সুফি তরিকা কাকে বলে? প্রধান প্রধান সুফি তরিকাসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, সুফি তরিকা বলতে কী বুঝায়? প্রধান প্রধান সুফি তরিকাসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, সুফি তরিকা কী? প্রধান প্রধান সুফি তরিকাসমূহ সম্পর্কে যা জান লেখ।
অথবা, সুফি তরিকার পরিচয় দাও। সুফি তরিকাসমূহ কী কী তা আলোচনা কর।
অথবা, সুফি তরিকা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা : সুফিবাদ আল্লাহর প্রেম ও ধ্যান ভিত্তিক একটি অভিনব চিন্তাধারা। মানুষ পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বাহ্যিক জগতের অন্তরালে এক পরম সত্তাকে জানতে চায়। পরম সত্তাকে জানার এ প্রয়াসকে দর্শনের ইতিহাসে মরমিবাদ বলা হয়। মুসলিম দর্শনে এ মরমিবাদই সুফিবাদ নামে পরিচিত। সুফিবাদের মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করা। সুতরাং কুরআন ও হাদিসের জাহেরি ও বাতেনি শিক্ষাই সুফি তরিকার মূলভিত্তি।
সুফি তরিকা : সুফি তরিকার অর্থ পথ বা রাস্তা। অনেকে একে সিলসিলাও বলেন। মূলত সুফি তরিকা বলতে বুঝায় Chain linkage বা শৃঙ্খল প্রভৃতি। যার মাধ্যমে একজন সুফি তার যে পরম উদ্দেশ্য আল্লাহময় হয়ে যায় তা অর্জন করেন।
প্রধান প্রধান সুফি তরিকাসমূহ : সুফি তরিকা অসংখ্য। এগুলোর মধ্যে কিছু খুবই প্রাচীন, কিছু তরিকার অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে আবার কিছু তরিকা অন্যের সাথে মিশে গেছে। প্রায় ২০০ বা ৩০০ তরিকার মধ্যে ৪টি তরিকা প্রধান। যথা :
১. চিশতীয়া তরিকা;
২. কাদেরিয়া তরিকা;
৩. নকশেবন্দিয়া তরিকা;
৪. মুজাদ্দেদীয়া তরিকা।
১. চিশতীয়া তরিকা : হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (র) এর নামানুসারে এ তরিকার নাম চিশতীয়া তরিকা। Lord Korjon খাজা সাহেব সম্পর্কে বলেছেন, “The man who is rulling India from geave”. খাজা সাহেব ৫৩৬ হিজরিতে ইরানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মজুম ফকিরের ফল ভক্ষণ করে নিজের মধ্যে এক দারুণ বিপ্লব অনুভব করেন। নিজেকে আল্লাহর রাস্তায় কুরবান করার নিয়ত করেন। তিনি কুরআন, হাদিস, তফসির, ফিকাহসহ মরমি জ্ঞান লাভ করেন। অবশেষে ইসলাম প্রচারে এ উপমহাদেশে আসেন। ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ।
তালিম : খামসা আনাসিরের তালিম এ তরিকার খাস তালিম রাসূল (স) এর শিক্ষানুসারে এ তালিম হযরত আলী (রা) এর মাধ্যমে হাসান বসরী (রা) লাভ করেন এবং সিনায় সিনায় এ তালিম হযরত ওসমান হারুণী (রা) পর্যন্ত চলে আসে। হযরত মঈনুদ্দীন চিশতী এ তালিম লিপিবদ্ধ করেন। আব (পানি), আতম (আগুন), খাক (মাটি), বাত (বাতাস) ও নূর বা সাফাকে খামসা আনাসির বলে। সমস্ত জগতের মূল হলো খামসা আনাসির। কালেমা তৈয়েবা এ তরিকা মাস তালিম। এ তরিকা প্রধানত ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, চীন, আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের কতিপয় দেশে বিস্তার লাভ করে।
২. কাদেরিয়া তরিকা : হযরত আব্দুল কাদের জিলানী এ তরিকার প্রতিষ্ঠাতা। বাংলাদেশে তিনি বড় পীর হিসেবে পরিচিত। ৪৭০ হিজরিতে পারস্যের জিলান প্রদেশে তাঁর জন্ম। তিনি হাম্বলী মাযহাবের একজন সুবিখ্যাত অধ্যাপক ছিলেন। ১১৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন।
