বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের মূল ইস্যু আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের মূল ইস্যু বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের মূল ইস্যু তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা : নারী আন্দোলন সামাজিক আন্দোলনেরই একটি অংশ। নারী আন্দোলন হলো নারীদের প্রি সামাজিক বৈষম্য ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পরিচালিত আন্দোলন। নারী আন্দোলন হলো সামাজিক সমতা ও নারী স্বাধীনতার আন্দোলন। একে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারীদের পরিচালিত আন্দোলনও বলে। কারণ পুরুষতন্ত্র যুগ যুগ ধরে নারীকে তাদের খেয়ালখুশি মতো পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত করে আসছে। তাই নারী আন্দোলন হলো নারীর মুক্তির ও ক্ষমতায়নের আন্দোলন।
বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের মূল ইস্যু : বাংলাদেশের নারীগণ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করছেন। এসব ইস্যুগুলোর উদ্দেশ্য হলো নারীর মুক্তি, পুরুষতন্ত্রের নাগপাশ হতে মুক্তি, তার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, সিডো সনদ বাস্তবায়ন, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করা, তার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার রক্ষা করা, নারীর ক্ষমতায়ন, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা
কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মৌলবাদ প্রতিহত করা, ধর্মীয় গোঁড়ামি বন্ধ করা ও নারী মুক্তি। বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের মূল ইস্যুগুলো
নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. সম্পত্তিতে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা : বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের একটি অন্যতম ইস্যু হলো সম্পত্তিতে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এদেশের মুসলিম আইনে নারী পিতার সম্পত্তির মালিকানা লাভ করে। তার অংশ হলো পুত্রের অর্ধেক। হিন্দু আইনে নারী পিতার সম্পত্তির অংশ পায় না। বিবাহের সময় পিতা এর পরিবর্তে মেয়েকে যৌতুক দান করে। বৌদ্ধ আইনে কন্যা পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকার পায় না। স্বামীর সম্পত্তির কত অংশ পাবে তারও উল্লেখ নেই। আর খ্রিস্টান নারীগণ ১৯২৫ সালে প্রণীত The Law of Succession Act অনুযায়ী পিতার সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ পাবে। এ জন্য এদেশের নারীগণ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নারীর জন্য সম্পত্তিতে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছে। এটা তাদের আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। তবে তাদের এ দাবি এখনও পূর্ণ হয় নি।
২. বিবাহ-বিচ্ছেদে নারীর অধিকার বিষয়ক আইন প্রণয়ন : বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো বিবাহ-বিচ্ছেদে নারীর অধিকার বিষয়ক আইন পাস। এদেশের নারীগণ বিবাহ-বিচ্ছেদ হলে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুসলিম হলে তারা ৩ মাস ১৩ দিনের জন্য খোরপোষ পায়। মুসলিম আইনে স্ত্রী কতকগুলো শর্তসাপেক্ষে তালাক দিতে পারে। এক্ষেত্রে সে ডিগ্রী লাভের অধিকারী। এসব শর্ত হলো স্বামীর নিরুদ্দেশ হওয়া, ভরণপোষণের অক্ষমতা, স্ত্রীর অনুমতি ব্যতীত পুনঃবিবাহ করা, পাগল হওয়া, ৭ বছরের বেশি কারাবাস, চরিত্রহীনতা ইত্যাদি। তালাকের ক্ষেত্রে পুরুষের একাধিপত্য বিরাজমান। বাংলাদেশে হিন্দুরা বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে না। ১৯৫৫ সালের বিবাহ-বিচ্ছেদ আইন অনুযায়ী ভারতের হিন্দু নারী-পুরুষ কারণ দর্শিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে না। এজন্য বাংলাদেশের নারীগণ বিবাহ-বিচ্ছেদে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আইন প্রণয়নের দাবিদার।
