Answer

বৈষ্ণবীয় প্রেমতত্ত্ব সংক্ষেপে আলোচনা কর।

অথবা, বৈষ্ণবীয় প্রেমতত্ত্ব ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বৈষ্ণবীয় প্রেমতত্ত্ব কি?
অথবা, বৈষ্ণবীয় শ্রেনতত্ত্ব সম্পর্কে যা জান লেখ।
অথবা, বৈষ্ণবীয় প্রেমতত্ত্ব বলতে কি বুঝ?
অথবা, বেষ্ণবীয় প্রেমতত্ত্ব কাকে বলে?
উত্তর।। ভূমিকা :
মধ্যযুগের বাঙালির মনন সাধনার ইতিহাসে যে মতধারার নাম সর্বাগ্নে প্রণিধানযোগ্য তা হল বৈষ্ণববাদ। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত এ মতধারা বৈষ্ণৰ প্ৰেমদর্শন বা প্রেমধর্ম নামেই আমাদের নিকট অতি পরিচিত। প্রেম বা প্রেমতভিই বৈষ্ণব মতের মূল সারোৎসার। বৈষ্ণব প্রেমদর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মানুষ, মানুষের সামনে কল্যাণ, মানুষে মানুষে সম্প্রীতি বা প্রেমের বিস্তৃতি। এ প্রেম দর্শনের মাধ্যমেই বৈষ্ণববাদ মধ্যযুগের বাঙালিকে নিদ্ৰা থেকে জাগ্রত করে।
বৈষ্ণনীয় প্ৰেমতত্ত্ব : বৈষ্ণব প্রেমতত্ত্বের মূলকথা দেহের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞাশিত সেহোতীর্ণ অতীন্দ্রিয় কোন বহু প্রেম। শ্রীকৃষ্ণ একমাত্র ঈশ্বর ও আবাখা। কিন্তু তিনি প্রেমময়। তাঁকে লাভ করতে হয় প্রেম নিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে। মতে, মানব সত্তা জ্ঞান, কর্ম ও প্রেম এ তিনটি বৃত্তি নিয়ে গঠিত। অভাব বা প্রয়োজন বোধ থেকে কর্মের সূত্রপাত। কিন্তু ঈশ্বর পূর্ণাঙ্গ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাঁর কোনো অভাববোধ নেই বিষায় কর্মমার্গে ভগবৎ সাধনা বুঝা। আবার পরমার্থিক সাধারণ মানুষের সাধ্যাতীত বলে, সব মানুষের পক্ষে জ্ঞানের পথে পারমার্থিক সত্তার সন্ধান লাভ সম্ভব মতে, জ্ঞানে নয়, কর্মে নয়, প্রেমভক্তির মাধ্যমেই কেবল সনীম মানুষের পক্ষে পরম ঐশীলের অর্জন ও উপলব্ধি সম্ভব। এ কারণে প্রেমই বৈষ্ণবের ধর্ম, প্রেমই বৈষ্ণবের দর্শন। প্রাক যুগের একান্ত জ্ঞানমূলক এবং নিতান্তই নীরস ও
প্রেমহীন দর্শনের স্কুলে বৈষ্ণবীয় প্রেম ধর্ম বা প্রেমাত্মক দর্শন তত্ত্ব বাঙালির চিন্তাভাবনা তথা উপমহাদেশীয় জীবনে আনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এ তত্ত্ব দর্শনের মূল কথা জাতি নয়, শ্রেণি নয়, কুল নয়, ভক্তি ও প্রেমই মানুষের প্রো পরিচয়, প্রেমই মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। বৈষ্ণবীয় এ প্রেমাত্মক দর্শনের প্রভাবে অতীতের জ্ঞানমূলক দর্শনে সসীম ও অসীম, মানুষ ও দেবতার মধ্যে যে দুস্তর ব্যবধান ছিল তা ঘোড়ে গিয়ে স্বর্গ ও দেবতার সঙ্গে মানুষের দূরত্ব হ্রাস পেল উল্লেখযোগ্য ভাবে এবং ‘দেবতার প্রিয় কবি, প্রিয়েরে দেবতা এ বাণী স্বীকৃতি পেল ভক্ত ও ভগবানের সম্বন্ধের নির্যাস হিসেবে। বৈদান্তিক দার্শনিকদের মতো বৈষ্ণবরা ব্রহ্মকে নির্গুণ বলে মনে করেন না। তাঁদের মতে, পরমসত্তা কৃষ্ণ নির্ধণ নন, বরং এমন এক পরমপুরুষ যিনি তক্তের পরম আত্মীয় ভক্তের ভগবান। পরমসতা ভগবান ভেদবুদ্ধি বা বরং পরম উপাস্য ও প্রেমের বস্তু। তিনি রসস্বরূপ ‘রসো বৈ সঃ’। তিনি সবার প্রিয়, সবার বন্ধু, তিনি আত্মাস্বরূপ। তিনি