সমাজ কাঠামোর সংজ্ঞা দাও । গ্রামীণ সমাজ কাঠামোর পরিবর্তনের কারণসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, সমাজ কাঠামো কাকে বলে? গ্রামীণ সমাজ কাঠামো পরিবর্তনের কারণসমূহ উল্লেখ কর।
অথবা, সমাজ কাঠামো বলতে কী বুঝ? গ্রামীণ সমাজ কাঠামো কেন পরিবর্তন হচ্ছে? বর্ণনা কর।
উত্তর।। ভূমিকা : আজ আমরা যে আধুনিক সভ্য সমাজে বাস করি এ সভ্য সমাজ একদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।দীর্ঘদিনের ক্রমবিবর্তনের ফলে আজকের এই আধুনিক সমাজের সূত্রপাত। সমাজ একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। প্রতিনিয়ত এই সমাজব্যবস্থা পরিবর্তিত হচ্ছে। মানুষের চাহিদা অনুসারেই সমাজব্যবস্থা দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে। সামাজিক সম্পর্কের সমস্ত বিষয়াবলি নিয়েই সমাজ কাঠামো গড়ে উঠে। সমাজ কাঠামো সমাজের দর্পণস্বরূপ। কারণ হিসেবে বলা যায় যে, একটি সমাজের বাস্তব চিত্র সমাজ কাঠামোর মাধ্যমে লক্ষ্য করা যায়।
সমাজ কাঠামোর সংজ্ঞা : কোনো বিষয়ের মৌলিক ভিত্তি হলো কাঠামো। নির্দিষ্ট কতকগুলো বিধিবিধানকে কেন্দ্র করে এ ভিত্তি গড়ে ওঠে। আর সমাজ কাঠামো বলতে সমাজের বিভিন্ন সংগঠনগুলোর পরস্পর সমসূত্রের সমন্বয়কে বুঝায়। সমাজ কাঠামো সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষী সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তার কতিপয় সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো :
সমাজবিজ্ঞানী গার্খ ও মিলস তাদের ‘Character and Social Structure’ গ্রন্থে বলেন যে, “Institution is the unit with which we build the conception of social struction”
সমাজবিজ্ঞানী মরিস জিন্সবার্গ-এর মতে, “সমাজ কাঠামো হচ্ছে সমাজকে রূপদান করে এমন প্রধান প্রধান সামাজিক
গোষ্ঠীর অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়।”
সমাজবিজ্ঞানী নেডেল তাঁর The Theory of Social Structure’ নামক গ্রন্থে বলেন যে, “সমাজ কাঠামো হলো একটি জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সদস্যের পারস্পরিক সম্পর্কের একটি রূপ, যা তাদের ভূমিকার মধ্যদিয়ে সু-স্পষ্ট হয়ে ওঠে।”
নৃবিজ্ঞানী র্যাডক্লিফ ব্রাউন তাঁর ‘On Social Structure’ গ্রন্থে বলেন যে, “সমাজ কাঠামো হলো ব্যক্তির সব ধরনের সামাজিক সম্পর্ক।”
উপরেবর্ণিত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায় যে, সমাজ কাঠামো হলো সামাজিক সম্পর্কের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ যা ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির ও সমাজের বিভিন্ন উপাদানের সাথে মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠে।
গ্রামীণ সমাজ কাঠামো পরিবর্তনের কারণ : সমাজ কাঠামো পরিবর্তন একটি জটিল প্রক্রিয়া। বিভিন্ন উপাদানের মধ্য দিয়ে সামাজিক পরিবর্তন হয়ে থাকে। তাই বলা যায় যে, কোনো বিশেষ বা নির্দিষ্ট কারণে সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন সাধিত হয় না। গ্রামীণ এ সমাজ কাঠামো দীর্ঘদিন সমাজের উপাদানসমূহের পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এ পরিবর্তন সাধিত হয়। যে সকল কারণে গ্রামীণ সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন সাধন হচ্ছে নিম্নে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন : গ্রামীণ সমাজ কাঠামো পরিবর্তন যে সকল কারণে হয়ে থাকে তার মধ্যে অন্যতম একটি প্রধান কারণ হলো বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কার ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন। বিজ্ঞানের আবিষ্কারের ফলে সমাজের অবকাঠামোগত পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে, যা সমাজ কাঠামোকে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করছে। বিজ্ঞানের আবিষ্কারের ফলে মানুষ প্রযুক্তির উপর নানাভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। যা সমাজিক কাঠামো পরিবর্তন সাধন করছে।
২. ভৌগোলিক কারণ : সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তনের পিছনে যে সকল উপাদান বা কারণ রয়েছে তার মধ্যে ভৌগোলিক কারণ অন্যতম। কোনো এলাকায় ভৌগোলিক পরিবেশের পরিবর্তন ঘটলে সে এলাকার জনসাধারণের সার্বিক জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন সাধিত হয়।
