রাজনীতি বলতে কী বুঝ? গ্রামীণ রাজনীতির সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির সম্পৃক্ততা ব্যাখ্যা কর ।

অথবা, রাজনীতির সংজ্ঞা দাও। গ্রামীণ ও শহরের রাজনীতির মধ্যকার যে সম্পৃক্ততা লক্ষ করা যায় তা বিশদভাবে বর্ণনা কর।
অথবা, রাজনীতি কী? গ্রাম ও নগরের রাজনীতির মধ্যকার নিহিত যোগসূত্র বর্ণনা কর।
অথবা, রাজনীতি কাকে বলে? গ্রামীণ রাজনীতির সাথে জাতীয় রাজনীতির সম্পৃক্ততা আলোচনা কর।
অথবা, রাজনীতি কী? গ্রামীণ রাজনীতির সাথে জাতীয় রাজনীতির সম্পর্ক আলোচনা কর।
অথবা, রাজনীতি কাকে বলে? গ্রামীণ রাজনীতির সাথে জাতীয় রাজনীতির সম্পর্ক বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
গ্রামীণ রাজনীতি গ্রামীণ সমাজব্যবস্থা অতি পরিচিত একটা প্রত্যয়। গ্রামীণ সমাজ কাঠামোর সাথে গ্রাম্য রাজনীতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ। গ্রাম্য জনজীবনে ক্ষমতা চর্চায় গ্রামীণ রাজনীতিতে যারা প্রতিষ্ঠিত তারাই প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে। গ্রামীণ এলিট শ্রেণি, ধর্মীয় নেতা, উচ্চ বংশীয় মর্যাদা প্রভৃতিতে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ বা গোষ্ঠীবর্ণ গ্রামীণ রাজনীতির পুরোধা হিসেবে বিবেচিত হয়। আধুনিক বিশ্বায়ন গ্রামীণ রাজনীতির সঙ্গে জাতীয় রাজনীতিকে
বিভিন্ন আঙ্গিকে সম্পৃক্ত করেছে।
রাজনীতি (Politics) : রাজনীতি শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ Politics যা আমাদের সকলের কাছে পরিচিত। এই Politics কে শাব্দিক অর্থে Art and science of government বা সরকারের কলা ও বিজ্ঞান হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ সরকারের সাথে সম্পর্কযুক্ত জনগণের জীবন ও কার্যাবলিই হচ্ছে রাজনীতি। সরকারের সকল ধরনের কার্যক্রম রাজনৈতিক ক্রিয়ার সাথে সম্পর্কযুক্ত। স্বীকৃত রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে সরকারের বিভিন্নমুখী ক্রিয়াকলাপের উদ্ভব হয়। এ ধরনের ক্রিয়াকলাপের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও জড়িত থাকে। আলোকে
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা রাজনীতিকে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সংজ্ঞায়িত করেছেন। নিম্নে কয়েকজনের সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো :
সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার (Sociologist Max Weber) তাঁর ‘German Ideology’ গ্রন্থে বলেন, “রাজনীতি হচ্ছে একটি সাধারণ মানবীয় কর্মকাণ্ড যা সমাজের মধ্যে উদ্ভব হয়। বিভিন্ন আলোচ্যসূচির উপর নির্ভর করে এর কার্যক্রম সম্প্রসারণ। বিভিন্ন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতায় এটি নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়।”
প্রফেসর অ্যালান আর. বল (Prof. Alan R. Bail) তাঁর ‘Modern Politics and Government’ গ্রন্থে বলেন, “রাজনীতি হচ্ছে একটা সক্রিয় বা সার্বিক ক্রিয়া। এখানে কোনোরকম নৈতিক নির্দেশ নয়, বরং সামগ্রিক ক্রিয়ার চর্চা হয়।”
প্রফেসর এস. ই. ফাইনার (Prof. S. E. Finer) তাঁর ‘Comparative Government’ গ্রন্থে বলেন, “রাজনীতি হলো আসলে এক ধরনের আচরণ বা কার্যাবলি । অর্থাৎ রাজনীতি বলতে রাজনৈতিক কার্যকলাপকে বুঝায়।”
এরিস্টটল (Aristotol) বলেন, “যে মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করে না সে হয় পশু নয়তো দেবতা। তেমনি রাজনৈতিক বন্ধনহীনভাবে কোনো সচেতন মানুষ থাকতে পারে না।”
সুতরাং বলা যায় যে, রাজনীতি এমন একটি বা এক ধরনের কর্ম যার মধ্যে নৈতিকতার মানদণ্ডের বাধ্যবাধকতা নেই।এটি সর্বাত্মকভাবে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে। আর এই ঐক্যবদ্ধ করতে যেয়েই রাজনীতিতে নৈতিকতার চর্চা হয়ে থাকে।
গ্রামীণ রাজনীতি (Rural politics ) : সাধারণত গ্রামীণ রাজনীতি বলতে গ্রামীণ মানুষের দৈনন্দিন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও আচার-অনুষ্ঠানকে বুঝায়। প্রতিটি দেশের শাসন ক্ষমতা ও শাসনকার্য পরিচালনার গ্রামীণ ও শহর উভয় সমাজের রাজনীতিই সমানভাবে তাৎপর্যপূর্ণ এবং সম্পর্কযুক্ত। এদিক থেকে বিবেচনা করলে জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতি ছাড়াও স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে গ্রামীণ রাজনীতি বলা হয়ে থাকে।
গ্রামীণ রাজনীতির সাথে জাতীয় রাজনীতির সম্পৃক্ততা (Involvement of rural politics with national politics): বিশ্বায়নের যুগে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ব্যাপক প্রচার প্রচারণার কারণে গ্রাম্য রাজনীতি আজ অনেকখানি গতিশীল । এই গতিশীলতাই গ্রামীণ রাজনীতিকে অতিমাত্রায় জাতীয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করেছে।নিম্নে শিরোনামের মাধ্যমে এদের মধ্যকার সম্পৃক্ততাকে তুলে ধরা হলো :