তালিম : ১২ হরফের কালেমা তৈয়েবা কাদেরিয়া তরিকার খাস তালিম। এর মধ্যে লুকায়িত রয়েছে জগতের মূল রহস্য ও উৎস। তাওহিদের প্রকৃত রূপ এ কালেমা। এ কালেমায় নোকতা নেই। নোকতা শূন্য হরফের সাহায্যে কালেমার সৃষ্টি গভীর রহস্য দিকে নির্দেশ করে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ছাড়াও বিশেষ নিয়মের দরূদ পাঠ করতে হবে। এ তরিকার বিশেষত্ব হলো কালেমা পাঠের সময় লা ইলাহা বলে শ্বাস গ্রহণ ও ইল্লাল্লাহা বলে শ্বাসত্যাগের মধ্যে জিকির করা। এ তরিকার জুনায়েদিয়া শাখা ‘সামা’ শ্রবণে পক্ষপাতি। এ তরিকা ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, চীন,
ইন্দোনেশিয়া, মরক্কো ও মিশর প্রভৃতি দেশে বিদ্যমান।
৩. নকশেবন্দিয়া তরিকা : হযরত শায়খ খাজা বাহাউদ্দিন মোঃ নকশেবন্দ আল বোখারী (র) এ তরিকার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি এ তরিকার ইমাম ও শ্রেষ্ঠ কুতুব। এ তরিকা শরিয়ত ও তরিকত উপায়ের উপর সমান গুরুত্বারোপ করে। তিনি ৭০৮ মতান্তরে ৭১৮ হিজরিতে মধ্য এশিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিভিন্ন নকশা খচিত কাপড় বয়ন করতেন। তিনি সুফি হওয়ার পর যে দিকেই তাকাতেন সে দিকেই আল্লাহ নামের নকশা অঙ্কিত হয়ে যেত। এজন্য তিনি নকশেবন্দিয়া হিসেবে পরিচিত। ৭৯২ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।
তালিম : এ তরিকার প্রধান তালিম হচ্ছে লাতাফায়ে সিত্তা ও আরবায়ে আনাসির এর ভিন্ন ভিন্ন মোরাকাবা,নকশেবন্দিয়া এ তালিমকে সুসংবদ্ধ ও সুশৃঙ্খলিত করেন। এ তরিকা শরিয়তের উপর জোর দেয়। খফি বা নিম্নস্তরে জিকিরের কথা বলে। তবে এ তরিকার কোন কোন শাখা গযল ও সামা শ্রবণের পক্ষপাতি। তারা উচ্চস্তরে জলী বা উচ্চস্তরে জিকিরও করে থাকে। এ তরিকার শাখাপ্রশাখা তুরস্ক,পাকিস্তান, বাংলাদেশ, জাভা, ভারত ও চীন প্রভৃতি দেশে বিস্তৃত।
৪. মুজাদ্দেদিয়া তরিকা : হযরত শায়খ আহমদ ফারুকী সিরহিন্দি মুজাদ্দেদ-ই-আলফ-ই-সানী কর্তৃক এ তরিকা প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের সিরহিন্দি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। মূলত মুজাদ্দেদীয়া তরিকার শাখা এ তরিকা। তিনি একে সংস্কার ও সুসংবদ্ধ করেন। ১৬২৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন।
তালিম : নকশেবন্দিয়া তরিকার মতো মুজাদ্দেদিয়া তরিকার মূল তালিম হচ্ছে লাতাফয়ে সিত্তা ও আবরা আনাসির এর মোরাকাবা। তিনি হায়রাতুল খামসাকে নতুনভাবে সুসংবদ্ধ করেন। তিনি আদি চিশতিয়া, কাদেরিয়া ও নকশেবন্দিয়া তরিকাকে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধন করেন। তিনি তাঁর তরিকায় জিকিরে জলীকে স্থান দিলেও জিকিরে খফীকে বেশি গুরুত্ব দেন। তিনি সর্বপ্রকার সংগীত বা সামাকে নিষিদ্ধ করেন। এ তরিকা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, বার্মা ও আফগানিস্তানসহ নানাদেশে ছড়িয়ে আছে বা সামাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, উপর্যুক্ত চারটি প্রধান ও বিশিষ্ট তরিকাসহ পৃথিবীতে প্রায় তিনশত তরিকার আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু চারটি প্রধান তরিকা ব্যতীত বাকি তরিকাগুলো কালের অতলগর্ভে নিমজ্জিত হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। হারিয়ে যাওয়া ঐসব তরিকা এক সময়ে পৃথিবীতে বিশেষ তরিকা হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। সুতরাং মহান আল্লাহর দিদার লাভ করতে হলে এসব সুফি তরিকার মাধ্যমেই তা জানতে হবে।