সুফিবাদ কী? সুফিবাদ ও রক্ষণশীল ইসলামের মধ্যে পার্থক্য লেখ।

অথবা, সুফিবাদ ও রক্ষণশীল ইসলামের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা কর।
অথবা, সুফিবাদ ও রক্ষণশীল ইসলামের মধ্যে কী কী বৈসাদৃশ্য রয়েছে? আলোচনা কর।
অথবা, সুফি আদর্শ ও গোঁড়া ইসলাম পন্থিদের মধ্যকার পার্থক্য তুলে ধর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
মানুষের চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা হলো তার আত্মাকে জানার। মানুষ তার একান্ত আত্মা দিয়ে তার প্রিয়জনকে খুঁজে বের করে তার সাথে নিজ আত্মার নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করে। আর এ যোগসূত্র স্থাপন করার যে প্রয়াস ইসলামে সেটাই সুফিবাদ হিসেবে পরিচিত। সুফিবাদ হলো আল্লাহর প্রেম ও ধ্যানের উপর প্রতিষ্ঠিত এক ধরনের চিন্তাধারা। আর এ চিন্তাধারা সম্পন্ন মানসিক অবস্থা কখনো কখনো সেসব ব্যক্তির মধ্যে লক্ষ্য করা যায়, যারা জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে নৈরাশ্যবাদ, নিষ্ক্রয়তা ও বৈরাগ্যের দিকে অগ্রসর হয়।
সুফিবাদ : সুফিবাদ এক প্রকার আধ্যাত্মিক মতবাদ। সুফি ভাবধারার মূল লক্ষ্য হলো আল্লাহর গূঢ় অনুভূতির অন্বেষণ ও আত্মার পবিত্রতা বিধান। মানবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন সাধন। সুফি সাধকেরা অন্তরের গভীর অনুভূতির দ্বারা আল্লাহর সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে চান। তাঁদের মতে, ন্যায়-নীতি, ভয়-ভীতি অপেক্ষা আন্তরিক ভালোবাসার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। সুফিরা অতীন্দ্রিয় অনুভূতির মাধ্যমে পরমসত্তাকে উপলব্ধি করেন।
সুফিদের মতে, কেবল স্বজ্ঞার মাধ্যমেই আল্লাহকে পাওয়া যেতে পারে। আল্লাহর ধ্যান ও আল্লাহর প্রেম সুফিবাদের নিকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ উদ্দেশ্যে জাগতিক লোভ-লালসা, আনন্দ-উল্লাস, কাম-ক্রোধ ইত্যাদি প্রবৃত্তিকে অবদমন করে আত্মিক উন্নতি সাধনে আত্মা পরিশুদ্ধি ও আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
সুফিবাদ ও রক্ষণশীল ইসলামের মধ্যে পার্থক্য : সুফিবাদ ইসলামের একটি অপরিহার্য অংশ। প্রথম পর্যায়ে সুফিবাদ ও ইসলামের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে সুফিরা বা সাধারণ মুসলমানেরা কুরআনের কিছু আয়াতকে উপেক্ষা করে কিছু আয়াতের উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। এসব কারণে সুফিবাদ ও রক্ষণশীল ইসলামের মধ্যে কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় যা নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
১. রক্ষণশীল ইসলামে আল্লাহকে কম বেশি ভীতির উৎস হিসেবে দেখা হয়। সেজন্য রক্ষণশীল ইসলামে মুসলমানেরা শাস্তির ভয়ে ও পুরস্কারের আশায় ধর্মীয় কর্তব্য পালন করে। কিন্তু সুফিরা আল্লাহকে কেবল ভীতির উৎস হিসেবে দেখেন না, তারা তাঁকে প্রেমের উৎস হিসেবে দেখেন। তাই সুফিদের মতে, আল্লাহ প্রেমময়।
২. রক্ষণশীল ইসলামে মুসলমানরা বিশ্বজগৎ সম্পর্কে বহুত্ববাদী এবং আল্লাহ্ সম্পর্কে একেশ্বরবাদী বা একখোদাবাদী অভিমত ব্যক্ত করেন। কিন্তু অধিকাংশ সুফিরা বিশ্বজগৎ সম্পর্কে একত্ববাদী এবং আল্লাহ্ সম্পর্কে সর্বেশ্বরবাদী বা সর্বখোদাবাদী অভিমত ব্যক্ত করেন।
