সুফিবাদ কী? সুফিবাদের মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি আলোচনা কর।

অথবা, সুফিবাদের মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তিগুলো আলোচনা কর।
অথবা, সুফিবাদের সংজ্ঞা দাও। সুফিবাদের মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি ব্যাখ্যা কর।
অথবা, সুফিবাদের মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি সম্পর্কে যা জন লেখ।
উত্তরা।। ভূমিকা :
সুফিবাদ আল্লাহর প্রেম ধ্যানভিত্তিক একটি মতবাদ। ইসলামে সুফিবাদের আবির্ভাব ঘটে একদিকে মুতাজিলাদের বুদ্ধিবাদ এবং অপরদিকে প্রথম তিন হিজরি সালের সূত্রবাদীদের নির্বিচার আনুষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেকে। অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায়ের সুফিবাদের মূল মতাবলি ইসলাম বিষয়ক একপেশে দৃষ্টির উপর প্রতিষ্ঠিত। জ্ঞান অর্জনের প্রশ্নে এখানে স্বজ্ঞার উপর অতিশয় জোর দেয়া হয় এবং প্রজ্ঞা, ঐতিহ্য এবং অভিজ্ঞাতাকে উপেক্ষা করা হয়। ইহলোক ও পরলোককে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভাবার এবং ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনকে যথাযথভাবে ব্যবহারের যে কুরআনীয় তাগিদ সুফি অনুশীলন তার লঙ্ঘনস্বরূপ।
সুফিবাদ : সুফিবাদ এক প্রকার রহস্যময় আধ্যাত্মিক মতবাদ। সুফি ভাবধারার মূল লক্ষ্য হলো আল্লাহর গূঢ় অনুভূতির অন্বেষণ ও আত্মার পবিত্রতা বিধান। মানবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন সাধন। সুফি সাধকেরা অন্তরের গভীর অনুভূতির দ্বারা আল্লাহর সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে চান। তাঁদের মতে, ন্যায়-নীতি ভয়-ভীতি অপেক্ষা আন্তরিক ভালোবাসার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। সুফিরা অতীন্দ্রিয় অনুভূতির মাধ্যমে পরম সত্তাকে উপলব্ধি করেন। বুফিদের মতে, কেবল স্বজ্ঞার মাধ্যমেই আল্লাহকে পাওয়া যেতে পারে। আল্লাহর ধ্যান ও আল্লাহর প্রেম সুফিবাদের নিকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ উদ্দেশ্যে জাগতিক লোভ-লালসা, আনন্দ-উল্লাস, কাম-ক্রোধ ইত্যাদি প্রবৃত্তিকে অবদমন করে আত্মিক উন্নতি সাধনে আত্মা পরিশুদ্ধি এবং আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বিভিন্ন সুফি দার্শনিক ও লেখক বিভিন্নভাবে সুফিবাদের সংজ্ঞা দিয়েছেন। যেমন :
আবুল হুসাইন আন নূরির মতে, “যে মতবাদে ইন্দ্রিয়জ আত্মার সকল প্রবৃত্তিকে বিসর্জন দেয়ার কথা বলা হয়েছে তাই সুফিবাদ।”
জুনায়েদ বাগদাদি বলেন, “যে মতবাদে জীবন, মৃত্যুসহ সকল বিষয়ে আল্লাহর উপর নির্ভরতার কথা বলা হয়েছে সে মতবাদই সুফিবাদ।”
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, সুফিবাদ এমন একটি মতবাদ যে মতবাদ ইসলামি শিক্ষার সে দিকটিই নির্দেশ করে, যেটিকে পারলৌকিক, বৈরাগ্যতা ও খোদাভক্তির প্রতি অধিক জোর দেয়া হয়েছে। সুতরাং সুফিবাদ হচ্ছে আল্লাহর প্রেমে নিমগ্ন থাকার দর্শন।
সুফিবাদের মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি : সুফিদের মতে, জীবনের প্রধান ও মূল লক্ষ্য হলো ব্যক্তি আত্মাকে সার্বিক আত্মায় মিশিয়ে ফেলা। ব্যক্তি সত্তার চেতনায় বিলোপ এবং স্বর্গীয় সত্তায় অব্যাহত অস্তিত্ব অর্জন সুফিবাদের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। আত্মার স্বরূপ প্রসঙ্গে তিনটি প্রধান মতবাদ রয়েছে। যথা :