৩. সন্তানের অভিভাবকত্বে মা-বাবার ক্ষেত্রে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করা : বাংলাদেশের নারীদের আন্দোলনের আর একটি ইস্যু হলো সন্তানের অভিভাবকত্বে মা বাবার সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করা। মুসলিম আইনে মা সন্তানের অভিভাবক হতে পারে না। তবে পুত্র সাত বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত মায়ের এবং কন্যা বয়োপ্রাপ্তি অর্জন না করা পর্যন্ত মাতার হেফাজতে থাকবে। তবে যা অন্য কাউকে বিবাহ করলে সে তার অভিভাবকত্ব হারাবে। হিন্দু আইনে মেয়েদের অভিভাবক পিতা। বিয়ের পর তার অভিভাবক স্বামী । তবে পিতার অবর্তমানে মা তার সন্তানের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করতে পারে। আইনের এসব ত্রুটি দূর করে বাংলাদেশের নারী সংগঠনগুলো সন্তানের সম-অভিভাবকত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছে। তারা চায় যে, মা-বাব উভয়ই হবে সন্তানের অভিভাবক। আর এটা হবে সমতার ভিত্তিতে।
৪. সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন : বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য ৪৫টি আসন সংরক্ষিত। এসব আসনের অধিকাংশ বা সব লাভ করে বিজয়ী দল। তারা তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী তাদের আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিত কাউকে এর আসনে মনোনয়ন দেয়। ফলে সংরক্ষিত আসনে মনোনীত নারী সাংসদে কোন মর্যাদা লাভ করে না। তারা ক্ষমতাসীন দলের দয়ার উপর নির্ভর করে। এজন্য এদেশের নারীরা সংরক্ষিত আসনে প্রত্যক্ষ নির্বাচন দাবি করে আসছে। এতে তাদের মর্যাদা বাড়বে। তারা হবে Politicized. এজন্য এদেশের নারী আন্দোলনের একটি বড় ইস্যু হলো সংরক্ষিত আসনে প্রত্যক্ষ বা সরাসরি নির্বাচন।
৫. পাসপোর্টে স্বামীর সম্পত্তির ধারণাটি বাদ দেয়া : বাংলাদেশে নারী আন্দোলনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো পাসপোর্ট থেকে স্বামীর সম্মতির ধারাটি বাদ দেয়া। কারণ এটা তাদের জন্য অপমানজনক ও মর্যাদা হানিকর । পাসপোর্ট লাভ করা একটি অধিকার। নারী চাকরি বা উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে পারে। এটা তার জন্য মর্যাদাকর। এ ধারাবলে স্বামী তার আশা ভঙ্গ করে দিতে পারে। কারণ এ ধারাবলে স্বামী পাসপোর্টে সম্মতি না দিয়ে স্ত্রীর বিদেশ যাত্রা ব্যাহত করে দিতে পারে। এটা নারীর জন্য অবমানকর।
৬. যৌতুক বিরোধী আইন বাস্তবায়ন করা : বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের একটি মূল ইস্যু হলো যৌতুক বিরোধী আইন বাস্তবায়ন করা। বাংলাদেশ সরকার যৌতুক বিরোধী আইন পাস করলেও যৌতুক বন্ধ হচ্ছে না। এখনো অনেক নারীকে যৌতুকের বলি হতে হচ্ছে। এজন্য যৌতুক বন্ধ করার জন্য যৌতুক বিরোধী আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।
এটা নারী সমাজের দাবি।
৭. নারী হত্যা-নির্যাতন বন্ধ করা : বাংলাদেশে নারী নির্যাতন বন্ধ করার জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু নারী হত্যা ও নির্যাতন বন্ধ হয়নি। প্রতিনিয়ত নারী হত্যা ও নির্যাতন বেড়েই চলছে। অপরাধীরা আইনের ফাঁক- ফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। এজন্য নারীরা একে তাদের আন্দোলনের বড় একটি ইস্যু হিসেবে বিবেচনা করে। তাই তারা আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
৮. সিডো সনদে সরকারকে পূর্ণ স্বাক্ষরে বাধ্য করা : সিডোকে নারী মুক্তির সনদ বলা হয়। জাতিসংঘ ১৯৭৯ সালে সিডো সনদ গ্রহণ করে। এতে নারী মুক্তির জন্য নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূর করার জন্য আহ্বান জানায়। কিন্তু বাংলাদেশ সিডোর ২নং ধারা এবং ধারা ১৬-১(গ) অনুমোদন করে নি। এ ধারায় নারী-পুরুষ সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা
বলা হয়। সরকার ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি আঘাতের কথা বিবেচনা করে এটা করে নি। কিন্তু নারীরা সিডো সনদের পূর্ণ বাস্ত বায়নের জন্য আন্দোলন করছে।
৯. ইউনিফরম ফ্যামিলি কোড প্রণয়ন করা : বাংলাদেশের নারী আন্দোলনকারীদের আর একটি দাবি বা ইস্যু হলো ইউনিফরম ফ্যামিলি কোড প্রবর্তন করা। এতে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল নর-নারীর জন্য একই রকম পারিবারিক বিধি বিধান থাকবে। এটা বিবাহ, পরিবার গঠন, সন্তানের উত্তরাধিকার, অভিভাবকত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে সকলের জন্য একই বিধি- বিধান থাকবে। ফলে দূরীভূত হবে নারী-পুরুষ বৈষম্য।
১০. ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা : নারী আন্দোলনের আর একটি ইস্যু হলো ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। কারণ অসাধু রাজনীতিকগণ ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটে। এতে ধর্ম কলুষিত হয়। ধর্মের নামে দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় প্রায় ৬ লক্ষ লোককে হত্যা করা হয়। কিন্তু কোন ধর্মে বিনা অপরাধে বা বিনা বিচারে কোন মানুষকে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয় নি। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে নারী সমাজের দীর্ঘ দিনের দাবি পূরণ হবে। কারণ ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ফলে নারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১১. যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা : যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা নারী আন্দোলনের একটি বড় ইস্যু। এজন্য নারীরা অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। প্রয়াত নারী নেত্রী জাহানারা ইমাম এজন্য একটি আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। যাহোক সরকার যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এজন্য ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়েছে। ট্রাইবুনাল ইতিমধ্যে মওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকে তার অনুপস্থিতিতে বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীর বিচার হলে নারী সমাজের একটি দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হবে।
১২. ফতোয়া বন্ধ করা : ফতোয়া একটি ধর্মীয় হাতিয়ার। ধর্মীয় বিষয়ে সমাধানের জন্য ফতোয়া ব্যবহার করা হয়। এটা করেন ইসলামি শাস্ত্রে সুনিপুণ পণ্ডিতগণ। কিন্তু এদেশে এটা প্রয়োগ করে ধর্মান্ধ, অশিক্ষিত ও টাউট বাটপার শ্রেণী। আর এটা প্রয়োগ করা হয় অবলা নারীদের বিরুদ্ধে। এই ফতোয়ার শিকার নূরজাহান, কদবানুর মত দুঃস্থ নারীরা। এর মাধ্যমে নারীদের বেত্রাঘাত, দোররা মারা হয়। অনেক সময় তাদের মাটিতে পুতে পাথর নিক্ষেপ করা হয়। বাংলাদেশের প্রধান আদালত সুপ্রিম কোর্ট এই অমানবিক প্রথা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। তবুও এটা বন্ধ হচ্ছে না। এজন্য এটি নারী আন্দোলনের একটি বড় ইস্যু।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, এদেশের নারীরা স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রাম পরিচালনা করেছেন। তারা ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করেছেন। তারা ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছে। তারা আরও নারী অধিকার, স্বাধীনতা, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে এসেছে। তাদের সংগ্রামের ফলে সিডো সনদ গ্রহণ, নারী নির্যাতন বন্ধে সরকার কর্তৃক বিভিন্ন আইন প্রণয়ন, সরকার কর্তৃক নারী উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মকৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। নারী আন্দোলনের ফলে নারী আজ তার বর্তমান অবস্থানে পৌঁছেছে।