Answer

ভিখু প্রবলভাবে সংগ্রামশীল ও অস্তিত্ববাদী’ ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের ভিখু চরিত্র আলোচনা কর।

অথবা, “আদিমতম কামনার রূপ ও অস্তিত্বের সংকটে ভিখু প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারের মানুষ আলোচনা কর।
অথবা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্প অনুসরণে ‘ভিখু’ চরিত্র বিশ্লেষণ কর।
অথবা, “মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের ভিখু লেখকের এক অনন্য সৃষ্টি”— এ উক্তির আলোকে ভিখু চরিত্র বিশ্লেষণ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
ত্রিশোত্তর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম রূপকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা গল্পে ও উপন্যাসে সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের জীবনকে তুলে ধরেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র প্রমুখ যেখানে নাগরিক জীবন নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সেখানে অসংস্কৃত জীবন-জীবিকাকে টেনে এনেছেন। তাঁর লেখা ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্প এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এ গল্পে গল্পকার অসভ্য অশিক্ষিত মানুষদের জীবনাচরণকে মূল উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ভিখু এই অসংস্কৃত সমাজজীবনের প্রতিনিধি।
কে এই ভিখু : ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পে ভিখুর জীবন বৃত্তান্ত লেখক উল্লেখ করেন নি। তার পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন বা বাসস্থানের কোন পরিচয় এ গল্পে নেই। ভিখু একজন ডাকাত সর্দার। ডাকাতি করে জীবিকানির্বাহ করার স্বার্থে এমন কোন নৃশংস কাজ নেই যা সে করতে দ্বিধা করেছে। খুন, রাহাজানি, নারীহরণ তার কাছে ছিল ডালভাতের মতো। ভিখু কেবল একটি নাম নয়, ভিখু একটি নৃশংসতার প্রতীক।
নৃশংস ভিখু : ভিখু নৃশংস প্রকৃতির মানুষ। ডাকাতি করে জীবিকানির্বাহ করার মধ্যে সে আদিম উল্লাস বোধ করে। মায়ের সামনে পুত্রকে, স্ত্রীর সামনে স্বামীকে হত্যা করার মধ্যে পৈশাচিক আনন্দ খুঁজে পায়। বসন্তপুরের বৈকুণ্ঠ সাহার গদিতে ডাকাতি করতে গিয়ে ভিখু বৈকুণ্ঠবাবুর মেজো ভাইয়ের মাথাটা দায়ের এক কোপে ধড় থেকে আলাদা করে দিয়েছে। ভিখারিণী পাঁচীকে দখল করার জন্য সে অন্ধকার রাতে বসিরের ঘরে ঢুকে এক হাতের দ্বারাই বসিরের মাথায় লোহার শিক ঢুকিয়ে হত্যা করেছিল । মানুষ খুন করতে তার হাত এতটুকু কাঁপত না। বরঞ্চ পৈশাচিক উল্লাসে তার দেহমন সিক্ত হতো।
কামুক ভিখু : ভিখু ছিল কামান্ধ। দৈহিক কামনা-বাসনা চরিতার্থ করতে সে এমন কোন কাজ নেই যা করতে পারত না। কামের বশবর্তী হয়ে ভিখু পাহানার শ্রীপতি বিশ্বাসের বোনকে অপহরণ করেছিল, রাখু বাগদীর বৌকে নিয়ে হাতিয়ায় পালিয়েছিল । পঙ্গুত্ব বরণের পরপরই আশ্রয়দাতা পেহ্লাদের বৌয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছিল। একটা হাত খোয়ানোর পরও ভিখু থেমে থাকে নি। শারীরিক অক্ষমতার কারণে দস্যুবৃত্তি ত্যাগ করে ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার পরও তার কামের নিবৃত্তি ঘটে নি। নদীর
ঘাটে স্নানরতা রমণীদের সিক্ত দেহ দেখে সে কামতৃষ্ণা চরিতার্থ করার চেষ্টা করেছে। সবশেষে বসিরকে হত্যা করে পাঁচীকে দখল করে নিরুদ্দেশের পথে পাড়ি জমিয়েছে। এ কারণে ভিখুকে আদিম কামনার জ্বলন্ত প্রতিমূর্তি বললেও অত্যুক্তি হয় না।
