উত্তর : বাংলা সাহিত্যের সব্যসাচী লেখক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধটি রচনা করেন ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে নিজের আশিতম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠান উপলক্ষে। জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্তঃসারশূন্যতাকে তিনি দিব্যদৃষ্টিতে অবলোকন করে তার তীব্র সমালোচনা করেছেন এ নিবন্ধে। কৈশোর ও যৌবনে যে সভ্যতার মোহ তাঁকে আচ্ছন্ন করেছিল বার্ধক্যে এসে তার মুখ ও মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে একান্ত নগ্নভাবে। কবি সে উপলব্ধিজাত মূল্যায়ন ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করেছেন। ‘সিভিলিজেশন’ যাকে আমরা বাংলায় ‘সভ্যতা’ নাম দিয়ে তর্জমা করেছি তার যথার্থ প্রতিশব্দ আমাদের ভাষায় পাওয়া যায় না। এ সভ্যতার যে রূপ আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল বিখ্যাত প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক মনু তাকে বলেছেন ‘সদাচার’। তাঁর মতে, সভ্যতা বা সদাচার কতকগুলো সামাজিক নিয়মের বন্ধন। সরস্বতী ও দৃশদ্বতী নদীর মধ্যবর্তী যে দেশ ‘ব্রহ্মাবত’ নামে বিখ্যাত ছিল, সে দেশে যে আচার-আচরণ পারস্পর্যক্রমে চলে এসেছে তাকেই বলা হয় সদাচার। ইংরেজরা এদেশে আসার পর তাদের বহুমাত্রিক সভ্যতার সংস্পর্শ লাভ করে ভারতীয় সদাচার আধুনিক সভ্যতা হিসেবে পরিগণিত হয়। আধুনিক সভ্যতা ইউরোপীয় সংস্কৃতির অবদান ছাড়া কিছুই নয়। রবীন্দ্রনাথ শৈশব থেকে এ সভ্যতার আলোকে নিজেকে পরিচালিত ও পরিশুদ্ধ করে এসেছেন। কিন্তু শেষ জীবনে এসে তিনি সভ্যতাকে দেখেছেন সংকটের আবর্তে হাবুডুবু খেতে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর যৌবনে মানবমৈত্রীর বিশুদ্ধ পরিচয় দেখেছিলেন ইংরেজ চরিত্রে তথা পাশ্চাত্য সভ্যতায়। তাই আন্তরিক শ্রদ্ধা নিয়ে তিনি ইংরেজকে হৃদয়ের উচ্চাসনে বসিয়েছিলেন। তখনও সাম্রাজ্য মদমত্ততায় তাদের স্বভাবের দাক্ষিণ্য কলুষিত হয়নি। জীবনের দ্বিতীয় ভাগে এসে তিনি দেখতে পেলেন- সভ্যতাকে যারা চরিত্র-উৎস থেকে উৎসারিত রূপে স্বীকার করেছিল রিপুর তাড়নায় তারা তাকে অনায়াসে লঙ্ঘন করে গেল। ফলে মানবমৈত্রীর বাণী হলো ভূলুণ্ঠিত এবং সভ্যতা হয়ে পড়ল সংকটাকীর্ণ। রবীন্দ্রচিত্তে এভাবেই সভ্যতার সংকট পরিদৃষ্ট হয়েছিল। পাশ্চাত্য সভ্যতার মূলে ছিল মানবমৈত্রীর বিশুদ্ধ পরিচয়। তখনকার দিনরাত্রি মুখরিত ছিল বার্কের বাগ্মিতায়, মেকলের ভাষা প্রবাহের তরঙ্গভঙ্গে, শেক্সপিয়ার ও বায়রনের সাহিত্যচর্চার উৎকর্ষতায় এবং এভুজ প্রমুখের মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে। ইংরেজের মহত্ত্বকে এরা সকল প্রকার নৌকাডুবির হাত থেকে উদ্ধার করার ক্ষমতা রাখতেন। