আবুল মনসুর আহমদ রচিত ‘হুযুর কেবলা’ গল্পের মূলবক্তব্য তোমার নিজের ভাষায় লিখ।
অথবা, প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ রচিত “হুযুর কেবলা” গল্পে ধর্মব্যবসায়ী ভণ্ডপীরদের নীচতার যে নিখুঁত চিত্র অঙ্কন করেছেন তা বর্ণনা কর।
উত্তর : প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদের ‘হুযুর কেবলা’ একটি সমাজ সংস্কারমূলক ব্যঙ্গাত্মক ছোটগল্প। সমাজের ধর্মীয় অন্ধত্ব ও গোঁড়ামিকে কঠোরভাবে আঘাত করা হয়েছে এই গল্পে। তথাকথিত পীর প্রথার পাদমূলে কুঠারাঘাত করে। ধর্মব্যবসায়ীদের মুখোশ উন্মোচন করা হয়েছে এই গল্পের কাহিনিতে। মুসলমান সমাজে প্রচলিত পীরালির অন্তরালে যে কদর্যতা ও লোলুপতা বিরাজ করে গল্পকার তা পাঠককে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। ভণ্ডপীরের ভণ্ডামির ছবি অঙ্কন করে সমাজ থেকে এদের প্রভাব প্রতিপত্তি নির্মূল করাই ছিল গল্পকারের উদ্দেশ্য। এদিক থেকে আবুল মনসুর আহমদ সার্থক। তিনি সমাজের এই
কুণ্ঠব্যাধিকে যথাযথভাবে আক্রমণ করতে সক্ষম হয়েছেন। একে প্রতিরোধ ও প্রতিহত করার দায়িত্ব সচেতন মুসলমানদের। সহজ সরল গ্রামবাসীদের সারল্যকে পুঁজি করে পীর প্রথার প্রচলন হয়েছে মুসলমান সমাজে। আমাদের দেশের মুসলমানেরা ধর্মপ্রাণ ও ধর্মভীরু। ধর্মের অজুহাতে তারা যে কোন কাজ করতে দ্বিধা করে না। আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষার অভাবে তাদের মধ্যে অন্ধত্ব ও কুসংস্কার বাসা বেঁধে বসেছে। যে কোন বুজরুকি দেখিয়ে এসব মানুষকে সহজে বশীভূত করা যায়। এই শ্রেণির মানুষ যুক্তিতর্কের ধার ধারে না। এরা আল্লাহকে ভয় পায়, রাসূলকে মান্য করে। তাই আল্লাহর দোহাই দিয়ে রাসূলের ওছিলায় এদেরকে যা বুঝানো হয়, এরা তাই সরলভাবে বিশ্বাস করে। এ সকল মানুষ নিজেরা কম জানে বলে যে কোন তথাকথিত জানেওয়ালাকে ফেরেশতা বলে মেনে নেয়। যুক্তির চেয়ে আবেগ এদের কাছে বড়। এ সকল মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে পীর-মাশায়েকরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে মত্ত হন। পীরেরা যা বলেন মুরিদেরা তা-ই অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। নিঃশর্ত ভক্তির অর্ঘ্য নিয়ে এরা পীর বন্দনায় মেতে উঠে। হুযুর কেবলা’ গল্পে সমাজের কুসংস্কার ও অন্ধত্বকে মূলধন করে এক তথাকথিত কামেল পীর নিজের স্বার্থ হাসিল করেছেন। গল্পকার এ গল্পে চমৎকারভাবে এই ভণ্ডপীরের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। গল্পে বর্ণিত পীর সাহেব বয়সে বৃদ্ধ। বর্ণনা মতে তাঁর তিন স্ত্রী বর্তমান। তিনি তাঁর মুরিদদের বুজরুকির মাধ্যমে মোহাবিষ্ট করে রাখেন। সহজ সরল মুরিদেরা হুযুর যা বলেন তা-ই অকপটে বিশ্বাস করে। পীর সাহেব ছিলেন নারীদের প্রতি দুর্বল। মুরিদানে গিয়ে তিনি পুরুষদের মজলিশের চেয়ে