প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পে আদিম জৈব রূপায়ণের মাধ্যমে জীবনসত্যের যে পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে তা আলোচনা কর।

অথবা, ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের একটি মনোজ্ঞ সমালোচনা লিপিবদ্ধ কর।
অথবা, “কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাগৈতিহাসিক গল্পে নিরাভরণ নগ্ন মূর্তিতে সভ্যতার অন্তঃসারশূন্য দেউলে রূপটি অনাবৃত হয়েছে”- উক্তিটির যথার্থতা নিরূপণ কর।
অথবা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পে সভ্যতার যে অন্তঃসারশূন্য দেউলে রূপটি অনাবৃত হয়েছে তার পরিচয় দাও।
অথবা, কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাগৈতিহাসিক গল্পে যে প্রাগৈতিহাসিকতার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তা নিজের ভাষায় লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা :
ত্রিশোত্তর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম রূপকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যক্তিগত জীবনে মার্কসবাদী দর্শনে বিশ্বাস করতেন। তিনি ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এ কারণে তাঁর রচিত গল্প ও উপন্যাসে মানবসভ্যতার অন্তঃসারশূন্য দেউলে রূপটি নিরাভরণ নগ্নমূর্তিতে অনাবৃত হয়েছে। ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের কাহিনিতে এই বক্তব্যের সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়। বিংশ শতাব্দীর আধুনিক সভ্য সমাজের অন্তরালে মানুষের যে আদিম কামনার প্রকাশ্যতম রূপ তা এ গল্পের চরিত্রসমূহের মধ্যে বিরাজমান।
গল্পের পটভূমি : ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের পটভূমি বাংলাদেশের অসভ্য ও অসংস্কৃত সমাজজীবন। যে সমাজে এখনো শিক্ষার আলো, সভ্যতার উপকরণ ও সংস্কৃতির উপাদান অনুপস্থিত সেই সমাজ থেকে গল্পকার ভিথু, পাঁচী, পেহ্লাদ ও বসিরকে তুল এনেছেন। এদের অসভ্য জীবনের প্রাগৈতিহাসিক কামনা-বাসনা ও টিকে থাকার সংকটই এ গল্পের মূল উপজীব্য। এ সকল আদিম ও বন্য মানুষের সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়া, জীবন-জীবিকা, কামনা-বাসনার কথা প্রাগৈতিহাসিক গল্পে তুলে ধরা হয়েছে। এর ফলে মানবসভ্যতার অন্তঃসারশূন্য দেউলে রূপটি অনাবৃত হয়ে ধরা দিয়েছে।
গল্পের বক্তব্য : যে সময় পর্যন্ত আমরা ইতিহাস জানি তার পূর্বেকার সময়ের ঘটনাকে বলা হয় প্রাগৈতিহাসিক। এই যুগে শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির কোন বালাই ছিল না। এ সময়কার মানুষ ক্ষুধা ও কামকে চরিতার্থ করার জন্য জীবনব্যাপী সংগ্রামে লিপ্ত থাকত। কাম ক্ষুধার বাইরে যে অন্য কিছুর প্রয়োজন আছে তা তাদের ধারণায় ছিল না। বিংশ শতাব্দীতে পদার্পণ করার পরও আমাদের সমাজের একটা অংশ এ প্রাগৈতিহাসিকতা পরিহার করতে পারেনি। এ কারণে মানুষের জীবনাচরণে এখনো আদিম বন্যস্ততা বিদ্যমান। এ আদিম বন্যতা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ক্রিয়াশীল। ভিষু, পার্টী ও বসিরের আচার-আচরণে যে আদিমতা প্রকাশ পেয়েছে তা মানবসমাজের অন্তঃসারশূন্য দেউলে রূপটির নিরাভরণ নগ্নমূর্তি ছাড়া অন্য কিছু নয়।
অনাবৃত রূপ : মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হওয়া সত্ত্বেও তার মধ্যে পশুপ্রবৃত্তি গুপ্ত অবস্থায় বিরাজ করে। অনুকূল পরিবেশে অনাদিকাল থেকে লক্ষ্য সেই প্রবৃত্তির মুখোশ অনাবৃত হয়ে পড়ে। হাজারও চেষ্টা করেও মানুষ তাকে লুকিয়ে রাখতে পারে না। তাই করা যায় মানুষের ভিতর ও বাইরের রূপ এক নয়। পরিবেশ ও পরিস্থিতি মানুষের সার্বিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের ডিথুর নগ্নকামনা মানুষের ভিতরকার বর্বরতাকে অনাবৃত করে দিয়েছে। গল্পের কাহিনি পর্যালোচনা করলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বর্তমান সভ্যতার অসামান্য বিকাশ ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিদ্যার আকাশচুম্বী সাফল্যের পরও মানুষের আদিম জীবনযাত্রা ও আদিম
