বাউল দর্শনের প্রেমতত্ত্ব আলোচনা কর ।
অথবা, বাউল প্রেমতত্ত্ব ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাউল প্রেমতত্ত্ব কী?
অথবা, বাউল দর্শনের আলোকে প্রেমতত্ত্ব সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা : বাংলার এক শ্রেণির অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত একতারা আশ্রয়ী, ভাববিদ্রোহী গায়ক, স্বাধীন ও সমন্বয়মূলক মরমি সাধকদের আত্মোপলব্ধিমূলক চিন্তাধারার নাম বাউল দর্শন। বাংলার নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের এক শ্রেণির পাগল, উন্মাদ, ভাববিদ্রোহী, উদাসী, সংসার বিবাগী মরমিসাধকই বাউল নামে পরিচিত। বাউলরা পাগল বা উন্মাদ সত্য তবে তাঁরা সংসার বিবাগী ভাবের বা প্রেমের পাগল, তাঁরা কোনো অবস্থাতেই মস্তিষ্ক বিকৃতিজনিত পাগল নয়। অর্থাৎ বাউলরা সাধক তাঁরা বাউলদের প্রেম সাধনার এ দিকটিই বাউল প্রেমতত্ত্ব নামে সমধিক খ্যাত ।
বাউল প্রেমতত্ত্ব : প্রেম বাউল ধর্ম, দর্শন ও সাধনার মূলতত্ত্ব। বাউল মত ও পথের অনুসারীরা তাঁদের গানে ও সাধন ক্রিয়ায় প্রেমের সাধনাই করে। তাঁদের মতে প্রেমহীন জীবন সকল প্রকার সাধনার অন্তরায়। প্রেমে তন্ময়তার মধ্য দিয়েই বাউলরা পরমাত্মা বা পরম তত্ত্বের সাথে একাত্ম হতে চান, উপলব্ধি করতে চান। বাউলরা প্রেমে পাগল, তবে তাঁরা ডবের প্রেম বা স্থূল দেহ ইন্দ্ৰিয় আশ্রিত ভোগ-মোহ লালসার প্রেমে পাগল নয়। তাঁদের প্রেম সূক্ষ্ম বা উচ্চস্তরের আধ্যাত্মিক বৈশিষ্টমণ্ডিত ঐশী প্রেম, তথা মানবাত্মার সাথে পরমাত্মার মহামিলন ঘটানোর প্রেম। তাই বলা হয়, বাউলদের প্রেম একদিকে সহজ হিসেবে পরম তত্ত্ব, অপরদিকে ‘জীব’ হিসেবে মানবাত্মার মধ্যকার প্রেম। এদিক থেকে বাউলের প্রেম মিলন মনের মানুষের সাথে মিলন, মানবাত্মার সাথে মিলন বুঝায়। বাউল গানে যে প্রেমের কথা শোনা যায়, তা মানব ব্যক্তি ও আত্মারূপে প্রকাশিত পরম ঐশী ব্যক্তিত্বের প্রেম। অনেকটা হাল্লাজ মনসুরের ‘আনাল হক’ বা ‘আমিই সত্য’ এর মতো প্রেম। এ প্রেম অর্থ আত্মার প্রেম যা ক্রমশ মানবিক দৈহিক কামজাত প্রেম থেকে পরম ঐশী প্রেমে পৌঁছায়। বাউল
প্রেমতত্ত্বের একটি চিত্তাকর্ষক বর্ণনা আমরা পাই বাংলার বাউলকুল শিরোমণি লালন শাহের কাছ থেকে। তিনি বলেন, “বাউল প্রেমতত্ত্ব রমণী, যুবতী বা কামিনীর প্রেম নয় কিংবা লোভী ও কামী ব্যক্তির পার্থিব ধর্ম, সম্পদ, দালানকোঠা, বাড়ি, স্ত্রীপুত্র, পরিবার পরিজন, প্রভাব প্রতিপত্তি, দম্ভ, অহংকার ইত্যাদির প্রতি আকর্ষণ নয়, লোভী, কামী প্রভৃতি শ্রেণির লোকের প্রেমের রাজ্যে প্রবেশাধিকার নেই। এ প্রেম প্রাকৃতিক প্রেম নয় বরং কাম হতে প্রেমে উত্তীর্ণ হওয়ার ঐশ্বরিক প্রেম,” [বাংলার বাউল দর্শন, মোঃ সোলায়মান আলী সরকার, পৃ. ১৮১-৮২] তাই তিনি উপদেশ দিয়েছেন, “পড়ো সহজ প্রেম স্কুলে জ্ঞানের উদয় হবে, যাবে ভুল।” তিনি প্রেম সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে আরো বলেন, প্রেম সমগ্র বিশ্বের সকল বস্তু ও সত্তার মধ্য থেকে জীবনকে অস্তিত্বের এক স্তর থেকে অন্য স্তরে নিয়ে যায়, জীবন তার মূল উৎসের সাথে মিশে যেতে চায় এবং এটা প্রেম শক্তির বাহুবলে সমূহ হয়। এ দৃষ্টিতে দেখলে লালন তথা বাউল প্রেমতত্ত্বে সুফিবাদ প্রভাবিত বলেই মনে হয়। সুফিবাদের খোদাপ্রেমে মত্ত হয়ে জীবনের অস্তিত্বকে বিলীন করে তাঁর সাথে মিশে যাওয়ার যে প্রচেষ্টা তাই লালনের এ বক্তব্যে বিধৃত। প্রেম সাগরের আদ জলে ডুবে প্রেমিক মরা কেবল আল্লা-নবী বুলি বলে, মৃত্যুকে ভয় করে না। প্রেম সাগরের জলে যখন ডুব দেওয়া যায়,তখন প্রেমের প্রকৃত স্বরূপ খুলে যায়। তাই লালন তাঁর দীর্ঘজীবনের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, “আমি দুই দিয়ে রূপ দেখলাম প্রেম নদীতে, আল্লাহ আদম ও মুহাম্মদ তিনজনা এক নুরেতে।”
অনেকের মতে বাউল প্রেমতত্ত্ব বৈষ্ণব প্রেমতত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। আবার কারো মতে বাউল প্রেমতত্ত্ব অদ্বয়বাদ বা অদ্বৈতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। তবে বাউল প্রেমতত্ত্বে এসব উৎসের সামান্য প্রভাব স্বীকার্য-হলেও বৈষ্ণব সহজিয়া ও বাউল প্রেমতত্ত্বের মধ্যে পার্থক্য আছে। বৈষ্ণব সহজিয়াদের প্রেম হলো নর-নারী রূপে প্রকাশিত রাধা-কৃষ্ণের প্রেম। এ প্রে আত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে ঐশী প্রেম নয়। কিন্তু বাউলরা যে প্রেমের কথা বলে তা মানব ব্যক্তিত্ব ও আত্মারূপে প্রকাশিত পরম ঐশী ব্যক্তি প্রেম তথা মানবাত্মা ও পরমাত্মার সংযোগ সাধনকারী প্রেম। এ ঐশী প্রেম তত্ত্বই নানাভাবে বাউল গানে
প্রকাশিত হয়েছে।
উপসংহার : অতএব, প্রেমের সাধনাই বাউল সাধনা। এই প্রেমের টানেই বাউলরা পাগল হন সংসার বিরাধী উদাসী হন। এ প্রেমে যে কি সুখ তা বলে শেষ করা যায় না। তাই বাউল সম্রাট লালন বলেন, “প্রেমের রাজ্যে কত সুখ দেয তাহা বলা যায় না। যে এসেছে সে মজেছে, অন্য রাজ্যে যেতে চায় না।”