মেয়েদের ওয়াজের আসর বেশি পছন্দ করতেন। মেয়েদের মজলিশে বসে ওয়াজ করতে করতে প্রায়ই তাঁর জয়বা আসত। এটা ছিল পীর সাহেবের ফাজলামি। এ সময় মুরিদেরা তাঁর হাত-পা টিপে দিলে তিনি সুস্থ হতেন। মেয়ে মহলে ওয়াজের সময় পীর সাহেবের নজর পড়ে বাড়িওয়ালার পুত্র রজবের সুন্দরী স্ত্রী কলিমনের উপর। পীরসাহেব স্থির করলেন কলিমনকে নিজের জন্য হালাল করবেন। এ কু-ইচ্ছা চরিতার্থ
করার জন্য তিনি তাঁর দুই খলিফার সাথে গোপনে পরামর্শ করে এক ‘মোরাকেবা’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সুফি সাহেবের অচেতন (?) দেহে রাসূলের আত্মাকে আনার কথা বলে তাঁকে দিয়ে কলিমনকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলেন। উপস্থিত কেউ-ই এ ঘটনাকে অবিশ্বাস করল না। কেবল এমদাদের মনে ঘোরতর সন্দেহ দেখা দিল। পীর সাহেবের পাতানো খেলায় বাজিমাৎ হয়ে গেল। রজব তার স্ত্রীকে তালাক দিতে বাধ্য হলো। সকলের সহযোগিতা ও সমর্থনে কলিমনের সাথে পীর সাহেবের বিয়ে হয়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল মুছতে মুছতে রজব গ্রাম ছেড়ে চলে গেল। খেলাফত ও স্বদেশী আন্দোলনে হতাশাগ্রস্ত এমদাদ পীর সাহেবের কাছে এসেছিল ‘রুহের তরক্কী হাসেল করতে। পীর সাহেব ও তাঁর শাকরেদদের ভণ্ডামি ও প্রতারণা প্রত্যক্ষ করে এমদাদ এর প্রতিবাদ করল। সে সরাসরি পীর সাহেবকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করল। পীর সাহেব তাকে পাগল বলে আখ্যায়িত করলে গ্রামবাসীরা এমদাদকে মারতে মারতে গ্রাম থেকে বের করে দিল। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ ‘হুযুর কেবলা’ গল্পে ধর্মব্যবসায়ী ভণ্ডপীরদের নীচতার নিখুঁত চিত্র অঙ্কন করেছেন। এই শ্রেণির মানুষ স্বীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য কত নিচে নামতে পারে তা এ গল্পের কেবলা হুযুরের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রতিভাত হয়েছে। সৃষ্টির প্রারম্ভিককাল থেকে যে ধর্মের ব্যবসায় শুরু হয়েছে এর শেষ কোথায় তা আমাদের জানা নেই। তবে এর পরিণাম যে ভালো নয় তা বুঝার দিন এসেছে। ধর্ম নিয়ে যারা ব্যবসায় করে তারা মানুষ নামের কলঙ্ক। মানুষের ধর্মভীরুতাকে মূলধন করে যে জঘন্য কাজে এরা লিপ্ত হয় তা মানবতাবিরোধী। আমাদের দায়িত্ব এমদাদের মতো সাহসী হয়ে এসব ভণ্ড প্রতারকদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করা। ধর্মান্ধ মানুষকে সচেতন করে তুলে এসব পীরদের প্রতিরোধ ও প্রতিহত করতে না পারলে ধর্মের বেসাতির অবসান হবে না। যদি সমাজ জেগে উঠে, মানুষ যদি সচেতন হয় তবে এসব পরজীবী ভণ্ড প্রতারকেরা আল্লাহ রাসূলের নাম ভাঙিয়ে নিজেদের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার সুযোগ পাবে না। এরা চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে পৃথিবী থেকে।