম্বন করার ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান সংযোজন করা হয়েছে। জাতীয় স্বাস্থ্য নীতির উদ্দেশ্য অর্জিত হলে এ দেশের প্রতিটি মানুষ সর্বোচ্চ মাত্রায় যে স্বাস্থ্য সেবা লাভে সামর্থ্য হবে তা জোর দিয়েই বলা যায়।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*