বৈষ্ণবদর্শন ও বাউল দর্শনের পার্থক্য নিরূপণ কর।
অথবা, বৈষ্ণবদর্শন ও বাউল দর্শনের পার্থক্য নিরূপণ কর।
অথবা, বৈষ্ণবীয় দর্শনতত্ত্বের সাথে বাউল দর্শনতত্ত্বের বৈসাদৃশ্যসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, বৈষ্ণব দর্শন ও বাউল দর্শনের মধ্যে কি কি পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় তা দেখাও।
উত্তর৷৷ ভূমিকা : বৈষ্ণব দর্শন ও বাউল দর্শন মধ্যযুগের বাংলার মরমিবাদের উষর ভূমিতে উদ্ভূত ও বিকশিত দুটি উল্লেখযোগ্য ধর্ম ও দার্শনিক মতধারা। মধ্যযুগের বাঙালির জীবন, মনন ও সাহিত্য চিন্তার ক্ষেত্রে উভয় মতবাদই প্রভূত প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। বৈষ্ণব ও বাউল দর্শন উভয়ই বাঙালির নিজস্ব চিন্তার ফসল হলেও দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত দার্শনিক ধারা। বাউল দর্শনের উপর বৈষ্ণববাদের প্রভাব একেবারে অনস্বীকার্য না হলেও বৈষ্ণব ও বাউল দর্শন এক নয়।
বৈষ্ণব দর্শন ও বাউল দর্শনের পার্থক্য : বৈষ্ণব দর্শন ও বাউল দর্শন মধ্যযুগের বাংলার মাটিতে বিকশিত দুটি শক্তিশালী দার্শনিক ধারা। উভয় মতবাদই তাদের দার্শনিক মতাদর্শের দ্বারা তৎকালীন বাঙালির জীবনাদর্শ ও সমাজব্যবস্থার উপর কার্যকর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। সমকালীন বাংলার অন্ত্যজ বা নিম্নবর্ণের সাধারণ মানুষের মুক্তি, আধ্যাত্মিক উন্নতি, জীবনমান উন্নয়ন, প্রেম ও মানবতার মূল আদর্শকে কেন্দ্র করে উভয় মতবাদের উদ্ভব হলেও উৎস, প্রকৃতি, আদর্শ, পদ্ধতি ইত্যাদি দিক থেকে উভয় মতবাদের মধ্যকার বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যের পাল্লাটাই ভারী।যদিও আমরা প্রায়শই বহ্যিক সাদৃশ্য বশত বৈষ্ণব ও বাউলকে একসাথে গুলিয়ে ফেলি কিন্তু প্রকৃতপ্রস্তাবে বৈষ্ণব ও বাউল এক নয় । নিম্নে বাউল ও বৈষ্ণব মতের মৌলিক পার্থক্যসমূহ সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো :
১. বৈষ্ণবীয় রসতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব ও সাহিত্যে বিবৃত তত্ত্বকথা বা নিগূঢ় তত্ত্ব নিয়ে গড়ে উঠেছে বৈষ্ণব দর্শন। বৈষ্ণব ধর্মের প্রধান অনুষ্ঠান শ্রীবিষ্ণুর নামকীর্তন বা উপাসনা। আর এ উপাসনার মধ্যেই বিধৃত বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শন তথা বৈষ্ণববাদের মূল কথা। বৈষ্ণব মতের উদ্ভব প্রাচীন কালে হলেও মধ্যযুগীয় বাংলায় মহানপুরুষ শ্রীচৈতন্য
দেবের হাতেই এ মতবাদ পূর্ণতা লাভ করে। পক্ষান্তরে বাংলার একশ্রেণির অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত একতারা আশ্রয়ী, ভাববিদ্রোহী গায়ক, স্বাধীন ও সমন্বয়মূলক মরমি সাধকদের আত্মোপলব্ধিমূলক চিন্তাধারার নাম বাউল দর্শন। কোনো পরমসত্তা বা ভগবানের উপাসনা বাউলরা করে না। বাউলদের একমাত্র সাধনা দেহতত্ত্বের
সাধনা। আর এ দেহতত্ত্বের মধ্যেই নিহিত বাউলদের মূল কথা। মুসলমান মাধববিবি ও আউল চাঁদই এ মতের প্রবর্তক বলে বাউল গবেষকরা মনে করেন। মাধববিবির শিষ্য নিত্যানন্দের পুত্র বীর ভদ্রই বাউল মত জনপ্রিয় করে তোলেন। তবে উনিশ শতকে লালন ফকিরের সাধনা ও সৃষ্টির মধ্য দিয়েই বাউল মতের পূর্ণ বিকাশ ঘটে।
