নারীর অধস্তনতার সামাজিক কারণসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, নারীর অধস্তনতার সামাজিক কারণগুলো বর্ণনা কর।
অথবা, নারীর অধস্তনতার সামাজিক কারণগুলো লিখ।
অথবা, নারীর অধস্তনতার সামাজিক কারণসমূহ উল্লেখ কর।
অথবা, নারীর অধস্তনতার সামাজিক কারণসমূহ তুলে ধর।
অথবা, নারীর অধস্তনতার সামাজিক কারণ ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : মানব সমাজের অর্ধেক নারী এবং অর্ধেক পুরুষ। নারী ও পুরুষের পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সুন্দর বিশ্ব গড়ে উঠতে পারে। নারী ও পুরুষের সম্মিলিত চেষ্টায় গড়ে উঠেছে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও
বিশ্বসভ্যতা। বিশ্ব সংসারে নারী ও পুরুষের সমান অবদান থাকলেও নারী বঞ্চিত হচ্ছে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে। পুরুষ নারীর প্রভু। পুরুষ কর্তা, প্রভু এবং নারী অপর বা Object. পুরুষের অধীনে নারী থাকবে।
নারীকে মনে করা হয় পুরুষের সেবাদাসী। পুরুষের প্রয়োজনে নারীর সৃষ্টি। নারীর কাজ- পুরুষের সেবা করা এবং দাসীর মতো অনুগত থাকা। এঙ্গেলেসের মতে, সম্পত্তিতে ব্যক্তিমালিকানা ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে নারীদের উপর পুরুষের আধিপত্যের সূচনা। পুরুষদের যৌন স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকে কিন্তু সন্তানের সঠিক উত্তরাধিকার বজায় রাখার জন্য নারীদেরকে এক স্বামীতেই তৃপ্ত থাকতে হয়। অধিকন্তু সম্পত্তির মালিকানা ও উত্তরাধিকার পুরুষের অধিকারে আসায় তাদের প্রতিপত্তি বেড়ে যায়। এ সময় নারী-পুরুষের মধ্যে কঠোর শ্রম বিভক্তিরও প্রচলন হয়। এতে উপাদানের উপকরণের দখল চলে যায় পুরুষদের হাতে। উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে এক রকম বিচ্ছিন্ন করে শুধু সন্তান উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত করা হয়। ঙ্গেলস বলেন, মাতৃতান্ত্রিক সমাজের বিলুপ্তি জাতির সবচেয়ে ঐতিহাসিক পরাজয়। পুরুষরা গৃহস্থালির দখলও ছিনিয়ে নেয়। নারীর মর্যাদার হানি হয়। তারা পুরুষের কামনার দাস ও সন্তান
উৎপাদনের যন্ত্রে পরিণত হয়। পুরুষেরা নারীদেরকে তাদের অধীনস্থ করে এবং ধীরে ধীরে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সর্বময় ক্ষমতা দখল করে। এর ফলে তারা নিজেদের প্রয়োজন ও স্বার্থ অনুযায়ী নারীদের ব্যবহার করার সুযোগ পায় ।
নারীর অধস্তনতার সামাজিক কারণসমূহ : নিম্নে অধস্তনতার সামাজিক কারণসমূহ উল্লেখ করা হলো :
১. পুরুষতান্ত্রিক সমাজ : নারী যে সমাজে বসবাস করে এবং বেড়ে উঠে তা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষ প্রভু এবং নারী তার দাসী। নারীর কাজ পুরুষের সেবা করা। পুরুষতান্ত্রিক নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে মনে করা হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি আসে। কিন্তু বিয়ের পর নারীকে চিরচেনা আপন জায়গা।ছেড়ে স্বামীর ভিটেকে আঁকড়ে থাকতে হয়। বিয়ের পর নারী তার পিতামাতার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়। ইসলাম ধর্মে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার থাকলেও নারী তা ভোগ করতে পারে না। ফলে নারী স্বামীর প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
২. নৈতিবাচক সামাজিকীকরণ : নারী অধস্তনতার অন্যত্র কারণ নারীর নৈতিবাচক সামাজিকীকরণ। নারীর কোন সত্তা বিকাশের জন্য সামাজিকীকরণ হয় না। কন্যাশিশু মায়ের কাছ থেকে প্রথম তার সামাজিকীকরণ শুরু হয়। মায়ের মাধ্যমে সে জানতে পারে সে মেয়ে মানুষ। পুরুষ ছেলে থেকে সে আলাদা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার বিচরণ ক্ষেত্র সীমিত হয়ে পড়ে। নারী যতই শিক্ষিত ও উপার্জনকারী হোক না কেন স্বামীকে তোয়াজ করে চলতে হবে। এভাবে নারীর
সামাজিকীকরণের ফলে নারী পরনির্ভরশীলতা হয়ে পড়ে।
৩. বিবাহ : নারীর অধস্তনতার অন্যতম কারণ বিয়ে। পুরুষতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিয়ে নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ। নারী হিসেবে জন্ম নিলে তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতেই হবে। সব ধর্মে নারীর বিয়েকে অপরিহার্য বলে মনে করা হয়। বিয়ের মাধ্যমে নারী তার স্বাধীনতা হারায়। নারী তার স্বাধীনতা ফিরে পেতে চায় পুত্র সন্তান জন্মদানের মাধ্যমে ! কিন্তু নারীর এ আশা পূর্ণ হয় না। বিয়ের মালা পরিয়ে নারীকে পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ করা হয়।
৪. শিক্ষাক্ষেত্রে পশ্চাৎপদতা : নারীর অধস্তনতার অন্যতম কারণ শিক্ষা ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদতা। নারী শিক্ষাকে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করা হতো। বর্তমানে নারী শিক্ষার প্রসার ঘটেছে। উন্নয়নশীল দেশে নারী শিক্ষার হার বেড়েছে। শিক্ষিত মেয়েরা চাকরি করে পরিবারের হাল ধরবে এ আশা পরিবার করে না। মেয়ে শিক্ষিত বা অশিক্ষিত হোক বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে রান্নার হাড়ি টানতে হয়। অনেক শিক্ষিত মেয়ে বিয়ের পর স্বামী ও সন্তানের জন্য চাকরি করে না। স্বামীর আদেশ নির্দেশ ও স্বামীর সংসারকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, আমাদের সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর যে অবস্থান তা অত্যন্ত দুঃখজনক। দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। এই অর্ধেক অংশ নানা সমস্যায় জড়িত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ধর্মীয় গোঁড়ামি, সামাজিক কুসংস্কার, নিপীড়ন ও বৈষম্যের বেড়াজালে নারীদের সর্বদা অবদমিত করে রাখা হয়েছে। তাদের মেধা ও শ্রমকে দেশ গঠনের কাজে সম্পৃক্ত করা হয়নি। তাই দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে নারীর সামাজিক বৈষম্য দূর করে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।