সুফিবাদ কী? বাংলাদেশে সুফিবাদের প্রভাব আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশে সুফিবাদের উপর একটি নীতিদীর্ঘ রচনা কর।
অথবা, “বাংলাদেশে সুফিবাদ” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখ।
অথবা, বাংলায় সুফিবাদের প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।
উত্তরা।৷ ভূমিকা :
পরম সত্তাকে জানার এবং তাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা মানুষের চিরদিনের। পরম সত্তাকে কাছে পাওয়ার নিমিত্তে বিভিন্ন চিন্তাবিদ বিভিন্ন ধরনের পন্থা আবিষ্কার করেছেন। এদের কোন কোনটি মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। আর কোনটি মতবাদ হিসেবে তার যথার্থতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। যেসব পন্থা বা পদ্ধতি মতবাদ রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের মধ্যে সুফিবাদ অন্যতম। সুফিবাদ পরম সত্তাকে লাভের উপায় হিসেবে আধ্যাত্মিক পথ বেছে নিয়েছে।
সুফিবাদ : সুফিবাদ এক প্রকার রহস্যময় আধ্যাত্মিক মতবাদ। সুফি ভাবধারার মূল লক্ষ্য হলো আল্লাহর গূঢ় অনুভূতির অন্বেষণ ও আত্মার পবিত্রতা বিধান। মানবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন সাধন। সুফি সাধকেরা অন্তরের গভীর অনুভূতির দ্বারা আল্লাহর সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে চান। তাঁদের মতে, ন্যায়-নীতি, ভয়-ভীতি অপেক্ষা কালোবাসার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। সুফিরা অতীন্দ্রিয় অনুভূতির মাধ্যমে পরমসত্তাকে উপলব্ধি করেন। সুফিদের মতে, কেবল স্বজ্ঞার মাধ্যমেই আল্লাহকে পাওয়া যেতে পারে। আল্লাহর ধ্যান ও আল্লাহর প্রেম সুফিবাদের নিকট
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ উদ্দেশ্যে জাগতিক লোভ-লালসা, আনন্দ উল্লাস, কাম-ক্রোধ ইত্যাদি প্রবৃত্তিকে অবদমন করে আত্মিক উন্নতি সাধনে আত্মা পরিশুদ্ধি এবং আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
বাংলাদেশে সুফিবাদের প্রভাব : বাংলাদেশ দর্শনের প্রসারে বৈষ্ণব, বাউল, বৌদ্ধ, সুফি প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বাংলাদেশ দর্শনের প্রসারে একক কোন দার্শনিক ধারা তার একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখতে পারেনি। কারণ বাংলাদেশের ইতিহাস বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর চিন্তাধারার সমন্বয়ের ইতিহাস। আর এই বাংলাদেশে সুফিবাদের ভূমিকা অগ্রগণ্য । নিম্নে বাংলাদেশের দর্শনে সুফিবাদের প্রভাব আলোচনা করা হলো :
১. মরমি চেতনাভিত্তিক দর্শন : বাংলাদেশের জনগণ সুপ্রাচীনকাল থেকে ধর্মপ্রাণ এ কথা সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশের মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই একটু নরম মনের অধিকারী। আর এ নরম মনে ধর্মের স্থান যে একটু বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে বাংলাদেশের মানুষের চিন্তা যে যুক্তিনির্ভর নয়, এ কথাও বলা যাবে না। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ সেই সুপ্রাচীনকাল থৈকে ধর্মে বিশ্বাস করে আসছে। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে ইসলামের আবির্ভাব খুব বেশি দিনের নয়, এর মধ্যে ইসলামের মৈত্রীবোধ বাংলার জনগণের হৃদয় আকর্ষণ করতে শুরু করে। সুফিবাদ এই ইসলামি ভাবধারার একটি বলিষ্ঠ শাখা । সুফিবাদ কথাটির মধ্যেই অনাড়ম্বর জীবনবাদিতা ও পরমসত্তার সাথে আধ্যাত্মিক প্রেম তথা পরমসত্তার সাথে মিলিত হওয়ার যে পরম আকাঙ্ক্ষা তার পরিচয় পাওয়া যায়। সুফি দার্শনিকরা পরমসত্তার সন্ধান করেন প্রেমের মাধ্যমে। সুফিদর্শনের এই যে মরমিবাদ তা বাংলাদেশ দর্শনের প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