৩. সাংস্কৃতিক কারণ : গ্রামীণ সমাজ কাঠামোর পরিবর্তনের জন্য যে সকল উপাদান মুখ্য ভূমিকা পালন করে তার মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি উপাদান হলো সংস্কৃতি। যে কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও সমাজে তার ব্যবহার সমাজ জীবনে যথেষ্ট পরিবর্তন করে থাকে। সাংস্কৃতিক পরিবর্তন প্রধানত দুটি কারণে হতে পারে। যেমন- অন্য সমাজের সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য ধারণ এবং সমাজের মধ্যে নতুন সংস্কৃতির আবিষ্কার। বর্তমান সময়ে পশ্চিমা সংস্কৃতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির পরিবর্তন এনেছে।
৪. রাজনৈতিক কারণ : গ্রামীণ সমাজ কাঠামো পরিবর্তনের রাজনৈতিক কারণ অন্যতম। রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের ফলে সমাজে তথা গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় বেশি পরিবর্তন সাধিত হয়। রাজনৈতিক অবস্থা বা রাজনৈতিক পট পরিবর্তন সামাজিক তথা গ্রামীণ সমাজ কাঠামো পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
৫. ধর্মীয় কারণ : ধর্মীয় অনুশাসন সমাজের মানুষের আচার-আচরণ বা ব্যবহার, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, রীতি-নীতি সভ্যতার পরিবর্তনে জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ধর্মীয় মূল্যবোধ বা ধর্মীয় অনুশাসনের পরিবর্তন হলে কোনো দেশ বা জাতির জীবনাদর্শের ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিবর্তন হয়ে থাকে। যা গ্রামীণ সমাজ কাঠামো পরিবর্তন সাধনে যথেষ্ট গুরুত্বের দাবিদার।
৬. অর্থনৈতিক কারণ : গ্রামীণ সমাজ কাঠামো পরিবর্তনের জন্য যে সকল কারণ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত তার মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি কারণ হলো অর্থনৈতিক কারণ। কোনো সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজের ও আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। সমাজে বসবাসরত মানুষের জীবনযাত্রার মানের উপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে থাকে। তাই বলা যায় যে, অর্থনৈতিক কারণে গ্রামীণ সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন হয়ে থাকে।
৭. সংস্কার ও বিপ্লব : গ্রামীণ সমাজ কাঠামো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সংস্কার ও বিপ্লব যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সাধারণত সংস্কার সাধিত হয় ধীরগতিতে কিন্তু বিপ্লব সাধিত হয় দ্রুত গতিতে। সংস্কার ও বিপ্লবের ফলে শুধু গ্রামীণ নয় যে কোনো সমাজের আমূল পরিবর্তন সাধিত হতে পারে।
৮. জৈবিক কারণ : গ্রামীণ সমাজ কাঠামোর পরিবর্তনের ক্ষেত্রে জৈবিক উপাদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সামাজিক পরিবর্তন বহুলাংশে আয়তন, জনসংখ্যা, গঠন প্রভৃতি দ্বারা প্রভাবিত। সামাজিক পরিবর্তনের জৈব উপাদান বলতে জনসংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি, জনসংখ্যার প্রকৃতি, বংশগতির প্রভাব প্রভৃতি বিষয়কে বুঝায়। এসব বিষয়ের তারতম্যের ফলে সামাজিক তথা গ্রামীণ সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন হয়ে থাকে।
৯. শিক্ষা : গ্রামীণ সমাজ কাঠামো পরিবর্তনের জন্য যে সকল উপাদান বিদ্যমান তার মধ্যে শিক্ষা অন্যতম প্রধান একটি উপাদান । শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে সমাজের আমূল পরিবর্তন হয়ে থাকে। সমাজের সকল সমস্যার সমাধান শিক্ষার মাধ্যমে হয়ে থাকে।
উপসংহার : আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, গ্রামীণ সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন একটি জটিল ব্যাপার। এর সুনির্দিষ্ট কারণ অনুসন্ধান খুবই দুরুহ ব্যাপার। কোনো একটি বিশেষ কারণে গ্রামীণ সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন সাধন হয় না। আবার পরিবর্তনের জন্য সবগুলো উপাদান এক সাথে প্রয়োজন নাও হতে পারে। কিন্তু প্রতিটি কারণই গ্রামীণ সমাজ কাঠামোর পরিবর্তনে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।