বর্তমানে বাংলাদেশে নারীদের প্রতি যে ভয়াবহ নির্যাতন চলছে তা বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের বর্তমান চিত্র তুলে ধর।
অথবা, বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা ও ধারা বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা ও ধারা সম্পর্কে বিবরণ দাও ।
উত্তর৷ ভূমিকা : অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বর্তমান বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা, সংখ্যা ও ভয়াবহতা উভয় দিক থেকেই বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সত্য অনস্বীকার্য। প্রতিদিনের দৈনিক পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত নারী
নির্যাতনের ঘটনায় এ সত্য প্রমাণিত হয়। ২০০০ সালে প্রকাশিত দক্ষিণ এশিয়ার মানব উন্নয়ন রিপোর্টে নারী নির্যাতন অধ্যায়ে বাংলাদেশের স্থান ছিল তৃতীয়। কারণ অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে সমগ্র বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে বহুমাত্রিক উপায়ে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এটি এক কালো অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। এ স্বল্প সময়ে ৫০০ নারী ও মেয়ে শিশুদের উপর হামলা করে বিজয় উল্লাসে ধর্ষণ করা হয়েছে। এসব ঘটনাকে ‘পাশবিক’ বললে পশুদেরও অপমান করা হয়।
নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা ও ধারা : নারী নির্যাতনের এ যাবৎ কালের সমাজতান্ত্রিক মনস্তাত্ত্বিক এবং নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের বাইরে বর্তমান সময়ে যে ভয়ঙ্কর ধারা লক্ষ্য করা হয়, সেগুলো নিম্নরূপঃ
১. রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা: অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য নারী নির্যাতনের এ হীন কৌশলটি অধিক ব্যবহৃত হয়েছে। ছবিরানী মন্ডলের ঘটনা, রাজশাহীর মহিমাসহ অসংখ্য নৃশংস বর্বরোচিত ঘটনা ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক দলের প্রশ্রয়ে রাজনৈতিক নেতাদের ক্যাডার দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। রাজনীতিতে সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাসী পালনের যে সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে তার খেসারত বা মূল্য অদূর ভবিষ্যতে সমগ্র জাতিকেই দিতে হবে।
২. ধর্ষণ নিয়ে বাণিজ্য : রাজশাহী জেলার পুঠিয়ার মহিমার ধর্ষণের ছবি তোলার খবর এবং হাটের দিনে উক্ত ছবির।স্টিল ফটোগ্রাফ প্রদর্শনের খবর আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু ধর্ষণের ভিডিও করে ব্লু-ফ্লিম তৈরি করা কাজটি বাংলাদেশে শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর পূর্বে। ধর্ষণ নিয়ে এ বাণিজ্য করার প্রবণতা ১০ বছর পূর্বেও বাংলাদেশের মানসিকতায় ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
৩. গ্লোবালাইজেশন : গ্লোবালাইজেশনের প্রভাবে কর্মসংস্থানের লোভে পড়ে নারী ও শিশু পাচার হচ্ছে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পতিতালয়ে বাংলাদেশের নারী বিক্রি হচ্ছে এবং মানবেতর জীবনযাপন করেছে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজী জুটমিল বন্ধের প্রভাব নারীসমাজের উপর পড়তে বাধ্য। এভাবে তৈল, গ্যাস রপ্তানির কুফলও নারীকে ভোগ করতে হবে।