২. বৈষ্ণব মতে, বিষ্ণু বা কৃষ্ণই হচ্ছে একমাত্র পরমতত্ত্ব বা ঈশ্বর। তিনিই একমাত্র উপাস্য। তাঁর নামই আরাধ্য। বৈষ্ণব সমাজ বিষ্ণুর নাম সংকীর্তন ও নাম জপকে আধ্যাত্ম সাধনার প্রধান অঙ্গ হিসেবে গণ্য করেন। তাদের এ সাধনা জ্ঞান বা কর্মের উপর নয় বরং প্রেমভক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এ প্রেমে ভগবান ও ভক্তের সম্বন্ধ অত্যন্ত নিবিড় ও প্রত্যক্ষ। বৈষ্ণব মতে, জ্ঞানে নয়, কর্মে নয়, কেবল প্রেমভক্তির মাধ্যমেই সসীম মানুষের পক্ষে পরম ঐশীপ্রেম অর্জন ও উপলব্ধি সম্ভব। অন্যদিকে, বাউলরা কোনো পরমতত্ত্ব বা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না। তাই তাঁরা কোনো অতীন্দ্রিয় পরমসত্তার উপাসনা বা সাধনাও করেন না। তাঁরা বিশ্বাস করেন, পরমতত্ত্ব পরমসত্তা বা ঈশ্বর যাই বলা হোক না কেন দেহের মধ্যেই তাঁর অধিষ্ঠান। এ দেহেই মক্কা, মদিনা, গয়া, কাশি, বৃন্দাবন এবং পুরাণ, কুরআন, বেদ সবকিছুর অধিষ্ঠান। দেহের বাইরে কোনো তত্ত্বই বাউল স্বীকার করে না। তাই দেহের সাধনাই বাউল সাধনা, বাউলের এ দেহ সাধনা জ্ঞান, কর্ম, ভাব, ভক্তি ও প্রেমের উপর প্রতিষ্ঠিত। সসীম অসীমের ভেদ বাউল মানেন না।
৩. বৈষ্ণব ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, হিন্দু ধর্মের সংকট থেকে উত্তরণের জন্য হিন্দু ধর্মের নতুন সংস্করণ বা যুগ সংস্করণ হিসেবে এর উদ্ভব। বৈষ্ণব ধর্ম কখনোই হিন্দু ধর্মকে অস্বীকার করেনি বরং হিন্দু ধর্মের আধুনিকায়নে বৈষ্ণব ধর্ম সহায়ক নির্ঘণ্টরূপে কাজ করে গেছে সর্বকালে সর্বাবস্থায় উপধর্মমত রূপে। কিন্তু বাউল ধর্ম কোনো ধর্মের প্রতিনিধি বা উপধর্ম হিসেবে কখনোই কাজ করেনি বরং সর্বধর্মকে পাশ কাটিয়ে আলাদা একটি ধর্ম দর্শন প্রতিষ্ঠা করেছে। সকল ধর্মের মূলসারকে গ্রহণ করে একটি সমন্বয়ী
মতাদর্শরূপে বাউল ধর্ম স্বতন্ত্র ধারায় বিকশিত হয়েছে।
৪. বৈষ্ণবমত মূলত একটি ধর্মসংস্কারমূলক আন্দোলন। বৈষ্ণব মতের মধ্যে কোনোরূপ সামাজিক বিদ্রোহের আভাস পাওয়া যায় না। যেটুকু সামাজিক বিদ্রোহের চিহ্ন এর মধ্যে লক্ষ করা যায় তা প্রচলিত ধর্মকে রক্ষা করার তরে নিবেদিত। মধ্যযুগের বর্ণ বিভক্ত সমাজ কাঠামোতে প্রবল ব্রাহ্মণ্যবাদের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যখন সমাজের নিচুবর্ণের মানুষ ভাব বিদ্রোহের আয়োজন করছিল তখনই সমূহ অবক্ষয়ের হাত থেকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে রক্ষার জন্য বৈষ্ণবাদের উদ্ভব হয়। তাই দেখা যায়, শ্রীচৈতন্যের গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের আন্দোলনে ব্রাহ্মণগণই মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। কেননা, চৈতন্যের চার’শ নব্বই জন পরিকরের মধ্যে দু’শ চল্লিশ জনই ছিল ব্রাহ্মণ। অপরদিকে বাউলমত কোনো ধর্মসংস্কারমূলক আন্দোলন নয় বরং প্রচলিত অতীন্দ্রিয় ধর্মের বেঁড়ি থেকে মুক্ত একটি জীবনমুখী আন্দোলন। বাউল ধর্ম বা দর্শনের উদ্ভবের পিছনে একটি সমাজ দ্রোহভাব বিদ্যমান ছিল। এ সমাজ বিদ্রোহ সমাজে প্রচলিত ধর্মের নাম মানুষকে শোষণ করার বিরুদ্ধে মানবতাকে ভূলুণ্ঠিত করার বিরুদ্ধে। তাইতো বাউলরা সামাজিক আচার আনুষ্ঠানিকতাকে এড়িয়ে চলেন। সমাজ সংসারকে উপেক্ষা করেন। বাউলদের সচেতনভাবে সমাজ বর্জনের এ মনোভাব তাদের সমাজদ্রোহী চেতনার প্রত্যক্ষ প্রকাশরূপ ।