৩. ইসলামের মৌলিক ভিত্তি হলো ‘কালেমা তাইয়্যেবা’-‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ (আল্লাহ্ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, মুহাম্মদ (স) আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ)। রক্ষণশীল মুসলমানেরা একথাটির অর্থ ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই’ বলে ব্যাখ্যা দেন। কিন্তু অধিকাংশ সুফিরা ‘আল্লাহ্ ব্যতীত কোন সত্তা নেই’ বলে আখ্যা দেন।
৪. রক্ষণশীল ইসলাম অনুসারে মৃত্যুর পর মানবাত্মা তার ব্যক্তি স্বকীয়তা ফিরে পাবে। আর এই আত্মা ভালো কাজের পুরস্কার এবং মন্দ কাজের শাস্তি ভোগ করবে। কিন্তু সুফিদের মতে, প্রেমিক আত্মা আল্লাহর আত্মার মধ্যে সমাহিত বা আত্মভূত হবে।
৫. রক্ষণশীল ইসলাম অনুসারে আল্লাহর সঙ্গে মানুষের সম্মিলন সম্ভব নয়। ইবাদত বন্দেগীর দ্বারা মানুষ যত উচ্চ মাত্রার পরিপূর্ণতাই অর্জন করুক না কেন,তাদের কোন মতেই আল্লাহর সঙ্গে সম্মিলন সম্ভব নয়। সুফিদের মতে, আল্লাহর সঙ্গে মানুষের সম্মিলনের মধ্যেই মানবজীবনের সার্থকতা নিহিত রয়েছে।
৬. রক্ষণশীল ইসলাম কখনো শারী’আতের দ্বারা নির্দেশিত ধর্মীয় কর্তব্য যেমন : রোযা, নামাজ, হজ, যাকাত ইত্যাদি পরিত্যাগ করার অনুমতি দেয় না। কিন্তু কোন কোন সুফি যখন আল্লাহর প্রেমে মগ্ন হয়ে আল্লাহর পথে মাজহুব বা মজনু হয়ে যান, তখন তাঁরা রক্ষণাশীল মুসলমানের মতো শারী’আতের দ্বারা নির্দেশিত ধর্মীয় কর্তব্য পালনের উপর তেমন গুরুত্ব আরোপ করেন না।
৭. রক্ষণশীল ইসলামে মুসলমানেরা সাধারণত জ্ঞানের উৎস হিসেবে ‘আকল’ ও ‘কাশফ’ এর উপর গুরুত্ব না দিয়ে ‘নকল’ এর উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। কিন্তু সুফিরা জ্ঞানের উৎস হিসেবে ‘কাশফ’ এর উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন।
৮. রক্ষণশীল ইসলামে মুসলমানেরা ধর্মের বহিঃস্থ আবরণ বা যাহিরী দিকের উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করে। কিন্তু সুফিরা আত্মিক বিশুদ্ধি বা আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের জন্য ধর্মের অভ্যন্তরীণ বা বাতিনী দিকের উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করেন।
৯. সাধারণ রক্ষণশীল মুসলমানেরা কুরআনের আয়াতের শাব্দিক অর্থের উপর জোর দেন। কিন্তু সুফিরা কুরআনের আয়াতের শাব্দিক ও রূপক অর্থের দিকে গুরুত্ব দেন।
১০. রক্ষণশীল ইসলামে মুসলমানদের অভিমত হচ্ছে আল্লাহ্ এ জগতের অতিবর্তী ও অন্তর্বর্তী। কিন্তু অধিকাংশ সুফিদের অভিমত হচ্ছে আল্লাহ্ অতিবর্তী নয়; বরং অন্তর্বর্তী ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, রক্ষণশীল ইসলাম ও সুফিদের মত ও পথের মধ্যে সাদৃশ্যের চেয়ে পার্থক্যই বেশি পরিলক্ষিত হয়। আধ্যাত্মিক সাধনা ও জ্ঞানার্জনের ক্ষমতা সব মানুষের সমান নয়। এসব জ্ঞান নির্বাচিত কিছু ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সুতরাং আল্লাহর প্রেম ও নৈকট্য লাভের জন্য সুফিদের বহু পথ অতিক্রম করতে হয়, যা সাধারণত মুসলমানের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*