রূপক কবিতা কাকে বলে? রূপক কবিতা হিসেবে ‘ডাহুক’ এর সার্থকতা বিচার কর।

উত্তর ভূমিকা : ইসলামি পুনর্জাগরণের কবি ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪) বাংলা কাব্য সাহিত্যে লব্ধ প্রতিষ্ঠিত কবি। নজরুলোত্তর বাংলা সাহিত্যে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। ঐতিহ্যপ্রেমী এ কবির শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘সাত সাগরের মাঝি’ কবিতা গ্রন্থ। কবি বস্তুজগৎ ও পারিপার্শ্বিকতাকে অবলম্বন করে রূপকাশ্রিত যেসব কবিতা রচনা করেছেন ‘ডাহুক’ তার মধ্যে সবচেয়ে শিল্পসফল কবিতার মর্যাদা লাভ করেছে।
রূপক কবিতা : রূপক কবিতা বলতে এমন ধরনের কবিতা বুঝায়, যেখানে কবি তাঁর কোনো বিশেষ ভাব বা তত্ত্বকে সরাসরি প্রকাশ না করে অন্য কোন বাহ্যিক ঘটন। চিত্রের আড়ালে রেখে সমান্তরালভাবে ব্যঞ্জিত করে থাকেন। রূপকের ইংরেজি শব্দ হচ্ছে Allegory। গ্রিক ভাষায় এর অর্থ অন্য কিছু বুঝানো। শ্রীশচন্দ্র দাশ তাঁর সাহিত্য সন্দর্শন’ গ্রন্থে রূপক কবিতার সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে- “যে কবিতায় কোন গল্প বা কাহিনীর মধ্য দিয়ে অন্য কোন বিশেষ অর্থের ইঙ্গিত করা হয়, তাহাকে আমরা Allegory বা রূপক কবিতা বলি।”
রূপক কবিতা হিসেবে ‘ডাহুক’ : রূপক কবিতায় ভাববস্তুর দুটি দিক থাকে। একটি হলো আপাতদৃষ্ট ভাববস্তু, অন্যটি হলো অন্তর্নিহিত সমান্তরাল ভাববস্তু। অর্থাৎ রূপক কবিতায় কাব্যার্থ আর অন্তর্নিহিত অর্থ হলো নিহিতার্থ। ‘ডাহুক’ কবিতায় কবি গ্রামবাংলার বিশিষ্ট জলজ পাখি ডাহুকের রূপ বর্ণনার জন্য কলম ধরেননি। ডাহুককে প্রতীকী হিসেবে গ্রহণ করে কবি জাতির মুক্তির কথা বলেছেন। এ কবিতায় আমরা একদিকে লক্ষ করি লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা এ পাখিটির কিছুটা বৈশিষ্ট্য। অপরদিকে তার সুর মাহাত্ম্য কবির চেতনালোকে পৌছে দেয় মুক্তির বাণী। ডাহুক এখানে মুক্তির প্রতীক।
‘ডাহুক’ কবিতার আপাতদৃষ্ট ভাববস্তু : নিস্তব্ধ রাত্রি। বিশ্বচরাচর গভীর নিদ্রায় মগ্ন। কবি জেগে আছেন একাকী বিছানায়। রাত্রির স্তব্ধতা ভেদ করে অবিশ্রান্ত ডেকে চলেছে ডাহুক। কবির মনে হয়েছে সে ডাক যেন উঠে আসছে অতলান্ত সমুদ্রের গভীরতা থেকে। বেতস বনের ফাঁকে চাঁদ ক্ষয়ে আসে তবুও থামে না ডাহুকের ডাক। চিরচেনা পাখিকে কবির অচেনা মনে হয়। ডাহুক যেন একটি পাখি নয়; সে সুরযন্ত্র মাত্র। ডাহুকের ডাক কবির চেতনালোকে নতুন সত্যের সন্ধান এনে দেয়। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে কবি নিজের জীবনের হিসাব মিলিয়ে শিহরিত হয়ে উঠেন। ডাহুকের মতো মুক্ত হতে চাইলেও সমাজ সংসারের শৃঙ্খল হতে মুক্ত হতে না পারার যন্ত্রণায় কবি দগ্ধ হতে থাকেন।


“ডাহুকের ডাক
সকল বেদনা যেন সব অভিযোগ যেন
হয়ে আসে নীরৰ নির্বাক।”


‘ডাহুক’ কবিতার অন্তর্নিহিত ভাববস্ত : ডাহুক মুক্তির প্রতীক। কবি ডাহুকের ডাককে অনস্তলোকের ডাক হিসেবেই কল্পনা করেন। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পরিদৃশ্যমান এ বস্তুজগতের অন্তরালে এক অসীম রহস্যময় অলৌকিক জগৎ বিদ্যমান। কবি ডাহুকের কণ্ঠে সে অসীমলোকের ডাক শুনতে পাচ্ছেন। কবি চেতনায় ডাহুকের সুর মনে হয়েছে। সাধকের হৃদয় নিংড়ানো যিকির। নিকুঞ্জবিহারী ডাহুকের ডাককে কবি দেখেছেন অনস্তের এক অমোঘ বারতা হিসেবে। যে বারতা মানুষকে জাগতিক বলয় ভেদ করে অন্তর্লোকে পরমাত্মার সন্ধানে শক্তি ও প্রেরণা যোগায়।


মনে হয় তুমি শুধু অশরীরী সুর.

