বাঙালি জাতির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, বাঙালি জাতির উৎপত্তি ও উদ্ভব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।
অথবা, বাঙালি দর্শনের উৎপত্তি ও ত্রমবিকাশের ইতিহাস সম্পর্কে তোমার অভিমত দাও।
উত্তর।। ভূমিকা : বঙ্গ বা বাংলা একটি প্রাচীন জনপদ। হিমালয়ের দক্ষিণ পাদদেশে অবস্থিত ভাটির অঞ্চলটি বঙ্গ, বাঙলা বা বাংলা নামে পরিচিত। প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চলের অধিবাসীদের বঙ্গাল বা বাঙালি নামে অভিহিত করা হতো। তবে বাঙালি জাতির উৎপত্তির বিষয়টি আজও কুয়াশাচ্ছন্ন। অধিকাংশ পণ্ডিতগণ বাঙালি জাতিকে একটি সংস্কর জাতি বলে মনে করেন। কারণ বাঙালি জাতির উদ্ভবের বা উৎপত্তির উপর যেসব নৃতাত্ত্বিক গবেষণা হয়েছে তাতে বহু জাতির সংমিশ্রণে বাঙালি জাতির উদ্ভব বলে পণ্ডিতগণ মত দেন।
বাঙালি জাতির উৎপত্তি : বাঙালি জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে পণ্ডিতগণ বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। তাঁদের মতামতের মধ্যে যেমন সাদৃশ্য আছে তেমন বৈসাদৃশ্যও পরিলক্ষিত হয়। বাঙালি জাতি আর্যদের আগমনের বহু পূর্ব থেকে বঙ্গ বা বাঙলা অঞ্চলে বসবাস করতো। আধুনিক পণ্ডিতদের মতে বাংলা শব্দটি সর্বপ্রাচীন। ‘ঐতরেয় আরণ্যক’ এ দেখা যায়, যেখানে বঙ্গবাসী বা বাঙালিকে ‘বয়াংসি’ বা পক্ষি জাতীয় বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বৈদিক সাহিত্যে পুত্র জাতি বা জনপদের উল্লেখ রয়েছে এবং তাদেরকে দস্যু বলে অভিহিত করা হয়েছে। এভাবে বৈদিক সাহিত্যে বাঙালিদের প্রতি ঘৃণা
ও বিদ্বেষ প্রকাশ করা হয়েছে। বৈদিক ধর্মাবলম্বী আর্যগণ যখন পৃঞ্চনদে বসতি স্থাপন করে তখন বঙ্গদেশে বাস করা বা অবমহান করার কারণে প্রায়শ্চিত্ত করার রীতি প্রচলিত ছিল। এ কারণে পণ্ডিতগণ মনে করেন বাঙালি জাতি আর্য বংশোদ্ভূত নয়, বরং তাঁদের আগমনের পূর্বেই এদেশে বাস করতো।প্রাচীনকাল থেকেই বঙ্গ বা বাংলা অঞ্চলে আদিম মানব সভ্যতার বিবর্তন হয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাচীন বা প্রত্নপ্রস্তর (Palaeolithic) এবং নব্য প্রস্তর (Neolithic) যুগের পাশাপাশি তাম্র যুগের নির্মিত বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, যার দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে “বাঙলা” বা “বঙ্গ” বা বাংলা ভূখণ্ডে প্রাচীনকাল থেকেই জনবসতি ছিল।
বাঙালি জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে পণ্ডিতদের অভিমত : বাঙালি জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে বাঙালি জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে কয়েকজন পণ্ডিতের মতামত আলোচনা হলো।
১. বাঙালি জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মত : বাঙালি জাতির উৎপত্তি নিয়ে যেসব চিন্তাবিদ আলোচনা করেছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাদের মধ্যে অন্যতম। বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের কলকাতা অধিবেশনে তিনি বাঙালি জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করেন। তিনি বাঙালিকে আত্মভোলা জাতি বলে অভিহিত করেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, “আধুনিক নৃতাত্ত্বিকরা অনুমান করেছেন যে, মোঙ্গল ও দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণের ফলেই বাঙালি জাতির উৎপত্তি হয়েছে।” বাঙালির মধ্যে আর্য প্রভাব খুবই কম। তাঁর মতে, আর্য ভাষাভাষী পাঠানাদি জাতিসমূহের মধ্যে এবং গুজরাটি, মারাঠি, উড়িয়া ও বাঙালিদের মধ্যে যে চওড়া মাথা দেখা যায় তা একই মূল থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। এরাই ‘বাঙলা’ বা ‘বঙ্গ’ প্রদেশে বসতি স্থাপন করেছে এবং বাঙালি নামে পরিচিত।
