ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের দার্শনিক ভিত্তি আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশ দর্শনের অগ্রযাত্রায় ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের ভূমিকা আলোচনা কর।
অথবা, ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের দার্শনিক ভিত্তি কী? ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাংলাদেশ দর্শনের অগ্রযাত্রায় ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের ভূমিকা কী ছিল? ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাংলাদেশ দর্শনের অগ্রযাত্রায় ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের কী কী ভূমিকা ছিল?
উত্তর।। ভূমিকা :
খ্রিস্টীয় ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজনীতি, দর্শন ও মনন সাধনা ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আর এ শতাব্দীতে যে কয়টি দার্শনিক আন্দোলনের উদ্ভব হয়েছে সেগুলোর মধ্যে ব্রাহ্ম সমাজের দার্শনিক আন্দোলন বাঙালির চিন্তাচেতনায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। আর এ ব্রাহ্ম সমাজ দার্শনিক আন্দোলনের মূলে ছিলেন নবযুগের প্রবর্তক, আধুনিক যুগ সারথি রাজা রামমোহন রায়।
ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের দার্শনিক ভিত্তি : বাঙালিকে চিরাচরিত প্রথার দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে, অন্যায় অসঙ্গতি থেকে দূরে রাখতে এবং আত্মপ্রত্যয় ও ব্যক্তিগত বিবেক বুদ্ধির উপর ধর্মবোধকে একটি সর্বাঙ্গীণ জীবনচর্যারূপে প্রতিষ্ঠা করতে ব্রাহ্ম সমাজ দার্শনিক আন্দোলন অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সাম্যাদর্শের মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে জোড়াসাঁকোর রামকমল বসুর বাড়ির কিয়দংশ মাসিক চল্লিশ টাকায় ভাড়া নিয়ে ব্রাহ্ম সমাজ দার্শনিক আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এ দার্শনিক আন্দোলনের আদর্শ ছিল সাম্য এবং লক্ষ্য ছিল মানুষের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ। এ আদর্শ ও লক্ষ্যই পরবর্তীকালে বাংলাদেশ দর্শনের দর্শনিকদের মানবকেন্দ্রিক দর্শন ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করে। নিম্নে ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের দার্শনিক ভিত্তি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
যুক্তিবাদিতা : ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের দার্শনিকরা ধর্মের প্রতি আস্থা অক্ষুণ্ণ রেখেই চিন্তার ক্ষেত্রে নিজেদেরকে যুক্তিবাদী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। বেদবেদান্তে, কুরআন, বাইবেল মন্থন করে সকল ধর্মের সারাৎসার গ্রহণ করে জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তোলার মানসে তাঁরা সৃষ্টি করলেন একটি নতুন দার্শনিক আন্দোলন, যে দার্শনিক আন্দোলনে সমর্থন যুগিয়েছে সেকালের সব শিক্ষিত সমাজ। এ আন্দোলনের দার্শনিকদের যুক্তিবাদী মানসিকতা ফুটে উঠেছে নিয়ে আলোচিত বিভিন্ন সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে।
সতীদাহ প্রথার বিলোপ সাধন : সতীদাহ প্রথার মূল বিষয় হচ্ছে নারীর সতীত্ব বজায় রাখার জন্য বিধবা স্ত্রীকে স্বামীর সাথে একই চিতায় অত্মাহুতি দিতে হবে। সতীর সতীত্ব রক্ষার এটি কোন যৌক্তিক পদক্ষেপ হতে পারে না। যৌবনের তাড়নায় কোন যুবতী বিধবা নারীর হয়ত সতীত্ব বজায় রাখা কোন কোন ক্ষেত্রে কঠিন তথাপি একই চিতায় জীবন্ত দগ্ধ হওয়া কোন সুষ্ঠু সমাধানের বিষয় নয়। এর বিকল্প ভেবে দেখা খুবই জরুরি। এ বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞান অর্জন এবং
হিন্দুধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থাদি পাঠ করে ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের অন্যতম ও অগ্রজ পুরোধা বলে যাকে আমরা অভিহিত করতে পারি সেই রাজা রামমোহন রায়ই প্রথম যৌক্তিক সমাধান খুঁজে বের করলেন এবং ১৮২৯ সালে তৎকালীন ভারতের ভাইসরয় লর্ড বেন্টিং এর সহযোগিতায় সতীদাহ প্রথার বিলোপ সাধন করেন। তিনি এখানেই ক্ষান্ত হননি; এ বিষয়ে জনমত সৃষ্টিতেও সচেষ্ট ছিলেন।
বিধবা বিবাহের প্রচলন : সতীদাহ প্রথা রহিত করা হলো। কিন্তু জনমনে সতীর সতীত্ব রক্ষা করা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন স্থাপিত হতে লাগল। এ বিষয়েও ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের দার্শনিকরা একটি যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছাতে সক্ষম করেছিলেন। এ সমস্যার সমাধানে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের দুই প্রথিতযশা দার্শনিক বিদ্যাসাগর ও রাজা রামমোহন রায়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ধর্মের বিভিন্ন দিক উল্লেখ করে বিধবা বিবাহ প্রচলন করে সতীর সতীত্ব রক্ষা করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন এবং এ বিষয়ে জনমত সুটির চেষ্টা চালান। এক পর্যায়ে তৎকালীন দন্বিত সমাজ ও ইংরেজ সরকার তাঁর মতের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন এবং সতীর সতীত্ব রক্ষায় একটি যৌক্তিক ধান ‘বিধবা বিবাহ প্রথার প্রচলন করেন।
জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা : জাতিভেদ প্রথাকে ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের দার্শনিকরা হিন্দু সমাজের কলঙ্ক বলে অভিহিত করেন। জাতিভেদ প্রথাকে তারা ভারতীয়দের ঐক্যের ক্ষেত্রে একটি বিরাট প্রতিবন্ধক হিসেবেও চিহ্নিত করেন। ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের দার্শনিকগণ মুক্ত মন এটা চিন্তা করতে সমর্থ হয় যে, মানুষ যখন জন্মায় তখন সে কোন দোষ বারে তো জন্মায় না, যে কারণে তাকে জাতিভেদের করাল গ্রাসে পিষ্ট করে সমাজের নিগৃহীত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তাঁরা মনে করেন সকল মানুষ সমান্য পরিবেশই তাকে নিচু কিংবা উঁচু জাতির অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ জাতিভেদ প্রথার
বিলুপ্তিতে ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের দার্শনিকরা পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন প্রবন্ধ রচনার মাধ্যমে তাঁদের মতাদর্শকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চেষ্টা করেন।
ধর্ম সংস্কার : ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের দার্শনিকরা হিন্দুধর্মের ব্যাপক সংস্কারের প্রতি তাঁদের মতামত তুলে ধরেন। তাঁরা হিন্দুধর্মের প্রচলিত আচার-অনুষ্ঠানকে নিরর্থক প্রমাণ করার জন্য বেদ ও উপনিষদ থেকে বিভিন্ন বাণী উদ্ধৃত করে প্রচার করতে থাকেন। তবে তাঁদের এ ধরনের মতবাদ ভারতের রক্ষণশীলদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু এতে হা না হয়ে তাঁরা অর্থহীন আচার-অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিন্দা জ্ঞাপন করেন এবং ধর্মীয় কুসংস্কারের জন্য পুরোহিত সম্প্রদায়কে দায়ী করেন। এ আন্দোলনের পুরোধা রাজা রামমোহন রায় এ সংস্কার আন্দোলন পরিচালনার জন্য ‘আত্মীয় সভা’ গঠন করেন। একদল কুসংস্কারমুক্ত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হিন্দু এ বিষয়ে তাঁকে জোর সমর্থন দেন। তাঁর সমিতির কয়েকজন উল্লেখযোগ্য সদস্য হচ্ছেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্ন কুমার, নম্র কিশোর বসু, কালী শংকর ঘোষাল প্রমুখ।
মানবতাবাদ : ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের দার্শনিকরা মানবপ্রেমিক হিসেবে সুপরিচিত। তাঁদের দর্শনচিন্তার মূল কেন্দ্রবিন্দুই ছিল মানুষ। মানব ভাবনা তাঁদের দর্শনচিস্তার পূর্বাভাস থেকে উপসংহার পর্যন্ত বিস্তৃত। ধর্মজগতে তাঁরা বৈষম্যের মধ্য সাম্য, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করে সার্বজনীন মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁরা হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের উপাস্যের ঐক্যের নির্দেশ করে ধর্মক্ষেত্রে সাম্যভিত্তিক একটা সমন্বয় বিধান করার চেষ্টা করেছেন। ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের দার্শনিকরা মানবপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন চাষির দুঃখ মোচনের যৌক্তিক সমাধান খুঁজে বের করে। তাঁরা একদিকে যেমন জমিদারকে অনুরোধ করতেন খাজনা বৃদ্ধি না করতে, অন্যদিকে তেমনি জমিদারদের উপর আরোপিত কর হ্রাসেরও সমর্থক ছিলেন। তাঁরা বলেন, প্রজাদের উপর খাজনা বৃদ্ধি সম্রাটা কোন দ্যাগকামী শাসকের কাজ হতে পারে না। অনকল্যাণের জন্য আইন ও বিচার ব্যবস্থার সংস্কার সাধনেও তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মানবকল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে বিচার বিভাগকে শাসন ও রাজস্ব বিভাগ থেকে পৃথক করার জন্য জোর আবেদন জানান। বিচার ব্যবস্থার যেকোন ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁরা সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। এভাবে মানবকল্যাণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে ব্রাহ্ম সমাজের দার্শনিকরা মানবতাবাদী দার্শনিক হিসেবে সুপরিচিত হয়ে উঠেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের দার্শনিকরা ভাবাবেগের পরিবর্তে যুক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে তাঁদের দর্শন চর্চা শুরু করেন। তাঁদের যুক্তিবাদী মানসিকতায় তাঁদেরকে বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে সহায়তা করেছে। সর্বোপরি বলা যায়, মানবপ্রেম বা মানবতাবাদী আদর্শই তাঁদেরকে সব ধরনের কুসংস্কারের বেড়াজাল ভেঙে মানব মুক্তির পথ খুঁজতে এ যৌক্তিক ও মানবতাবাদী আদর্শ আমরা লক্ষ্য করি পরবর্তীকালের বাংলাদেশ দার্শনিকদের মধ্যে। যেসব দার্শনিক তাদের ভাবাদর্শকে গ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে ড. সাবিন্দ চন্দ্র দেবের নাম উল্লেখ করা যায়।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a6%9e%e0%a7%8d%e0%a6%9a%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%89%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a6%b6-%e0%a6%8f%e0%a6%ac%e0%a6%82-%e0%a6%ac%e0%a6%bf/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*