তবু জানি তুমি সুর নও,
তুমি শুধু সুরযন্ত্র! তুমি শুধু বও
আকাশ জমানো ঘর অরণ্যের অন্তর্লীন ব্যথাতুর
গভীর সিন্ধুর।”


ডাহুকের বৈশিষ্ট্য : ডাহুক একটি বিশেষ প্রজাতির জলজ পাখি। দৃষ্টিনন্দন এ পাখিটি বর্তমানে দৃষ্টিগ্রাহ্য হয় না। ডাহুকের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো গভীর রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেদ করে সে এক নাগাড়ে ডেকে যায়। ভাবমগ্ন মানুষের কাছে ডাহুক তাই সাধকের প্রতীক। স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের জন্য সাধক যেমন রাত জেগে যিকির করে চলে ডাহুকও তেমনি অবিশ্রান্ত ডেকে যায় কোন এক পরম বেদনায়। কবির চেতনায় সাধনার পথে মানুষের চেয়ে ডাহুক অনেক এগিয়ে। মুক্তপক্ষ ডাহুক যেভাবে একনিষ্ঠতায় ডাকতে পারে সংসারধর্মে দীক্ষিত মানুষ তা পারে না। তাই ডাহুক প্রেম ও জীবন বিনির্মাণের প্রতীক। সে একটি প্রকৃতিচারী পাখি মাত্র নয়।
মুক্তির প্রতীক : ডাহুক মুক্তির প্রতীক। স্বাধীনতার প্রতীক। কবি কোন এক মগ্নচৈতন্যে বন্দী। ডাহুকের আশ্রয়ে কবি আত্মমুক্তির এক স্বপ্নীল পথ রচনা করে চলেছেন। কিন্তু মানুষের বাস্তবজীবন জৈবিকতা ও সংসারধর্মের নানা জটিলতায় বন্দী। কবি তাই আক্ষেপের সুরে বলেছেন-


“শুনিয়া তোমার সুর নিজেদেরি বিষাক্ত ছোবলে
তনুমন করি যে আহত। “


ডাহুকের সুরে অসীম সত্তার প্রকাশ : জোছনা প্লাবিত গভীর রাতে ডাহুকের যে সুর ভেসে আসে; তা যেন সুর নয় অফুরান সুরা। এ সুরাপাত্র আর পাখিকে কবির আজও চেনা মন হয় না। চিরচেনা ডাহুককে কবির অচেনা মনে হয়। বর্ণ ও আকৃতিতে কবি ডাহুককে চিনলেও তার সুর কবির কাছে দুর্ভেয়, দুর্বোধ্য মনে হয়। চেনার মধ্যে না চেনার রহস্যময়তা আধ্যাত্মিক সাধনার মূল। কবির মনে হয়েছে ডাহুক নিজে ডাকে না, তার সুরের উৎস অসীম প্রভু। অসীম সত্তার কণ্ঠই ডাহুকের কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত হয়ে হৃদয়লোকে আঘাত করে।
রূপক কৰিতা হিসেবে ‘ডাহুকে’র মূল্যায়ন : রূপক কবিতা হচ্ছে বাইরের রূপের আড়ালে ভেতরের রূপের আভাসদানকারী কবিতা। তবে কবিতার আখ্যানভাগ বা গল্পাংশ স্বল্প হলে এবং বিষয়বস্তু যদি বিষয়াতীত অন্য কোনভাব কল্পনাকে ব্যঞ্জিত করে তবে সে শ্রেণির কবিতাকে রূপক না বলে আমরা সাংকেতিক বা প্রতীক। কবিতা বলতে পারি। এদিক থেকে দেখতে গেলে ‘ডাহুক’কে রূপক না বলে সাংকেতিক কিংবা প্রতীকধর্মী কবিতা বলা শ্রেয়। এ কবিতার আখ্যানভাগ খুবই সংক্ষিপ্ত। এ কবিতায় বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে বিশেষ প্রজাতির একটি পাখি ডাহুককে। ডাহুককে প্রতীকী আশ্রয় করে কবির ভাবকল্পনা প্রকাশিত হয়েছে। ডাহুক নয়; ডাহুকের ডাক কবির ভাব কল্পনায় অধিকমাত্রায় পল্লবিত হয়েছে।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি, ভাব কল্পনার বিষয় বক্তব্যে ‘ডাহুক’ রূপকধর্মী সাংকেতিক কবিতার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ । বাংলা কাব্য সাহিত্যে ‘ডাহুকে’র মতো কালজয়ী শিল্পসফল কবিতা খুব কমই আছে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a1%e0%a6%be%e0%a6%b9%e0%a7%81%e0%a6%95-%e0%a6%95%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a6%be-%e0%a6%ab%e0%a6%b0%e0%a6%b0%e0%a7%81%e0%a6%96-%e0%a6%86%e0%a6%b9%e0%a6%ae%e0%a6%a6/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*