প্রবৃত্তিসমূহ মোটেই স্তিমিত হয়নি বরং আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভিখু এখানে আদিমতার প্রতিনিধি।
সভ্যতার অঃসারশূন্যতা : বিংশ শতাব্দীতে মানবসভ্যতা উন্নতির চরম শিখরে অবস্থান করছে। মানুষ আজ শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বদৌলতে নতুন নতুন সভ্যতা গড়ে তুলেছে। ফলে অবসান হয়েছে আদিম যুগের। কিন্তু মানুষের ভিতরে এখনো সুপ্ত অবস্থায় আদিম বন্যতা বিরাজ করছে। বাইরে থেকে একে চেনার উপায় না থাকলেও তা নিঃশেষ হয়ে যায় নি। সভ্যতার মুখোশ পরে মানুষ এখনো মানুষকে খুন করে, ভদ্রতার মুখোশ পরে এখনো গোপনে কামতৃষ্ণা চরিতার্থ করে। এখনো ধর্ষণ ও নারীহরণ আমাদের সমাজজীবনের অন্যতম ব্যাধি। ভিখু যা করেছে তা নতুন কিছু নয়। সভ্য মানুষ সংগোপনে এসব করে, আর ভিখু করেছে প্রকাশ্যে। এ গল্পে লেখক সভ্যতার অন্তঃসারশূন্যতাকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।
সভ্যতার নিরাভরণ নগ্নমূর্তি : ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পে গল্পকার সভ্যতার নিরাভরণ নগ্নমূর্তি তৈরিতে অভূতপূর্ব পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। ডিথুকে তিনি গ্রহণ করেছেন মূর্তি নির্মাণের উপকরণ হিসেবে। ভিখুর মধ্যকার নগ্নতা ডিখুর নিজস্ব সম্পদ নয়। এ সম্পদ সমাজ ও সভ্যতার। ভিখু এখানে অবলম্বন মাত্র। ভিখুর বেঁচে থাকার সংগ্রাম, কামনা চরিতার্থ করার উন্মাদনা, মানুষ খুন করার প্রবণতা মানুষের মধ্যকার সুপ্ত আদিমতার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মানুষের এসব সুপ্ত প্রবণতাসমূহের নগ্ন প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এ গল্পে ভিখুরা কেবল বসন্তপুরে বা চিতলপুরে বিচরণ করে না। মানবসভ্যতার উন্নত পাদপীঠেও এরা সংগোপনে বিরাজ করছে। মার্কসবাদী লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এ গল্পের নগ্নতা ও বন্যতাকে আমাদের সমাজজীবনের অবিচ্ছেদ্য উপকরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন। ভিখু বসিরকে হত্যা করেছে পাঁচীর লোভে, বৈকুণ্ঠ সাহার গদিতে ডাকাতি করেছে উপার্জনের প্রয়োজনে, পেহ্লাদের বৌয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছে কামলালসা চরিতার্থ করার মানসে। বর্তমান সভ্য সমাজের মানুষও হত্যা করছে, লুটপাট করছে, নারীহরণ করছে। ভিথু, পাঁচী ও বসিরের জীবনাচরণের ভিতর দিয়ে গল্পকার সভ্যতার নগ্নতাকে অনাবৃত করে দিয়েছেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ভিখুরা প্রাগৈতিহাসিক যুগে ছিল, এখনো আছে। গল্পকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এ গল্পে ভিখুর মধ্য দিয়ে সভ্যসমাজের সুপ্ত আদিমতাকে অনাবৃত করার প্রয়াস পেয়েছেন। ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের াহিনিতে সভ্যতার অন্তঃসারশূন্য দেউলে রূপটিই নিরাভরণ নগ্নমূর্তিতে চিত্রিত হয়েছে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%97%e0%a7%88%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%bf%e0%a6%95-%e0%a6%97%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%aa-%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%bf/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*