i. জাতীয় সংসদ নির্বাচনে : গ্রামীণ ও জাতীয় রাজনীতির সম্পর্কের প্রথম প্রমাণ আমরা পেয়ে থাকি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। আগেকার দিনের তুলনায় বর্তমানে গ্রামীণ জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে মাঠেঘাটে কাজ করা স্বল্পশিক্ষিত মানুষও জাতীয় সংসদ এবং এর কার্যাবলি সম্পর্কে অবগত। কেননা সংসদ নির্বাচনের একটা বড় অংশ হলো গ্রামীণ জনগণ। এই গ্রামীণ জনগণই সংসদের সদস্য হিসেবে তাদের প্রতিনিধিকে নির্বাচন করে। এভাবে গ্রামীণ জনগণ দেশের সরকার গঠনে সরাসরি যোগ দেয়ার সুযোগ পায় যা গ্রামীণ রাজনীতির সাথে জাতীয় রাজনীতির সম্পৃক্ততাকে স্পষ্ট করে।
ii. রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ : সরকার নিজেই জাতীয় পর্যায় থেকে রাষ্ট্রের সকল কাজ পরিচালনা করতে পারে না। এ কারণে ক্ষমতার কাঠামো গ্রামীণ পর্যায় পর্যন্ত হস্তান্তর করতে হয়। সাম্প্রতিক কালে অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের বিকেন্দ্রীকরণ নীতি সর্বজনস্বীকৃত। বিকেন্দ্রীকরণের ফলে মানুষ ঘরে বসেই রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের কথা বলা যেতে পারে। এটি হলো গ্রামীণ মানুষের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে প্রাথমিক ধাপ। এর সাথে জাতীয় পর্যায়ের সরকার কাঠামোর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। সরকারি রাজনৈতিক দলের ক্ষমতাবান কেউ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে ইউনিয়নের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড দ্রুত গতিতে ত্বরান্বিত হয়।
iii. ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে : যে কোনো দেশের শাসনব্যবস্থায় স্থানীয় সরকার কাঠামোর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। গ্রামীণ রাজনীতির অঙ্গন থেকেই গণতন্ত্র লালিত ও বিকশিত হয়ে থাকে। গ্রামীণ রাজনীতিই স্থানীয় সরকার কাঠামোর মেরুদণ্ড। উন্নয়নশীল দেশসমূহে রাজনৈতিক চর্চা শুরু হয় গ্রাম থেকে এবং তা পরিপূর্ণ রূপে বিকশিত হয় জাতীয় পর্যায়ে। কেননা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে গ্রামই প্রধান সেখানে সরকার কাঠামোর পরিবর্তন হয় গ্রামীণ রাজনীতির প্রবাহের মাধ্যমে। গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের রাজনৈতিক অধিকার হচ্ছে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা যা তাদেরকে রাজনীতি সম্পর্কে সচেতনতা দান করে।
iv. উপজেলা বা থানা পরিষদ : উপজেলা বা থানা পরিষদ গ্রামীণ রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানগণ প্রত্যেকেই উপজেলা পরিষদের সদস্য। উপজেলা পরিষদ থেকে গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও অর্থনৈতিক বরাদ্দ দেয়া কাজ হয়ে থাকে। উপজেলা পরিষদের সাথে সরকারি আমলারা জড়িত।আমলারা পদোন্নতি ও স্থানান্তরে জন্য রাজনীতির কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ রেখে চলে। ক্ষমতাসীন দলের গ্রামীণ নেতারা রাজনৈতিক প্রভাব দেখিয়ে স্থানীয় সরকার কাঠামোর কর্মচারীদের হাত করে নেন। এই সমস্ত কর্মকাণ্ড গ্রামীণ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দলাদলির সৃষ্টি করে থাকে। এভাবে গ্রামীণ ও জাতীয় রাজনীতি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়।
v. রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম : রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে দল সরকার গঠন করে থাকে সে দল গ্রামীণ তৃণমূল পর্যায়ের সংগঠনসমূহকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। সুতরাং এ কথা সহজেই বুঝা যায় যে, গ্রামীণ রাজনীতির সাথে জাতীয় রাজনীতির একটা যোগসূত্র রয়েছে। এছাড়াও গ্রামের প্রশাসনিক প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ। এই ইউনিয়ন পরিষদ গ্রামের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও সরকারের সাথে যোগাযোগ রক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে। গ্রামীণ রাজনীতিতে এমন এক শ্রেণির সুবিধাভোগী লোক আছে, যারা যে দলই করুক না কেন নিজেদের ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য রাতারাতি সরকারি দলে নিজেদের পাকাপোক্ত স্থান করে নেয়। সুতরাং একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে গ্রামীণ রাজনীতির সাথে জাতীয় রাজনীতির সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার নিরিখে বলা যায়, রাজনীতি হচ্ছে গণতান্ত্রিক সচেতনতা তৈরির একমাত্র মাধ্যম৷গ্রামীণ রাজনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে গ্রামীণ উন্নয়ন, ব্যক্তি বা দলের স্বার্থই এখানে একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। এখানকার সকলের সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়নের ধারা পরিচালিত হয়ে থাকে। আর এর পিছনে রাজনীতি অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*