৫. বৈষ্ণবদের সাধনপ্রক্রিয়ার মূল কথা নিহিত পরম তত্ত্ব শ্রীকৃষ্ণের নাম জপ ও কীর্তনের মধ্যে। হরিনাম সংকীর্তন বা কৃষ্ণনাম জপ কীর্তনের মধ্যেই মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তি নিহিত বলে শ্রীচৈতন্য মনে করতেন। তাই বৈষ্ণব সমাজ কৃষ্ণনাম কীর্তন সাধনার মাধ্যমেই নিমজ্জিত থাকেন। তাদের এ সাধনায় গুরুত্ব স্বীকৃত হলেও গুরুর ভূমিকা মুখ্য নয় । বস্তুত শ্রীচৈতন্যের মৃত্যুর পর গুরুতত্ত্ব বৈষ্ণব সাধনায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে । অপর পক্ষে বাউল সাধনা প্রক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে দেহকেন্দ্রিক। দেহের সাধনাই বাউল সাধনা। বাউলরা বিশ্বাস করে এ দেহেই সকল তত্ত্বের স্থিতি ও বিস্তৃতি। এ দেহেই পরমাত্মা বা মনের মানুষ আলেক সাঁয়ের বাস। তাই বাউলরা দেহের সাধনার মাধ্যমে দেহের মধ্যেই পরমাত্মা বা মনের মানুষকে খুঁজে বেড়ান। তাদের এ সাধনক্রিয়া নির্দিষ্ট তত্ত্ব ও পদ্ধতি অনুসারে সম্পাদিত হয়। এ সাধনায় গুরুর ভূমিকা মুখ্য। গুরু ছাড়া বাউলের সাধনা হয় না। বাউলের এ গুরু মানুষ গুরু, বাউলরা আবার এ গুরুক ঈশ্বররূপও গণ্য করেন।
৬. আচার ব্যবহার, রীতিনীতি, পোশাক পরিচ্ছেদ, চালচলন ইত্যাদি বাহ্যিক দিক থেকেও বৈষ্ণব ও বাউলের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। বৈষ্ণবদের পোশাক গেরুয়া। অধুনাও কিছু কিছু বৈষ্ণবকে সাধন সঙ্গী নিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াতে বা ভিক্ষা করতে দেখা যায়। ক্ষ্যাপা, পাগলাটে নামটি বৈষ্ণবের সাথে যায় না। বৈষ্ণবদের গলায় স্ফটিক প্রভৃতির মালা, কটিতে কৌপিন, হাতে নারিকেলের কিস্তি ইত্যাদি দেখা যায় । আর, পাগল, ক্ষ্যাপা, পাগলাটে ইত্যাদি নামসমূহ বাউলের সাথে যুক্ত হয়ে পড়লেও বাউলরা কোনো অবস্থাতেই মস্তিষ্ক বিকৃত জনিত পাগল নয়। তারা পাগল তবে ভাবের পাগল । বাউলগণ সাদা রঙের আলখেল্লা, পাগড়ি ও সাদা লুঙ্গি পরিধান করে থাকেন। তাঁরা পথে পথে ঘুরে গানের মাধ্যমে তাঁদের মনের ভাব প্রকাশ করে থাকেন।একতারা তাঁদের নিত্যসঙ্গী। তবে এক শ্রেণির বাউল ভিক্ষা করেও তাদের জীবননির্বাহ করে থাকে। অবশ্য এ ভিক্ষাবৃত্তি তাদের সাধনারই অংশ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার সারসংক্ষেপে এক কথায় বলা যায়, বৈষ্ণব ও বাউল এক নয়। উভয়ের জীবনাদর্শ, সাধন পদ্ধতি ও ক্রিয়াকালাপ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আর এ ভিন্নতাকেই আরও সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে গেছেন লালন শিষ্য দুদ্দু শাহ তাঁর গানে :
“বাউল বৈষ্ণব ধর্ম এক নহে তো ভাই
বাউল ধর্মের সাথে বৈষ্ণবের যোগ নাই॥
বিশেষ সম্প্রদায় বৈষ্ণব,
পঞ্চতত্ত্বে করে জপতব
তুলসী মালা অনুষ্ঠান সদাই॥
বাউল মানুষ ভজে
যেখানে নিত্য বিরাজে,
বস্তুর অমৃতে মজে নারী সঙ্গী তাই৷”