Answer

হুযুর কেবলা’ গল্পের পীর সাহেব চরিত্রটি বিশ্লষণ কর।

অথবা, “‘হুযুর কেবলা’ গল্পের পীর সাহেব ভণ্ডামি ও প্রতারণার এক জ্বলন্ত প্রতিমূর্তি।”- উক্তিটির আলোকে পীর চরিত্র বিশ্লেষণ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
প্রখ্যাত সাহিত্যিক রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ বিরচিত ‘হুযুর কেবলা’ একটি ব্যঙ্গাত্মক ছোটগল্প। গল্পটি লেখকের ‘আয়না’ গল্পগ্রন্থের অন্তর্গত। এ ব্যঙ্গাত্মক গল্পে লেখক বাঙালি সমাজের অভ্যন্তরে যে গোঁড়ামি, অন্ধত্ব, কুসংস্কার ও ভণ্ডামি বাসা বেঁধে আছে তীব্র ভাষায় তার মুখোশ উন্মোচন করেছেন। গল্পের মুখ্যচরিত্র এক তথাকথিত ভণ্ড পীর এবং জ্বলন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। নিম্নে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো। এক প্রতিবাদী যুবক এমদাদকে আশ্রয় করে গল্পকার গল্পের কাহিনি নির্মাণ করেছেন। এর কাহিনিতে পীর সাহেবের ভণ্ডামির চিত্র
কে এই পীর সাহেব : ‘হুযুর কেবলা’ গল্পের পীর সাহেবের বিস্তারিত নাম পরিচয় লেখক নির্দিষ্টভাবে তুলে ধরেননি। বৈঠকখানাটি একটা প্রকাণ্ড খড়ের তৈরি আটচালা ঘর। বৈঠকখানার মাঝখানে দেওয়াল ঘেঁষে অপেক্ষাকৃত উঁচু আসনে বসে হুম্বর বর্ণনা মতে জানা যায় তাঁর ছিল একতলা পাকাবাড়ি। বাড়িটি বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। অন্দরমহলের সব ক’খানা ঘরই পাকা। তাঁর কেবলা আলবোলায় তামাক টানেন। তিনি বয়সে প্রবীণ। তাঁর মুখভর্তি মেহেদি রঞ্জিত দাড়ি। ঘরের মেঝেতে মুরিদেরা হুযুরের সামনে হাঁটু ভেঙে বসে তাঁর কথা শোনে। মুরিদদের কাছে তিনি কামেল পীর হিসেবে বিবেচ্য।
প্রতারক পীর সাহেব : ‘হুযুর কেবলা’ গল্পের পীর সাহেব একজন প্রতারক মানুষ। নিজের স্বার্থ উদ্ধারের ব্যাপারে তিনি যে কোন ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিতে কুণ্ঠিত হতেন না। তাঁর কয়েকজন বিশ্বস্ত মুরিদ ছিল, যারা তাঁর সব ধরনের প্রতারণার কাজে অন্ধভাবে সহযোগিতা করতো। পীর সাহেব প্রতারণামূলক কেরামতি প্রদর্শন করে গ্রামের অজ্ঞ মুরিদদেরকে তাক লাগিয়ে তাদের ভক্তিশ্রদ্ধা আদায় করতেন। এমদাদের আগমন সম্পর্কে সুফি সাহেবের কাছ থেকে পূর্বেই অবহিত হয়ে পীরসাহেব মজলিসে উপস্থিত মুরিদদের সামনে এমনভাবে তা প্রকাশ করলেন যেন আধ্যাত্মিক শক্তিবলে তিনি এমদাদ সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। এটি তাঁর
প্রতারণার একটা নমুনা।
ভোজনরসিক পীর সাহেব : হুযুর কেবলা ছিলেন একজন ভোজনরসিক মানুষ। নানান ধরনের খাবার খেতে তিনি পছন্দ করতেন। দূরবর্তী স্থানে মুরিদানে যাওয়ার সময় পথের খাদ্যের প্রয়োজনে তাঁর বজরায় এক মণ ঘি, আড়াই মণ তেল, দশ মণ সরু চাল, তিন শত মুরগি, সাত সের অম্বুরি তামাকসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য তোলা হয়েছিল। মুরিদানে পৌছানোর পর বিভিন্ন মুরিদের বাড়িতে পীর সাহেবের উদ্দেশ্যে বিশাল বিশাল ভোজের আয়োজন হলো। সফরসঙ্গী এমদাদ পীর সাহেবের খাওয়ার নমুনা দেখে বুঝতে পারল পীর সাহেবের রুহানি শক্তি যত বেশিই থাকুক না কেন, তাঁর হজমশক্তি নিশ্চয়ই তার চেয়ে অনেক বেশি। তিনি এভাবেই তাঁর রসনাকে চরিতার্থ করতেন।