প্রথমত, আত্মা এমন একটি আধ্যাত্মিক বাস্তব সত্তা, যা দেহকে প্রাণবন্ত করে এবং যা দেহবিনাশের সাথে বিনষ্ট হয় না। দেহের ভিতরে আত্মার প্রবেশ আধ্যাত্মিক প্রগতির পথে বড় বাধা। সেজন্যই তা সবসময় নিজেকে এই বন্ধন থেকে মুক্ত হতে চায়।

দ্বিতীয়ত, আত্মা এমন একটি ধারণা, যাকে ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতায় উপস্থাপিত করা যায় না। এটি এমন একটি জিনিস যা অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়।
তৃতীয়ত, এ ধরনের কোন আধ্যাত্মিক আত্ম সত্তার অস্তিত্ব বাস্তবতায় বিশ্বাস করে না, বরং আত্মাকে জটিল মস্তিষ্ক প্রক্রিয়ার একটি উপবস্তু বলে মনে করে। এরিস্টটল আত্মাকে যে চারটি বৃত্তিকে ভাগ করেছিলেন সুফিরা তা গ্রহণ করেন। তারা নব্যপ্লেটোবাদীদের সাথে একমত হয়ে বলেন যে, মায়ের গর্ভেই আত্মার উদ্ভিদবৃত্তির সৃষ্টি হয়। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর কিছু বাসনা প্রদর্শন করে এবং পরবর্তী পর্যায়ে অর্জিত হয় কালব বা মন। এ পর্যায়ে প্রত্যক্ষ ও বোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরপর আত্মা প্রয়োগ করে তার দৃষ্টি শক্তি এবং সরাসরি প্রত্যক্ষ করে আল্লাহর আলোক। জড়জগতের অন্তর্নিহিত বাস্তবসত্তাকে প্রত্যক্ষ করাই আত্মার মৌলিক কাজ ।
সুফিদের মতে, আত্মার উৎপত্তি ঘটেছে এক স্বর্গীয় আদিনিবাস থেকে। ভাগ্যচক্রে তা সেখান থেকে অধঃপতিত হয়েছে। তাই আদি পবিত্রতা পুনরুদ্ধার করতে হলে কিছু পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। তাদের এ মতের সাথে জন্মান্তরবাদের কিছুটা সাদৃশ্য রয়েছে। আসলে কোন সুফিই পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে না। মুক্তি লাভের পূর্ব পর্যন্ত আত্মার দৈহিক আকার তার কর্ম দ্বারা নির্ধারিত হয়। সুফিরা এ ধারণাটির তীব্র সমালোচনা ও বিরোধিতা করেন। তাদের মতে, দেহ ধ্বংস হবার পরও আত্মা টিকে থাকবে এবং জগতে কর্ম অনুসারে সে তার ফল ভোগ করবে। ভালো কাজ করলে সে পুরস্কৃত হবে এবং খারাপ কাজ করলে সে শাস্তি পাবে। জড় দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর আত্মা একটি মসৃণ দেহ লাভ করবে এবং অনন্ত আত্মায় মিশে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সুখ বা দুঃখ ভোগ করবে। এভাবে আত্মা পার্থিব জীবনের কর্মফল ভোগ করাকে বরজখ বলা হয়। তাই পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই আমরা মানুষকে সর্বোত্তমরূপে সৃষ্টি করেছি। কিন্তু মানুষ নিজেই তার পাপকর্ম দ্বারা নিজেকে অধঃপতিত করেছে এবং এজন্যই শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত বরজখ অবস্থায়
তাকে তার কর্মফল ভোগ করতে হবে।”
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে,আত্মা একটি মসৃণ পরমাণু কিংবা কিছু সংখ্যক ইলেকট্রনের যোগফল কিংব। কিছু রাসায়নিক উপকরণের সমন্বয় কিছুই বলা যায় না। আসলে আত্মা উপর থেকে আগত একটি শক্তি বিশেষ। আল্লাহর জ্ঞানে আত্মার কিছু আকার বিদ্যমান আছে এবং এ ধরনের একটি আকারের সাথে একটি গুণের সংযোগই আত্মা। এসব আকারের উপর আল্লাহ তাঁর গুণাবলি প্রদান করেন। আল্লাহ যখন তার গুণাবলির সাথে আকারসমূহকে যুক্ত করেন তখনই সৃষ্টি হয় বস্তু । সুতরাং সুফিবাদের মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*