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী লোলুপতার কারণে ইংরেজসভ্যতা তার মূল সুর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। ফলে পাশ্চাত্য সভ্যতা তার নিজস্ব মানবতাবাদী বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলল। রাজনৈতিক শাসন শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হলো সভ্যতার উদার মহত্ত্ব। ফলে পাশ্চাত্য সভ্যতার মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ মানবমৈত্রী থেকে দূরে সরে গেল। যে যন্ত্র সভ্যতার জোরে ইংরেজ জাতি নিজের কর্তৃত্ব সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল, তারা সে যন্ত্রশক্তির যথোচিত ব্যবহার থেকে তাদের অধিকৃত ভারতবর্ষকে বঞ্চিত করল। অথচ চোখের সামনে জাপান ও চীন যন্ত্রশক্তি ব্যবহার করে নিজেকে সমৃদ্ধ করল। ইংরেজ ভারতবাসীকে পদানত করে রাখার জন্য Law and order’ সৃষ্টি করে তার যথার্থ প্রয়োগ নিশ্চিত করল। এর ফলে ভারতীয়রা কেবল অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসা থেকেই বঞ্চিত হলো না তাদের মধ্যে জন্ম নিল নৃশংস আত্মবিচ্ছেদ। ইংরেজের কূটকৌশলে ভারতীয় জাতিসত্তা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল। লুপ্ত হয়ে গেল দীর্ঘকালের লালিত সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি। যে মানবমৈত্রীর বিশুদ্ধতার পরিচয় নিয়ে সভ্যতার জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল ক্ষমতার মদমত্ততায় তাকে ইংরেজরা মানবপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত করল। এক সময় দেখা গেল সমস্ত ইউরোপে তাদের বর্বরতা নখদন্ত বিস্তার করে বিভীষিকার সৃষ্টি করেছে। এ মানবপীড়নের মহামারি পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভিতর থেকে জাগ্রত হয়ে উঠে আজ মানবাত্মার অপমানে দিগন্ত থেকে দিগন্ত কলুষিত করে দিয়েছে। পাশ্চাত্য সভ্যতার এ নগ্নরূপটির চিত্র রবীন্দ্রনাথের কল্পনার বাইরে ছিল। যখন তিনি এর মুখোমুখি হলেন তখন তিনি চরম হতাশ হয়ে বলে উঠলেন, “জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম ইউরোপের অন্তরের সম্পদ এ সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল।” জীবন নদীর শেষ সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে সভ্যতার সংকট সম্পর্কে যে হতাশার প্রকাশ ঘটেছে তেমনি সংকট থেকে উত্তরণের আশাবাদও ধ্বনিত হয়েছে তাঁর কণ্ঠ থেকে। তিনি বলেছেন, “আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎত্মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। এই কথা আজ বলে যাব, প্রবল প্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে।” সুদীর্ঘ জীবনপ্রবাহের শেষপর্বে এসে রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন, শৈশব থেকে ইংরেজ সভ্যতা, সংস্কৃতি ও দর্শনের মধ্যে তিনি মানবতার যে মহত্ত্ব প্রত্যক্ষ করেছেন ক্ষমতা ও সাম্রাজ্যবাদী মনোবৃত্তির কারণে ইংরেজ তাঁকে কলুষিত করেছে। এ বিশ্বাস ভঙ্গের বেদনা থেকে তিনি আবার নতুন করে আশান্বিত হয়েছেন যে, প্রবল প্রতাপশালীরও ক্ষমতার মদমত্ততা ও আত্মম্ভরিতা নিষ্ফল প্রমাণিত হবার দিন ঘনিয়ে এসেছে।
এই কথা আজ বলে যাব, প্রবল প্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে”- উক্তিটির আলোকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধের মূলবক্তব্য লিপিবদ্ধ কর।
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079
Leave a Reply