পীর সাহেবের নারী আসক্তি : পীর সাহেব ছিলেন এক নারী লোভী ভণ্ড শয়তান । মহিলা মুরিদদের প্রতি তাঁর ছিল মাত্রাতিরিক্ত নেকনজর। মেয়েদের ধর্মকথা বুঝাতে তিনি বেশি রকম আগ্রহী ছিলেন। তাই পুরুষদের মজলিসের চেয়ে তিনি মহিলাদের ওয়াজে বেশি সময় কাটাতেন। মুরিদের পুত্রবধূ (রজবের স্ত্রী) কলিমন ছিল অপূর্ব সুন্দরী। পীর সাহেব কলিমনকে বিয়ে করার লক্ষ্যে এক চতুর পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি কৌশলে মোরাকাবা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সেখান থেকে তাঁর জন্য কলিমনকে হালাল করে নেন। এ ক্ষেত্রে তিনি মহানবীর আত্মার সাথে তামাশা করতেও দ্বিধা করেননি। বিবেক, বুদ্ধি, মানবতা সমস্ত কিছুকে বিসর্জন দিয়ে পীর সাহেব তাঁর নারী লোলুপতাকে চরিতার্থ করেছেন। কলিমনের আর্তনাদ রজবের বুকফাটা কান্না কোন কিছুকেই তিনি পরোয়া করেননি। নিজের কামবাসনা চরিতার্থ করতে তিনি ধর্ম, রাসূল, কেতাব প্রভৃতিকে ব্যবহার করেছেন। তাঁর এ নারী আসক্তি তাঁকে বিবেকবর্জিত অমানুষে পরিণত করেছিল।
ভণ্ড পীর সাহেব : পীর সাহেব ছিলেন একজন ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ী। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তিনি এমন কোন ভণ্ডামি নেই যা করতে পারতেন না। কয়েকজন বিশ্বস্ত সহযোগীর মাধ্যমে তিনি মানুষের সাথে প্রতারণা চালাতেন। সাধারণ ধর্মভীরু মানুষের সরল বিশ্বাসকে পুঁজি করে তিনি আল্লাহ-রাসূলের নাম ভাঙিয়ে নিজের কেরামতি প্রদর্শন করতেন। এক্ষেত্রে তাঁর মধ্যে কোন পাপবোধ কাজ করেনি। আরবি ফারসি আয়াত আউড়িয়ে তিনি মানুষকে বিভ্রান্ত করে বশীভূত করে ফেলতেন। কেউ তাঁর ভণ্ডামির বিরুদ্ধে ‘টু’ শব্দটি করতে সাহস পেত না। তাঁর বাকচাতুর্যের কাছে সাধারণ মানুষ মোহাবিষ্ট হয়ে আত্মসমর্পণ করতো।
চতুর পীর সাহেব : পীর সাহেব ছিলেন অত্যন্ত চালাক ও চতুর লোক। শিয়ালের ধূর্ততাকে তিনি হার মানাতেন। রজবের স্ত্রী কলিমনকে বিয়ে করার জন্য তিনি চাতুর্যের আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁর দুই খলিফার সাথে গোপন পরামর্শ করে পীর সাহেব যে মোরাকেবা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন এমদাদ ছাড়া অন্য কেউ তা বুঝতে পারেনি। স্বীয় কামলোলুপতা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে তাঁর এ সর্বোচ্চ চাতুর্য জয়যুক্ত হয়েছিল। মুরিদদের ঠকিয়ে পীর সাহেব কলিমনকে বিয়ে করতে সক্ষম হয়েছিলেন। চতুর পীর সাহেব এভাবেই অপকৌশল প্রয়োগ করেনিজের কামনা-বাসনা পূর্ণ করতেন।
লম্পট পীর সাহেব : বয়সে বৃদ্ধ হলেও পীর সাহেব ছিলেন এক চরিত্রহীন লম্পট। নারীদেহের প্রতি তাঁর আসক্তি ছিল প্রবল। তাঁর দুর্দমনীয় লাম্পট্যের শিকার হয়েছিল রজব-কলিমন দম্পতি। এ নব দম্পতির সুখের জীবনটাকে পীর সাহেব তাঁর লাম্পট্যের আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ করেছেন। লাম্পট্যের কাছে তাঁর বিবেক বুদ্ধি বিসর্জিত হয়েছে। মুরিদদের আস্থা বিশ্বাসকে মূলধন করে তিনি তাঁর কু-ইচ্ছা চরিতার্থ করেছেন। লম্পট এ মানুষটি নিজের কামনা-বাসনা পূর্ণ করতে ধর্ম, আল্লাহ, রাসূল ও কেতাবকে ব্যবহার করেছেন। চরিত্রহীন মানুষ হওয়ার কারণে তিনি বিবেক বিবেচনার ধার ধারেননি।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, দুশ্চরিত্র, লম্পট, ভণ্ড, প্রতারক, মোনাফেক এমন কোন বিশ্লেষণ নেই যা ‘হুযুর কেবলা’ গল্পের পীর সাহেবের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় না। মানুষ নামের এ পশুটি ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষের বিশ্বাসের সাথে প্রতারণা করেছেন। এ কারণে তিনি মানুষ নামের কলঙ্ক। তাঁকে আমরা সবাই ঘৃণা করি।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!