আদিতে এক ছিলেন; কিন্তু জীবনলীলা সম্ভোগের জন্য তিনি সৃষ্টিকে নিজের থেকে পৃথক করে পরিণত হলেন বস্তুতে। তাঁর এ লীলা মাতৃলীলা, দীপলীলা ও বৃক্ষবনস্পতি লীলার অন্তর্নিহিত সত্যের দ্যোতক। পরম পুরুষ কৃষ্ণ নিজ দেছে রাখাস্তাব অনুভর করেন। আবার রাধাকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে কৃষ্ণ বেদনা বিধুর থাকেন। এভাবে রসরূপ কৃষ্ণ বিভিন্ন লীলা করে থাকেন। বৈষ্ণব মতে, রাধা সৃষ্টির প্রতীক। আর কৃষ্ণ পরম স্রষ্টা। এ দুয়ের সম্বন্ধ জ্ঞানের নয়, প্রেমভক্তির সম্বন্ধ। প্রেম ও ভক্তি এ দুটি পারস্পরিক একে অপরের সম্পূরক ও পরিপূরক। দু জনাতে একাত্ম না হলে প্রেমভক্তি হয় না। তাই সৃষ্টি স্রষ্টা, রাধা ও কৃষ্ণ লুই হয়েও প্রেমের আবদ্ধ বা দুইয়ে মিলে এক। বৈষ্ণর দর্শনে পাঁচ প্রকার প্রেম বা ভাবের কথা স্বীকার করা হয়। যথা । শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর। প্রতিটি ভাবই উৎকৃষ্ট ও আনন্দদায়ক। তবে প্রতিটি স্তরই পূর্ববর্তী স্তরের তুলনায় উচ্চ পর্যায়ের। এর মধ্যে কাস্তা প্রেমকে বলা হচ্ছে সর্বসাধ্য সার। এ প্রেম কোনো সম্পর্কের মাধ্য আবদ্ধ নয়। সাস্য প্রেম প্রভু ভৃত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সখ্য প্রেমে সবার সাথে সখা প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ। বাৎসল্য প্রেম পিতা-মাতা ও সন্তানের পারস্পরিক হৃদয়ভাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু কান্তা প্রেম ঈশ্বর সম্পর্কে। এ প্রেমের মধ্যে কোনো সীমার বন্ধন নেই। কাস্তা প্রেমে ব্রজ গোপীরা বেসধর্ম, লোকধর্ম, কূলধর্ম, সেহ, গৃহ, স্বজন, আর্থপথ, পরিত্যাগ করে। এ কাস্তা প্রেমই একট বৃন্দাবনে স্থাপরে ব্রজগোপীদের মধ্যে দেখা গিয়েছিল এবং কেট বৃন্দাবনে নিতাই সেই ব্রজগোপী লীলা চলছে। রাধা ও ব্রজগোপীরা লীলার প্রয়োজনে নিজেদের মানবী মনে করলেও আসলে তারা মানবী নন। লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে, বৈষ্ণব প্রেম মানব মানবীকে কেন্দ্র করে সূচিত হলেও পরিণতিতে তা উচ্চস্তরের কৃষ্ণপ্রেম বা কান্তা প্রেমে উপনীত হয়। বৈষ্ণবীয় কৃষ্ণপ্রেমে কৃষ্ণ হলেন বিষয়, আর রাধা তার আশ্রয়। শ্রীচৈতন্য সৎ, চিৎ ও আনন্দকে পরমসত্তা শ্রীকৃষ্ণ স্বরূপ এবং হ্লাদিনী, সম্বিনী ও সম্বিৎকে তার সত্তা বলে অভিহিত করেছেন। প্রেমের উৎস হলো হ্লাদিনী শক্তি। হ্লাদিনী শক্তি রাধার ধর্মই হচ্ছে কৃষ্ণকে সর্বাতিশয়ী সুখ প্রদান। তিনি কৃষ্ণ বাসনা পূরণ করেন বলেই তার নাম রাধা। তিনি কৃষ্ণের অপূর্ণ বাসনা পূরণ করার জন্য মাদনাখ্য মহাভাব কৃষ্ণকে দিলেন; দিতে বাধা কোথাও নেই কারণ “রাধা পূর্ণশক্তি কৃষ্ণ পূর্ণশক্তিমান, দুই বস্তুতে ভেদ নাই শাস্ত্রের প্রমাণ ।”
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায়, বৈষ্ণবরা প্রেম ধর্মই প্রবর্তন করেছিলেন। এ প্রেম ধর্মে কোন জাত, ধর্ম বা বর্ণের তথাকথিত বাছবিচার ছিল না। এ প্রেম ধর্মই ছিল বৈষ্ণবের সাধনা। এ প্রেম ধর্মের মাধ্যমেই বৈষ্ণবরা মধ্যযুগের বাংলায় এক নবজাগরণের সৃষ্টি করেছিলেন।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!