২. প্রেমের মাধ্যমে শান্তি সম্ভব : সুফি দার্শনিকরা মনে করেন, সংঘাত নয়; ঐক্য বিশৃঙ্খলা নয়; মৈত্রীর বন্ধনই পরমসত্তার সৃষ্টি। তাঁরা মানুষে মানুষে বিভেদ মানতেন না। এ কারণে তাদের চিন্তায় কখনই স্থান পায়নি সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা। তাঁদের যুক্তিটা এ রকম – · সকল মানুষ যদি একই স্রষ্টার সৃষ্টি হয় এবং সকল মানুষের মূল উৎস যদি একই হয়ে থাকে, তাহলে বিভিন্ন অজুহাতে একের সঙ্গে অন্যের বিবাদের যুক্তি কোথায়? সুতরাং তাদের মতে, বিভেদ নয়, ঐক্য সংঘাত নয়, সম্প্রীতিই হওয়া উচিত সকল মানুষের জীবন দর্শন। অর্থাৎ সুফি দার্শনিকরা প্রেমের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব, এ কথাই বুঝাতে চেয়েছেন। আর সুফিদর্শনের এই প্রেমভিত্তিক মতবাদ বাংলাদেশের দার্শনিকদের
দর্শন চিন্তায় ব্যাপক প্রভাব পড়েছে বলে সুধীজনেরা মনে করেন।
৩. মানবতাবাদী চিন্তাধারার প্রভাব : সুফিদার্শনিকরা শুধু পরমসত্তার অস্তিত্ব অনুভব ও তাঁর সাথে আধ্যাত্মিক মিলনেই সকল কিছুর পরিসমাপ্তি চাননি। তাঁরা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন মানবতাবাদ। তবে এ মানবতাবাদ কোন সংকীর্ণ দেশ ও গণ্ডির মধ্যে তাঁরা সীমাবদ্ধ রাখেননি; তারা বৈশ্বিক মানবতাবাদের কথা বলেন।তাঁদের মতে, সকল মানুষই যেহেতু পরম স্রষ্টার সৃষ্টি সেহেতু সকল মানুষের কল্যাণ করা বা চাওয়া প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। সুফি দার্শনিকদের মতে, সংকীর্ণতা কখনো শান্তি এনে দিতে পারে না। তাই তাঁরা সবসময় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে অন্যের সেবা করার পরামর্শ দেন।আর এই মানবপ্রেম বা মানবতাবাদই বাংলাদেশ দর্শনের দার্শনিকদের ব্যক্তিজীবনে চিন্তাধারায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল।
৪. উদারতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি : সুফি দার্শনিকরা মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করেননি; সকল মানুষকেই তাঁরা এক করে দেখেছেন। সুফিদর্শন হচ্ছে প্রেমভিত্তিক দর্শন। আর এই প্রেমভিত্তিক দর্শন মানুষে মানুষে ভালোবাসার কথাই প্রচার করেছে। পরম সৃষ্টিকর্তার সাথে প্রেমের মাধ্যমেই সুফি দার্শনিকগণ যখন জীবন ও জগতের স্বরূপ উপলব্ধি করতে সমর্থ হন তখনই তাঁরা বুঝতে পারেন শুধু পরমস্রষ্টাকে ভালোবাসলেই সব শেষ হয়ে যায় না, জীবের প্রতি ভালোবাসাও তাদের কর্তব্য। এ চেতনায় সুফি দার্শনিকদের সকল সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে উদারতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সকল কিছুকে দেখতে হয়। আর এ উদারতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশ দর্শনের দার্শনিকদের চিন্তাবিকাশে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশে সুফিবাদের প্রভাব খুবই বিস্তৃত। মানবতাবাদ, উদারতাবাদ, প্রেমদর্শন, আধ্যাত্মিক দর্শন তথা পরমসত্তার অস্তিত্ব উপলব্ধিসহ বিভিন্ন দার্শনিক চিন্তাধারার বিকাশে সুফিবাদ বাংলাদেশে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে। এই সুফিবাদের প্রভাব বাংলাদেশ দার্শনিকদের সকল সংকীর্ণতার উর্ধ্বে মুক্ত চিন্তার মাধ্যমে জীব ও জগতের স্বরূপ অনুসন্ধান ও কল্যাণের পথে ধাবিত হওয়ার দিকে উৎসাহিত করেছে এ কথা বলা যায়।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*