বাংলাদেশে নারী আন্দোলনের প্রকৃতি ও বিকাশ আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশে নারী আন্দোলনের ধরন ও পরিবেশগত দিক ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাংলাদেশে নারী আন্দোলনের ধরন ও পরিবেশগত দিক সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে নারী আন্দোলনের প্রকৃতি ও পরিধি এবং বিকাশ সম্পর্কে বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
“আমরা সমাজের অর্ধস্পদ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কি করে। কোনো ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে খোড়াইয়া খোড়াইয়া কতদূর চলিবে। পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে, একই। আমরা অকর্মণ্য পুতুল জীবন বহন করিবার জন্য সৃষ্টি হই নাই।” -বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। কিন্তু পুরুষ শাসিত এ সমাজে নারীদের নেই কোনো অধিকার, সামাজিক মূল্যবোধ। এ সমাজ পুরুষের মতো নারীদের সমান সুযোগ সুবিধা দিতে নারাজ। এখানে নারী-পুরষের মধ্যে ব্যবধান অতিমাত্রায় লক্ষণীয়। নারীদের সম্পর্কে যে বৈষম্য ও অন্যায় রয়েছে, সে ব্যাপারে উপলব্ধি এবং তাকে মেনে নেয়ার অসম্মতির মধ্য দিয়েই নারী আন্দোলনের সূত্রপাত।
বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের প্রকৃতি ও বিকাশ : তিনশ বছরের ঐতিহ্যপূর্ণ বিশ্ব নারী জাগরণ ও আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে উনিশ শতকে গড়ে উঠা বাংলার নারী আন্দোলনের পটভূমিকায় বিশেষ করে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের বিকাশ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো। বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের ঐতিহাসিক সময় খুব বেশি দিনের নয়। বামাসুন্দরী দেবীর আত্মকথা রচনার মধ্যে বলা যায় তার শুরু। নারী আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যক্তিত্ব অনেক বেশি প্রণিধানযোগ্য ছিল। সে থেকে শুরু করে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, প্রীতিলতা, সুফিয়া কামাল সবাই এসে যায়। এক্ষেত্রে কিছুটা পিছনের দিকে তাকাতে
গেলে আমরা ব্রিটিশ সময় এবং পাকিস্তানের সময় থেকে নারী আন্দোলনকে দেখতে পারি। ব্রিটিশ আমলে নারী আন্দোলন কোনো সাংগঠনিক রূপ লাভ করেনি। সে সময়ে আন্দোলনের ছিল দুটি রূপ। যথা:
১.স্বাধীনতা আন্দোলন এবং
২.সমাজসেবামূলক আন্দোলন।
পাকিস্তান পর্যায়ে নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রে বামপন্থি চিন্তাধারায় প্রভাবিত কিছু ব্যক্তিত্ব এবং জাতীয়তাবাদী চিন্তার মিলিত ফসলে গড়ে উঠে নারী সংগঠন মহিলা পরিষদ। এ পর্যায়ে নারী আন্দোলনের চরিত্রে ছিল নারীসমাজের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা, সর্বত্র নারীর উন্নয়নে কল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করা এবং নারীসমাজের মুক্তির জন্য দেশের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দান করা। এ পর্যায়ে নারী আন্দোলনে নারীসমাজের ভূমিকা অনুসৃত হয়। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভের পর তৃণমূল পর্যায়ের আন্দোলনে নারীসমাজ টার্গেট গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত হয়ে এন.জি. ও কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়। সে সাথে নারী দশকের প্রেক্ষাপটে ‘উন্নয়নে নারী’ কর্মসূচি গৃহীত হয়। এর আগে থেকে মহিলা পরিষদ নারীর অধিকার প্রশ্নে নারী আন্দোলনে জড়িত ছিল। তবে মহিলা পরিষদের মূল ফোকাস ছিল সে সময়ে শ্রেণি সম্পর্কিত। নারী দশক পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশে নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক ধরনের গতিশীলতা পরিলক্ষিত হয়। এ সময় নারীর পক্ষ, রূপান্তর, নারী প্রগতি সংঘ, নারী সংহতি এবং আরো অন্যান্য অনেক ছোট ছোট নারী সংগঠন গড়ে উঠে, যারা শ্রেণি সম্পর্কের পাশাপাশি সমাজে বিদ্যমান পিতৃতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। এ সময় নারী প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজে, পরিবারে, রাষ্ট্রে সমঅধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিশেষ ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন পরিচালনা করে। এসব ইস্যুগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল,
১. এসিড নিক্ষেপ বিরোধী আন্দোলন।
২. যৌতুক বিরোধী আন্দোলন।
৩. নারীনির্যাতন বিরোধী আন্দোলন।