অকৃতজ্ঞ ভিখু : ভিখু ছিল এক চরম অকৃতজ্ঞ মানুষ। তার মধ্যে কৃতজ্ঞতাবোধ বলে কিছু ছিল না। উপকারীর উপকার স্বীকার করাতো দূরের কথা বরঞ্চ তার ক্ষতি করতেও সে দ্বিধা করতো না। আহত ও মুমূর্ষু ভিখুকে আশ্রয় দিয়েছিল পেহ্লাদ। প্রচুর ঝুঁকি নিয়ে একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও পেহ্লাদ তাকে সুস্থ করে তুলেছিল। অকৃতজ্ঞ ভিখু একটু সুস্থ হওয়ার পর সেই পেহ্লাদের বৌয়ের দিকেই হাত বাড়াল । শুধু তাই নয়, পেহ্লাদ এ অপরাধের দরুণ তাকে প্রহার করেছিল বলে গভীর রাতে ভিখু তার ঘরে আগুন দিয়ে পালিয়েছিল।
বর্বর ভিখু : ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের ভিখু অসভ্য ও বর্বর। মনুষ্যত্বের সামান্যতম উপাদান তার মধ্যে অনুপস্থিত। বনের পশু যে অবস্থায় বাঁচে না মানুষ ভিখু সে অবস্থায় বেঁচে থেকেছে। কেবলমাত্র পশুপ্রবৃত্তির কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। মানুষ খুন করার মধ্যে যে ব্যক্তি আনন্দ খুঁজে পায় সে কোন স্তরের জীব তা সহজেই অনুমেয়। পেহ্লাদের বৌয়ের দিকে হাত বাড়ানো, পাহানার শ্রীপতি বিশ্বাসের বোনকে অপহরণ করা, রাখুর বৌকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া, সবশেষে ভিখারিণী পাঁচীকে নিয়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা করা এসবই ভিখুর বর্বরতার পরিচায়ক।
সংগ্রামশীল ও অস্তিত্ববাদী ভিখু : সংগ্রাম মানুষের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। এ থেকে ভিখুও ব্যতিক্রম নয়। অসভ্য ও বর্বর হওয়া সত্ত্বেও ভিখুর মধ্যে যে মনুষ্যোচিত গুণ প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে তা হলো তার সংগ্রামশীলতা । ভিখু প্রচণ্ডভাবে সংগ্রামী ও অস্তিত্ববাদী। বেঁচে থেকে টিকে থাকার জন্য যখন যা প্রয়োজন সে তখন তা-ই করেছে। বাঁচার সংগ্রামের ক্ষেত্রে সে কারও সাথে আপস করেনি। নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে সে একের পর এক অপকর্ম সাধন করেছে। অস্তিত্বের প্রশ্নে সে হয়ে উঠেছে নির্মম ও নৃশংস।
আদিম ও বন্য ভিখু : ভিখু ছিল আদিম ও বন্য মানিসকতার মানুষ। তার মধ্যে কোন সুকুমার প্রবৃত্তির বিকাশ সাধিত হয়নি। বনের পশুর মতোই সে ছিল বন্য আর প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষের মতোই ছিল আদিম। তার চালচলন, আচার-আচরণ, কাজকর্ম, কথাবার্তার মধ্যে কোন রুচিশীলতা ছিল না। কথায় কথায় অন্যকে গালাগালি দিতে ভালোবাসত সে। নদীর ঘাটে স্নানরতা মেয়েদের দেখে হি হি করে হাসত। কেউ ভিক্ষা না দিলে অলক্ষ্যে তার উদ্দেশ্যে গালি ছুঁড়ে মারত। তার প্রতিকূল পরিবেশের সাথে
সংগ্রাম করে টিকে থাকার ক্ষমতা ছিল অত্যধিক। বনের পশু যে অবস্থায় বাঁচে না সেই অবস্থায় মুমূর্ষু ভিখু বেঁচে উঠেছিল। আদিম বন্য স্বভাবের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছিল।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ভিখু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক অনন্য সৃষ্টি। সে প্রাগৈতিহাসিক যুগের অসভ্য প্রকৃতির মানুষ। শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির কোন ছোঁয়া তাকে স্পর্শ করেনি। নগ্ন কামনার বশবর্তী হয়ে এবং পেটের তাগিদে এমন কোন কাজ নেই যা ভিখু করতে পারত না। তার ভিতরে দয়া, মায়া, মমতা, স্নেহ, ভালোবাসা ও আন্তরিকতার কোন স্থান ছিল না। স্বভাবে, চরিত্রে, আচরণে সে ছিল বন্য, অসভ্য ও আদিম।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!