প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ বলতে কী বুঝ? প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সুবিধা ও অসুবিধা আলোচনা কর।

অথবা, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ কাকে বলে? প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সুফল ও কুফল আলোচনা কর।
অথবা, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সংজ্ঞা দাও। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ভালো দিক ও মন্দ দিক সম্পর্কে বর্ণনা দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বর্তমান কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সরকারের কর্ম পরিধি দিন দিন ব্যাপকতর হচ্ছে। এই ব্যাপক কর্ম কোনো রাষ্ট্রের জাতীয় সরকারের একার পক্ষে সম্পাদন করা সম্ভব নয়। আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রে সরকারের অস্তিত্ব কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। ফলে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সরকারের উদ্দেশ্যাবলি বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত দূরহ ব্যাপার।তাছাড়া উন্নয়ন ও প্রশাসনিক সকল কর্মকাণ্ডে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ বা ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ বাস্তবে যথেষ্ট সমস্যার সৃষ্টি করে। তাই প্রশাসনিক ক্ষমতা কোনো এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত করে না রেখে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইউনিটে ক্ষমতা বণ্টন করলে প্রশাসনিক ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের গতি ত্বরান্বিত হবে এবং বাস্তবায়ন সহজ হবে।
প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ বলতে এমন এক ব্যবস্থাপনা বা প্রশাসনিক পদ্ধতিকে হয় বোঝায় যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা কেন্দ্রেয় বাইরে তথা প্রশাসনিক পদক্রমের সর্বনিম্ন স্তরে হস্তান্তর করা হয়। অর্থাৎ যেখানে প্রশাসনিক সংস্থার কার্য ও দায়িত্ব কোনো কেন্দ্রীয় সংস্থায় নিয়োজিত না থেকে বিভিন্ন অধস্তন সংস্থাসমূহে বা কেন্দ্র হতে প্রদেশে অথবা স্থানীয় বা আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করা হয়, সেখানে বিকেন্দ্রীকরণ মা নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলা হয়।
প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ নীতির সংজ্ঞা : বর্তমান রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বিকেন্দ্রীকরণ কল্যাণকর রাষ্ট্রের পূর্বশর্ত হিসেবে গণ্য করা হয়। বিকেন্দ্রীকরণ সম্পর্কে বিভিন্ন রাষ্ট্রচিন্তাবিদ ও তাত্ত্বিক গোষ্ঠী ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে এর কতিপয় সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো :
Diana Conyers এর মতে, “Decentralization is the latest fashion of development administration.” Encyclopedia of social science গ্রন্থে বিকেন্দ্রীকরণ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, “বিকেন্দ্রীকরণ হলো সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে নিম্ন পর্যায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর।” এ গ্রন্থে আরো বলা হয়েছে যে,মূলত কর্তৃত্ব একই ব্যক্তি বা সংগঠনের অধীন না রেখে একাধিক আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ বা ইউনিটের নিকট অর্পণ করা হচ্ছে বিকেন্দ্রীকরণ ।
অধ্যাপক অ্যালেন এর মতে, “কেন্দ্র হতে প্রয়োগ করা সম্ভব এমন কর্তৃত্ব ব্যতীত আর সকল কর্তৃত্বের সর্বনিম্ন স্তরে ভার অর্পণের নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়াই হলো বিকেন্দ্রীকরণ।”
এল.ডি. হোয়াইট বলেন যে, বিকেন্দ্রীকরণ বলতে বুঝায় আইন, বিচার বিভাগীয় এবং প্রশাসনিক কর্তৃত্ব সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে নিম্ন পর্যায়ে স্থানান্তর।”
উপরের সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায় যে, রাষ্ট্রের ক্রিয়াকলাপ ব্যাপৃত ও বিস্তৃত করার প্রক্রিয়া হলো বিকেন্দ্রীকরণ । রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে সহযোগিতা, সমঝোতা, অংশীদারিত্ব প্রভৃতি উন্নয়নের স্বার্থেই বিকেন্দ্রীকরণের সৃষ্টি।
প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সুবিধা ও অসুবিধা : আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিকেন্দ্রীকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থার সুবিধা ও অসুবিধা দুই বিদ্যমান। নিম্নে বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ার সুবিধা ও অসুবিধা আলোচনা করা হলো :
বিকেন্দ্রীকরণের সুবিধা বা সুফল : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের অনেকগুলো সুবিধা রয়েছে। নিম্নে এ সুবিধাসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. সহযোগিতা স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি : বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় এবং আঞ্চলিক সরকারের মধ্যে অধিকতর সহযোগিতা স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় প্রশাসন পদ্ধতিতে বিকেন্দ্রীকরণ কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক সকল ক্ষেত্রে কার্যসম্পাদন সহযোগিতা প্রদান করে থাকে ।
২. জনগণের নিয়ন্ত্রণ ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থায় জনগণের নিয়ন্ত্রণ এবং জনঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করে। ফলে একথা বলা যায় যে, বিকেন্দ্রীকরণ নীতি কার্যকরভাবে গণতান্ত্রিক ভাবধারার সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ।
৩. লাল ফিতার দৌরাত্ম্য হ্রাস : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ সরকারি সংগঠনের কার্যে বিলম্ব এবং লাল ফিতার দৌরাত্ম্য হ্রাসে সহায়তা করে। কেননা এক্ষেত্রে আঞ্চলিক অফিসে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হলে কেন্দ্রীয় অফিসে কোনো প্রকার খবর দারির প্রয়োজন হয় না।