৪. শিশু হত্যা ও ধর্ষণ : শিশু হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি সংঘটিত শিহাব, নওশীন, তৃষ্ণা, বাপ্পী, হৃদয়, ডন ও রত্নার হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশের মানুষ শোকে মুহ্যমান, ক্ষুব্ধ, উৎকণ্ঠিত, উদ্বিগ্ন। এরা প্রত্যেকেই শিশু। এ সুন্দর পৃথিবীকে ভালোভাবে দেখার, উপলব্ধি করার পূর্বেই তাদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাদের মায়েরাও এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এখন বাংলাদেশে প্রতিমাসে খুন হচ্ছে ৩৯টি শিশু।
৫. ভয়াবহতা : নারী নির্যাতনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও জঘন্য অপরাধ ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ ও খুন। এ ধারার মধ্যে আরও লক্ষণীয় দিক হল নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা। যেমন- ক. গণধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। খ, গণধর্ষণের পরে নারীর বাঁচার সম্ভাবনাকে শেষ করে দেয়া হচ্ছে। গ. ধর্ষণের চিত্র Video করে ব্লু ফ্লিম তৈরি করা হচ্ছে।
৬. পুলিশ কর্তৃক নারী নির্যাতনের তালিকা : পুলিশের খাতায় রেজিস্ট্রিকৃত পাঁচ বছরের চিত্রে দেখা যায়, ১৯৯৭ সালে মোট নারী নির্যাতন সংঘটিত হয়েছে ৫,৮৪৩। ২০০১ সালে এর সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ১২,৯৫৮ টিতে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সাংগঠনিক কাজের স্বার্থে পুলিশের সদর দপ্তর থেকে এ পরিসংখ্যান সংগ্রহ করে। নিম্নের ছকে নারী ও শিশু নির্যাতনের তার দেখানো হলো :
৭. অধিকসংখ্যক ধর্ষণ সংঘটিত জেলা : বাংলাদেশের সকল জেলাতেই কমবেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। তবে সীমান্তবর্তী
চরাঞ্চলগুলোতে ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটে। চরাঞ্চলে ফসল কাটার মৌসুমে নিম্নবর্ণের নারী, শিশু প্রভাবশালীদের লাঠিয়াল এলাকায় বিশেষ করে ভোলা, যশোর, নওগাঁ, বরগুনা, পটুয়াখালী, রাজশাহী, নেত্রকোনা, কুমিল্লা, খুলনা, বরিশাল, টাঙ্গাইল এর বাহিনীর নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয় এবং নারী ধর্ষণেরও শিকার হয়।
৮. পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন : গত ২৪ অগাস্ট ২০০২ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত তথ্য মতে, গত ৭ মাসে ৬,৫৮১ জন নারী বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ পরিস্থিতি কতখানি নাজুক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানে একটু লক্ষ্য করলে সহজেই বুঝা যাবে যে, নারী নির্যাতনের প্রকৃত সংখ্যা কি ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সত্য বলতে কি, নারী নির্যাতন দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে গাণিতিক হারে।
৯. ইয়াসমিনসহ চাঞ্চল্যকর নারী হত্যা মামলা : রাষ্ট্র কর্তৃক ইয়াসমিনের ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় বিচার দাবি, সীমা চৌধুরীকে জেলখানায় ধর্ষণ ও হত্যার বিচার দাবি করতে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সবসময়ই সোচ্চার ছিল। যে কোন নারী নির্যাতনের ঘটনায় বাংলাদেশ নারী পরিষদ প্রতিবাদ জানাতে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও আপসহীনভাবে অপরাধীদের শাস্তি দাবি করেছে। নারী নির্যাতনের ঘটনার প্রতিকার ও প্রতিরোধ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের অঙ্গীকার।
১০. নারীবাদী সংগঠন : নারীবাদী বিভিন্ন সংগঠন নারীদের ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যার চিত্র তুলে ধরে। সমতাপূর্ণ, সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা নিয়েই এ সংগঠনের পথ চলা। কিন্তু সন্ত্রাসী রাজনীতির শিকার নারীরা আজকের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা একান্ত জরুরি। নারী ভিন্ন গ্রহের কোন প্রাণী নয়, নারী মানুষ।
পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে সভ্যতা নির্মাণে ঐতিহ্য সৃষ্টিতে নারীরও আছে সমান সংগ্রাম, শ্রম ও মেধা।
১১.মূল্যবোধের অবক্ষয় : নারী নির্যাতন, ধর্ষণ পুরানো বিষয় হলেও উল্লিখিত সাম্প্রতিক প্রবণতা, যা সমাজের ভিতরের মূল্যবোধের অবক্ষয়কে উন্মুক্ত করে দেখিয়ে দেয়। মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে। নারী নির্যাতনের অন্যতম হাতিয়ার ধর্ষণ এখন আর পুরুষতান্ত্রিক বা সামন্ততান্ত্রিক কোন গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। ধর্ষণ একটি রাজনৈতিক
প্রতিশোধ গ্রহণের ঘৃণ্য হাতিয়ার। নারী যেহেতু পুনরুৎপাদন শক্তির অধিকারী, সেহেতু নারীর উপর দিয়েই এ জঘন্য, নোংরা, অমানবিক ঘটনা ঘটে, যা নারীকে আরও বেশি হেয় অবস্থানে ঠেলে দেয়। ধারাগুলো
১২. শামসুন্নাহার হলে পুলিশ প্রবেশ : গত ২৩ জুলাই ২০০২ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে গভীর রাতে পুলিশ প্রবেশ করে নিরীহ সাধারণ ছাত্রীদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এর প্রতিবাদে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা যে আন্দোলন সংগঠিত করেছিল স্বউদ্যোগে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে তা ছিল অভূতপূর্ব। অনেক ছাত্রছাত্রীই সেদিন এ ঘটনার প্রতিবাদে জীবনে প্রথম মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। সুষ্ঠু বিচার দাবিতে আমরণ অনশনে অংশ নিয়েছিলেন। এটি ছিল বিবেকের কাছে বড় প্রশ্ন গভীর রাতে কিভাবে পুলিশ হলে ঢুকে নির্যাতন চালাল অসহায় মেয়েদের উপর।
মূল্যায়ন : নারী নির্যাতনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও জঘন্য অপরাধ ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ ও খুন। নারী নির্যাতনকে নিম্নোক্তভাবে মূল্যায়ন করা যায় :
প্রথমত, সন্ত্রাসীদের দ্বারা আরও নাজেহাল হওয়ার ভয়ে অনেক পরিবার আজ নারী নির্যাতনের হৃদয় বিদারক ঘটনাকেই অস্বীকার করতে সদা সতর্ক থাকছে।
দ্বিতীয়ত, সন্ত্রাসী রাজনীতির সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক মন্দা, অবাধ আকাশ সংস্কৃতির কুপ্রভাব, মানুষের জীবনের নিরাপত্তাহীনতা যখন সমাজে প্রকটভাবে দেখা দেয়, তখন বিভিন্নভাবে নারী নির্যাতনের হার বৃদ্ধি পায় ।
তৃতীয়ত, নারী ভিন্ন গ্রহের কোন প্রাণী নয়, নারীরাও মানুষ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে সভ্যতা নির্মাণে ঐতিহ্য সৃষ্টিতে নারীরও আছে সমান সংগ্রাম, মেধা ও শ্রম।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্রত্যাশা আলোকিত মানুষ সত্যকে সত্য, আলোকে আলো, অসত্যকে ও অন্যায়কে চিহ্নিত করে অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে একযোগে প্রতিকারের ও প্রতিরোধের আন্দোলনে আরও সক্রিয়ভাবে নিজেদের সংঘটিত করতে উদ্বুদ্ধ হবে। জনগণ যাতে নির্যাতন প্রতিরোধে উদ্বুদ্ধ হয় এবং স্থানীয়ভাবে নিজস্ব উদ্যোগে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ প্রতিকারের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত হয়। সাধারণ মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে এমনভাবে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো জনগণের সম্মুখে তুলে ধরতে হবে। কোন সমাজে একটি জাতির অর্ধেক বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, নির্যাতিত ও ধর্ষিত হলে সে সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমাদের সচেতন মহলকে রুখে দাঁড়াতে হবে। তবে এ কথা সত্য যে, সরকার নারী নির্যাতন ও শিশুহত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলার চাঞ্চল্যকর রায় দিয়ে আশার বাণী শুনিয়েছে।