নারী অধিকার বলতে কী বুঝ? বাংলাদেশের সংবিধানে সন্নিবেশিত নারী অধিকারসমূহ আলোচনা কর ।
উত্তর৷ ভূমিকা : বাংলাদেশের সমাজে নারীরা যেভাবে প্রতিনিয়ত বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে তা দেখে সংবিধানের প্রকৃত চরিত্র বোঝার উপায় নেই। কেননা সংবিধানে নারী-পুরুষের সমঅধিকারের কথা বলা হয়েছে অথচ বাস্তব জীবনে এতে প্রতিফলন তেমনটা নেই।
নারীর অধিকার : অধিকার এর সাথে মর্যাদা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সমাজের নারী কী কী অধিকার ভোগ করে তার উপর সমাজের নারীর মর্যাদা নির্ভরশীল। সমাজে নারীর অধিকারগুলো সংবিধানে এবং আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে নারীর অধিকারগুলো দু’ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়। যথা :
১. সংবিধানে নারীর অধিকার এবং
২. আইনগত অধিকার।
সংবিধানে নারীর অধিকার : বাংলাদেশের সংবিধানে নারী অধিকার নিম্নরূপ
প্রস্তাবনা : সংবিধানে একটি প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, “আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।”
১০ নং অনুচ্ছেদ : অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
১৫ নং অনুচ্ছেদ : রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদন শক্তির ক্রমবৃদ্ধি সাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মনের দৃঢ় উন্নতিসাধন, যাতে নাগরিকের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা যায়।
ক. অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা।
খ. কর্মের অধিকার, অর্থাৎ কর্মের গুণে ও পরিমাণ বিবেচনা করে যুক্তিসংগত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার।
গ. যুক্তিসংগত বিশ্রাম, বিনোদনের ও অবকাশের অধিকার।
ঘ. সামাজিক নিরাপত্তা অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতা-পিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সাহায্য লাভের অধিকার ।
১৭ নং অনুচ্ছেদ : (ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইন দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
১৮ নং অনুচ্ছেদ : গণিকাবৃত্তি ও জুয়া খেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
১৯ নং অনুচ্ছেদ : (১) সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হবে। (২) মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করার জন্য প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধা দান নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
২৭ নং অনুচ্ছেদ : সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকার।
২৮ নং অনুচ্ছেদ : (১) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানভেদের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না।
(২) রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবে।
(৩) কেবল, ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোনো বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভর্তির বিষয়ে কোনো নাগরিকের কোন বিষয়ে অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাবে না।
(৪) নারী ও শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন
হতে এই শর্তের অধীন করা যাবে না।
২৯ নং অনুচ্ছেদ : ১. প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে।
২. কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের অযোগ্য হবে না কিংবা সেক্ষেত্রে তার প্রতি কোনরূপ বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না।
(ক) নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশ যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে তাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা হতে,
(খ) কোনো ধর্মীয় বা উপসম্প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে উক্ত ধর্মাবলম্বী বা উপসম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিয়োগ সহাবস্থানের বিধান সংবলিত যে কোনো আইন কার্যকর করা হতে,
(গ) যে শ্রেণির কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জন্য তা নারী বা পুরুষের পক্ষে অনুপযোগী বিবেচিত হয়, সেইরূপ কোনো শ্রেণির নিয়োগ বা পদ যথাক্রমে পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হতে।
৩১ নং অনুচ্ছেদ : আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইন অনুযায়ী ব্যবহার লাভ যে কোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো বক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তি হানি ঘটে।
৩১ নং অনুচ্ছেদ : আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না।
উপসংহার : নারীর মৌলিক অধিকারের ঘোষণা সংবিধানের উপরোক্ত বিধানাবলিতে সুস্পষ্ট। আবার অসম আইনগুলোকে বিধান অবৈধ ও বাতিল বলেও ঘোষণা করেছে স্পষ্টভাবেই। তবুও পরিবর্তন হয়নি আসল আইনগুলোর। ফলে নারী সমাজই ঈপ্সিত ভূমিকা রাখতে পারছে না সমাজে, সংসারে কোথাও।