গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন বলতে কী বুঝ?

অথবা, গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন সম্পর্কে যা জানো লেখ।
অথবা, গৌড়ীয় বৈষ্ণর দর্শন কাকে বলে?
অথবা, গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের পরিচয় দাও।
অথবা, গৌড়ীয় বৈষ্ণৰ দৰ্শনতত্ত্ব কি?
উত্তর।। ভূমিকা :
মধ্যযুগে বাঙালির ধর্ম, মনন ও সাহিত্য সাধনার ইতিহাসে বৈষ্ণববাদ এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। বৈষ্ণণ ধর্মমতের সার বা তত্ত্বকথা নিয়েই গড়ে উঠেছে বৈবাদ বা বৈষ্ণব দর্শন। বিষ্ণুর উপাসকদেরই বলা হয়। বিষ্ণু, হরি বা কৃষ্ণই বৈষ্ণব মতে পরমতত্ত্ব বা ঈশ্বর। বৈষ্ণর দর্শনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা এ মতধারা বিকাশের দুটি পর্যায় দেখতে পাই। যথা চৈতন্য পূর্ব পর্যায় এবং চৈতন্য পর্যায়। বিষ্ণুর উপাসনা বিষয় সর্বাপেক্ষা প্রাচীন দলিল ঋগ্বেদেই চৈতনা পূর্ববর্তী বৈষ্ণব দর্শনের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যাত। আর চৈতন্য পর্যায়ে চৈতন্যই শ্রীকৃষ্ণ অবতাররূপে বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শনের প্রবর্তক। বৈশা ধর্ম ও দর্শনের এ চৈতন্য পর্বই বাংলায় গৌড়ীয় বৈষব দর্শন নামে খ্যাত।
গৌড়ীয় বৈষ্ণদর্শন: গৌড়ীয় বৈবার দর্শনের প্রবর্তক, প্রচারক ও প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদের। বিশিষ্টাদ্বৈতাবাদী রামানুজ প্রেমভক্তিবাদে যে সবপ্রাণের সঞ্চার করেন তাই তক্তিধর্মরূপে পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে শ্রীচৈতন্য দেবের (১৪৮৬-১৫৩৩) হাতে এবং পরিচয় লাভ গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন নামে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন ধর্মে শ্রীকৃষ্ণ সাক্ষাৎ ভগবান, তিনি পরমতত্ত্ব। মহাভারত, বায়ুপুরাণ, বরাহপুরাণ প্রভৃতি পৌরাণিক গ্রন্থে কৃষ্ণ, বিষ্ণু বা নারায়ণের অংশ অবতার হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত দর্শনে শ্রীকৃষ্ণই চৈতন্যরূপে অবতীর্ণ হয়েছেন বলে মনে করা হয়। কৃষ্ণাই একমাত্র পরমপুরুষ, অন্য সব দেবতা তাঁর কলা অংশ, কৃষ্ণাই অবতারী। অন্য সব অবতার তাঁর থেকে উদ্ভূত। কৃষ্ণাই পরম ব্রহ্ম এবং তাঁর শক্তি মারাশক্তিরূণে বিশ্বজগৎ আচ্ছাদন করে রাখে। কৃষ্ণ যে শক্তি বলে বহুরূপে প্রতিভাত হন তার নাম বিলাস শক্তি। নারায়ণ কৃষ্ণের এ বিলাসরূপ। গৌড়ীয় বৈষ্ণার মতে, কৃষ্ণের বিলাস শক্তি দুই প্রকার। যথা প্রভাববিলাস ও বৈভববিলাস। প্রভাব বিলাস গোপীদের সঙ্গে রাসলীলাকালে কৃষ্ণ বহু কৃষ্ণে পরিণত হন। আর বৈভব বিলাসে তিনি বাসুদের (দ্ধি), সৎকর্ষণ (চেতনা), প্রদ্যুম (প্রেম) ও অনিরুদ্ধ (লীলা) এ চতুর্ব্যহরূপ পরিগ্রহ করেন। তন্মধ্যে কৃষ্ণের প্রধান শক্তি গেম। সর্বগুণবতী শ্রীমতি রাধা এ মহান প্রেমভাবের মূর্ত প্রতীক বা তাঁর ভ্লাদিনী শক্তি। গৌড়ীয় বৈষ্ণার মতে, শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র অদ্বঘা জ্ঞানবেদ্য তত্ত্ব। কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর বর্ণনায় অন্বয় জ্ঞানতত্ত্ব ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বরূপশক্তি সমন্বিত তত্ত্ব। সেই অদ্বয় তত্ত্বই স্বরূপ শক্তির দ্বারা অনন্ত বৈকুণ্ঠ বিস্তার করে তাতে স্বীয় স্বরশাংশে ড়ৈশ্বর্যশালী নারায়ণরূপে এবং পরমাত্মা ও অবতারাদি স্বাংশষরূপে বিলাস করেন। কিন্তু বৈকুন্ঠ শ্রেষ্ঠ লোক বলে সবার কাছে পরিচিত। বিষ্ণু পুরাণ অনুসারে এ ‘লোক’ এর অধীশ্বর হলেন ষড়ৈশ্বর্যপূর্ণ, শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মধারী,চতুর্ভুজ, নারায়ণ। এতে নারায়ণই হলেন শ্রেষ্ঠ দেবতা। কিন্তু গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ নারায়ণ অপেক্ষা শ্রীকৃষ্ণকেই উচ্চাসনে স্থান দিয়েছেন। তাই এ মতেই শ্রীকৃষ্ণই পরমতত্ত্ব, তাঁর মধ্যেই ভগবতার পূর্ণ প্রকাশ পেয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের দুই রূপ একটি মুখ্য প্রকাশ এবং অপরটি বিলাস। একই স্বয়ংরূপ যখন যুগপৎ অনেক স্থানে আবির্ভূত হন এবং ঐ প্রকটিত মূর্তি সব যদি শুণলীলাদির দ্বারা সর্বপ্রকারেই মূলরূপে সমান হয় তবে ঐ মূর্তি মূলরূপে মুখ্য প্রকাশ মূর্তি বলে পরিগণিত হয়।আর যিনি প্রায় মূলরূপের তুল্য শক্তিধর কিন্তু আকৃতিতে, বর্ণে ও নামে ভেদ, তাকে বিলাস মূর্তি বলে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতে, নারায়ণই শ্রীকৃষ্ণের বিলাস মূর্তি। তাঁরা শ্রীকৃষ্ণের জন্য নতুন ধাম সৃষ্টি করেছেন। তাঁদের নিকট বৈকুণ্ঠ বা নারায়ণের উপরে শ্রীকৃষ্ণের স্থান নির্ধারিত। আর এ শ্রীকৃষ্ণের নাম জপকীর্তন ও প্রেমভক্তির উপরই গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের মূলভিত্তি প্রতিষ্ঠিত।
উপসংহার : উপযুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা হয় বিষ্ণুর উপাসনা বিষয়ক প্রাচীন দলিল ঋগ্বেদে ব্যাখ্যাত বৈষ্ণব ধর্মদর্শনের যে স্বরূপ তাই নবরূপ ও মার্জিত আকারে প্রেমভক্তিবাদরূপে মধ্যযুগের বাংলায় শ্রীচৈতন্য দেবের হাতে পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে। মধ্যযুগের বাঙালির জীবন চিন্তা, ধর্ম ও সাহিত্য চৈতনা প্রবর্তিত এ গৌড়ীয় বৈষ্ণব দার্শনিক ধারা এক নব ভাব প্লাবনের সৃষ্টি করে। যা তখন থেকে পরবর্তী দুশ বছর বাঙালিকে নিয়োজিত রাখে দার্শনিক তত্ত্ব বিচার, তর্কবিচার ও রসতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a4%e0%a7%83%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*