৪. রাষ্ট্রধর্ম বিল বিরোধী আন্দোলন।
৫. ইউনিফরম ফ্যামিলি কোড এর সপক্ষে আন্দোলন।
এ সময়ে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিয়মিত সভাসমিতি অনুষ্ঠিত হতে থাকে। গবেষণা সংস্থা, উইমেন ফর উইমেন প্রতি বছর বিশেষ ইস্যু নিয়ে বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠানের মধ্যে নির্দিষ্ট সুপারিশমালা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে প্রেরণের প্রচেষ্টা চালায়। এভাবেই নারী আন্দোলনে একটা ধারাবাহিকতা সৃষ্টির মাধ্যমে আন্দোলনকে গতিশীল করার প্রয়াসী হয়। ১৯৮৭ সালে, ‘সমমনা’ ১৪টি সংগঠন নিয়ে নারীর সমানাধিকারের দাবিতে ‘ঐক্যবদ্ধ নারীসমাজ’ গড়ে উঠে। এ সংগঠনটি তাদের ১৭ দফা কর্মসূচিতে উল্লেখ করে যে, নারীনির্যাতন, শোষণ, বৈষম্য দূর করার উপযোগী সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পরিবেশ ও শাসননীতি ছাড়া নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা হতে পারবে না। ১৯৯৪ সালে, ‘ফতোয়ার প্রকোপ’ নারী সংগঠনগুলোকে আবারও তৎপর ও প্রতিবাদী করে তোলে। ফলে ফতোয়াবাজরা যেভাবে আগ্রাসী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তা থেকে সাময়িকভাবে হলেও বিরত হয় এবং সরকারও এক্ষেত্রে ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশে নারী আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে যে বিষয়টি আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে নারী আন্দোলনের চরিত্র। নারী আন্দোলনের সাথে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন কখনো কখনো সম্পৃক্ত হয়েছে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে। বিশেষ করে দেখা গেছে, যখন সামরিক শাসনের পর্যায়ে জাতীয় রাজনীতি মন্থর, তখন নারী আন্দোলন বেগবান হয়েছে। সে কারণে আমাদের দেশের নারী আন্দোলনে এখনো খুব শক্তিশালী ধারাবাহিকতা তৈরি হয়নি বা এমন কোনো মতাদর্শ গঠিত হয়নি, যার ভিত্তিতে একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করা যায়। সে সাথে সাংগঠনিক শক্তির দুর্বলতাও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গে আমাদের মনে প্রশ্নের জন্ম দেয়। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত ব্রিটিশ শাসন আমলে। এ পর্যায়ে প্রীতিলতা, ইলামিত্র, লীলানাগ, কল্পনা দত্ত, প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। মাস্টারদা সূর্যসেনের আদর্শের অনুসারী প্রীতিলতা স্বদেশী আন্দোলনে বিপ্লবী দলে যোগ দেন ১৯৩০ এর দশকে। যদিও সে সময়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ প্রথম দিকে ছিল নিষিদ্ধ কিন্তু প্রীতিলতা নারী পুরুষের মধ্যকার বৈষম্যকে পরাভূত করতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ ছিল একই সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ। প্রত্যক্ষভাবে নারী অস্ত্র তুলে
নিয়ে যুদ্ধ করেছে। অন্যদিকে, মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিয়ে, তথ্য দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে এবং পাকিস্তানি সৈন্যের কাছে ধর্ষিত হয়ে নারী বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এ পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেছে। আজকের বাংলাদেশে প্রয়োজন স্বতন্ত্র নারী আন্দোলনের ধারা, যেখানে নারী প্রশ্নের বিভিন্ন দিক উত্থাপিত হবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দুটি প্রধান ধারা দেখা যায় । যথা :
১. একটি ইসলামিক ধারা এবং
২. আরেকটি নিজেদের বাঙালি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় চিহ্নিত করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে আমরা বলতে পারি, বর্তমান রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখা যাচ্ছে নারী বিষয়ক কর্মসূচিগুলো নারী আন্দোলন থেকে উৎসারিত হচ্ছে। কোনো রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা নয়, বরং রাজনৈতিক দলগুলোর দলীয় কর্মসূচিতে এগুলো এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। নারী আন্দোলন মনে করছে না যে, জাতীয় মুক্তি এলেই নারীমুক্তি এসে যাবে। তাই মূলধারার রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থানকে সংহত করতে বর্তমানে নারী আন্দোলন জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%b8%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6%e0%a7%87/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*