২. বাঙালি জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে হার্বার্ট রিজলির মত : হার্বার্ট রিজলি বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে “বাঙালি তত্ত্ব” নামক প্রবন্ধে নৃতাত্ত্বিক পরিসংখ্যানের মাধ্যমে “মস্তক বা মাথা”র আকার আকৃতি বিশ্লেষণ করে বলেন “উড়িষ্যা ও বাঙালিদের চওড়া মাথা মোঙ্গল ও দ্রাবিড়ের মিশ্রণজাত। সুতরাং এ মোঙ্গল ও দ্রাবিড় থেকেই বাঙালির উৎপত্তি।” কিন্তু রিজলি সাহেবের উপর্যুক্ত মতবাদকে পরবর্তী সময়ে অযথার্থ বলে প্রমাণ করা হয়েছে। বর্তমানে এটা সর্বজনসম্মত যে বাঙালি জাতিতে কোনো মোঙ্গলীয় রক্তের সংমিশ্রণ ঘটে নি।
৩. নৃবিজ্ঞানী রেল স্টিনের অভিমত : প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানী আচার্য রেল স্টিন মধ্য এশিয়ায় প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে এসে বাঙালি জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে কিছু তথ্য আবিষ্কার করেন। তিনি বাঙালি জাতির উৎপত্তি অনুসন্ধানে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পরিমাপ করেন। তাঁর আবিষ্কৃত তথ্যের আলোকে টি. এস. জয়েস বাঙালির উৎপত্তি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
৪. বাঙালির উৎপত্তি সম্পর্কে টি. এস. জয়েসের বক্তব্য : জয়েস রেল স্টিনের বক্তব্যের বিশ্লেষণ করে বলেন, মধ্য এশিয়ার তরু-মকান মরুভূমির চারদিকে যারা বসবাস করতো তাদের মস্তক হলো চওড়া এবং এরা আর্য-ইরানি ভাষা ব্যবহার করতো। ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্তের হিন্দু-আফগান জাতি ও আর্য-ইরানি ভাষা ব্যবহার করতো এদের মাথা ততটা চওড়া নয় । মধ্যম করোটি এ দুই জাতির সংমিশ্রণের ফল। এ দুই ধরনের করোটির সংমিশ্রণে বাঙালি জাতির উদ্ভব বলে তিনি মনে করেন।
৫. বাঙালির উৎপত্তি সম্পর্কে রামপ্রসাদ চন্দ্রের অভিমত : তিনি রিজলির মতবাদের সমালোচনা করেন এবং “Indo Aryan Races” নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, পামির ও টাকলামান অঞ্চলের অধিবাসীদের হোমো-আল্পাইনস বলা হয়। এরাই বাঙালির আদি পুরুষ। এরা আর্য ভাষা ব্যবহার করলেও তারা আর্য জাতি থেকে পৃথক ছিল।
৬. প্রশান্তচন্দ্ৰ মহলানবিশ এর মতে বাঙালি জাতির উৎপত্তি : তিনি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির আলোকে বাঙালি জাতির উৎপত্তি অনুসন্ধান করেছেন। দৈহিক গঠনের মাপজোখ করে তিনি কয়েকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন-
ক. বাঙালি জাতি ভারতের অন্যান্য জাতি থেকে পৃথক স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট জাতি।
খ. ভারতের অন্যান্য প্রদেশের ব্রাহ্মণ বাংলার ব্রাহ্মণের সাথে এ দেশীয় ব্রাহ্মণের অধিক মিল রয়েছে আর বাঙালি ব্রাহ্মণের সাথে বাংলার কায়স্ত, কৈবর্ত, সদগোপ এর অধিক মিল রয়েছে।
৭. পণ্ডিত বিরজাশঙ্কর গুহের মতে বাঙালি জাতির উৎপত্তি : পণ্ডিত প্রবর বিরজাশঙ্করের মতে, বাঙালি জাতির পূর্ব পুরুষরা পারস্য ও বেলুচিস্তান অঞ্চল থেকে এসেছিলেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে আমরা বলতে পারি, বাঙালি জাতি একটি সংকর জাতি। তাই তাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় অত্যন্ত জটিল। বাঙালি জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে পণ্ডিতগণ যে সব মতামত দিয়েছেন তা যথার্থ তথ্য প্রমাণ সমর্থিত নয়। তাছাড়া পণ্ডিতরাও ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেন নি। মোটের উপর একথা বলাই সংগত যে বাঙালির উৎপত্তি সম্বন্ধে নিশ্চিতরূপে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না।