৪. সমন্বয় সাধন : সমন্বয় সাধনের জন্য বিকেন্দ্রীকরণ নীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে প্রশাসনিক কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়।
৫. কর্মের সংখ্যা হ্রাস : আঞ্চলিক দপ্তরসমূহে কিছু কার্যভার হস্তান্তরিত করে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ কেন্দ্রীয় দপ্তরের কর্মভার অনেক পরিমাণ লাঘব করতে সহায়ক হয়। এজন্য কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কেন্দ্রীয় দপ্তরে আসার প্রয়োজন পড়ে না।
৬. কর্মচারীদের মনোবল বৃদ্ধি : এরকম প্রশাসনিক ব্যবস্থায় কর্মচারীদের মনোবল বৃদ্ধি পায়। কারণ এ ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয়
এবং আঞ্চলিক দপ্তরের কর্মচারীদের মধ্যকার সকল প্রকার অনিয়ম ভেঙ্গে দিয়ে তাদের মধ্যে সদ্ভাব গড়ে তোলা সম্ভব।
৭. স্বাধীনতার প্রসার : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ফলে আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের স্বাধীনতার প্রসার ঘটে। আঞ্চলিক কর্মকর্তাগণ তখন কেন্দ্রীয় দপ্তরের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে না বরং তারা নিজেদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব খাটিয়ে নতুন উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করে।
৮. প্রত্যাশিত নিয়ন্ত্রণ সহজ হয় : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থায় দায়িত্ব ও ক্ষমতা নির্দিষ্টভাবে ভাগ করে দেওয়া হয় এবং যে কোনো কাজের জন্য দায়ী, কাকে কিভাবে নির্দেশ প্রদান করতে হবে প্রভৃতি বিষয় যথাযথভাবে নির্ধারণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়।
প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের অসুবিধা : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীয়করণের যেমন রয়েছে সুবিধা তেমনি রয়েছে কিছু অসুবিধা । নিম্নে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের অসুবিধাগুলো আলোচনা করা হলো :
১. নীতি নির্ধারণ ও রক্ষায় বাধা সৃষ্টি করে : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ সামগ্রিকভাবে জাতীয় নীতি নির্ধারণ ও রক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। সুষ্ঠু প্রশাসন ব্যবস্থার জন্য যে সমরূপতা এবং ঐক্য প্রয়োজন বিকেন্দ্রীকরণ তা বিনষ্ট করে দেয়। বিশেষ করে যেখানে সরকারের নীতি দেশকে সামগ্রিকভাবে প্রভাবিত করে সেখানে বিকেন্দ্রীকরণ নীতি জটিল প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।
২. দৃষ্টিভঙ্গি সংকীর্ণ হয় : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থায় কর্মচারীদের দৃষ্টিভঙ্গি সংকীর্ণ হয়। কর্মচারীগণ কেবল স্থানীয় এলাকাসমূহে নিজেদের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রাখে। ফলে প্রশাসন ব্যবস্থাপনার নীতিসমূহ সংকীর্ণরূপে পরিগ্রহ করে এবং সামগ্রিক জাতীয় কল্যাণে বাধাপ্রাপ্ত হয়।
৩. কারিগরি বিদ্যা ও কর্ম বিশ্লেষণের পথে বাধা স্বরূপ : বিকেন্দ্রীকরণের অর্থ হলো প্রশাসনকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আঞ্চলিক এককে বিভক্ত করা। এ এককগুলো প্রায়ই কারিগরি বিদ্যা ও কর্ম বিশ্লেষণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
৪. সীমা নির্ধারণ কঠিন : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থায় আঞ্চলিক এলাকার সীমানা নির্ধারণ করা বড় সমস্যা।কর্মের দিক হতে কোনো আঞ্চলিক এলাকা অপর একটি এলাকা হতে সম্পূর্ণ পৃথক হতে পারে। আবার সমস্যার দিক দিয়ে আঞ্চলিক এলাকার মধ্যে পার্থক্য থাকতে পারে।
৫. ব্যয়ভার বৃদ্ধি করে : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের যে সমস্যা বা অসুবিধা বিদ্যমান তার মধ্যে অন্যতম একটি প্রধান সমস্যা হলো প্রশাসনিক ব্যয়ভার বৃদ্ধি। সঠিক ও যথাযথ বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য আঞ্চলিক ক্ষেত্রে দপ্তরসমূহ এবং কর্মচারীদের পরিচালনার জন্য বহু অর্থ ব্যয় করতে হয়।
৬. সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমস্যার সৃষ্টি : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমস্যার সৃষ্টি হয়। সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে প্রশাসনিক সমন্বয়ের ক্ষেত্রে বিলম্ব হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
৭. ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি : অনেক সময় প্রশাসনকে জরুরী অবস্থা মোকাবিলা করতে হয়। যখন জরুরী কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ আবশ্যক হয়ে পড়ে, তখন বিভিন্ন আঞ্চলিক দপ্তর বা কর্মকর্তাদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে।
৮. কর্মচারীদের অযোগ্য ও অদক্ষতার পরিচয় দেয় : আঞ্চলিক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থায় নিয়োজিত কর্মচারীগণ অনেকটা অযোগ্যতা ও অদক্ষতার পরিচয় দিয়ে থাকে। এসকল নিম্নতম কর্মচারীগণ অনেক সময় বিচক্ষণতার সাথে কার্য সম্পাদন করতে সক্ষম হয় না।
উপসংহার : উপরের আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সুফল ও কুফল বা সুবিধা ও অসুবিধা উভয়ই বিদ্যমান । প্রশাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রীকরণ বা বিকেন্দ্রীকরণ কোনটাই এককভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। কাজেই উত্তম প্রশাসনের জন্য উভয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন সবচেয়ে ভালো ফলাফল দিতে পারে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%b7%e0%a6%b7%e0%a7%8d%e0%a6%a0-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%95%e0%a7%87%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a7%80/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*