Answer

সংস্কৃতির সাথে ধর্ম, প্রগতি, সভ্যতার সম্পর্ক কী? ‘সংস্কৃতি কথা’ প্রবন্ধ অবলম্বনে সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য নির্ণয় প্রসঙ্গে এ প্রশ্নের জবাব দাও।

অথবা, ‘সংস্কৃতি কথা” প্রবন্ধ অনুসরণে সংস্কৃতির স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য নিরূপণ কর।
অথবা, ‘সংস্কৃতি কথা’ প্রবন্ধে মোতাহের হোসেন চৌধুরী সংস্কৃতির সাথে ধর্ম, প্রগতি ও সভ্যতার যে সম্পর্ক নির্দেশ করেছেন তা আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বস্তুনিষ্ঠ সংযমী শিল্পী মোতাহের হোসেন চৌধুরী। যুক্তি, বিচার এবং মূল্যবোধে তাঁর সৃষ্টিসম্ভার দীপ্যমান। এ স্থিতধী মিতবাক পুরুষের অনন্য সৃষ্টি ‘সংস্কৃতি কথা’ প্রবন্ধ। এ প্রবন্ধে লেখক যথোপযুক্ত যুক্তির মাধ্যমে সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করেছেন। সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে, মহৎভাবে বাঁচা। সত্যকে ভালোবাসা, সৌন্দর্যকে ভালোবাসা, ভালোবাসাকে ভালোবাসা, নিজের ক্ষতি স্বীকার করে ভালোবাসা এরই নাম সংস্কৃতি।
সংস্কৃতির সাথে ধর্মের সম্পর্ক : ধর্ম সাধারণ লোকের সংস্কৃতি আর সংস্কৃতি শিক্ষিত ও মার্জিত লোকের ধর্ম। সংস্কৃতি হচ্ছে উন্নততর জীবন সম্পর্কে চেতনা; সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেম সম্পর্কে ধারণা। সাধারণ লোকেরা ধর্মের মাধ্যমে তা পেয়ে থাকে। তাই তাদেরকে ধর্ম থেকে বঞ্চিত করা আর সংস্কৃতি থেকে বঞ্চিত করা এক কথা। ধর্ম মানে জীবনের নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু মার্জিত আলোক প্রাপ্তরা সংস্কৃতির মাধ্যমেই নিজেদের নিয়ন্ত্রিত করে। সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত সংস্কৃতির উদ্দেশ্য নয়- উপায়। এর উদ্দেশ্য নিজের ভিতর একটা ঈশ্বর বা আল্লাহ সৃষ্টি করা। কিন্তু বাইরের ধর্মকে যারা গ্রহণ করে তারা আল্লাহকে জীবনে প্রেরণারূপে পায় না- ঠোঁটের বুলি রূপে পায়। ধর্ম চায় মানুষকে পাপ থেকে, পতন থেকে রক্ষা করতে -মানুষকে বিকশিত করতে নয়। অপরদিকে, সংস্কৃতির উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবনের বিকাশ-পতন বা পাপ থেকে রক্ষা করা নয়। ধর্ম ইন্দ্রিয় সাধনার পরিপন্থী আর ইন্দ্রিয়ের পঞ্চপ্রদীপ জ্বেলে জীবনধারণের নাম সংস্কৃতি। সুতরাং সংস্কৃতির সাথে ধর্মের সম্পর্কটা মানুষকেন্দ্রিক। মানুষই উভয়ের স্রষ্টা ও পৃষ্ঠপোষক।
সংস্কৃতির সাথে প্রগতির সম্পর্ক : প্রগতি সংস্কৃতিরই ফসল। যে সমাজে সংস্কৃতিরচর্চা নেই সে সমাজে প্রগতির দ্বার রুদ্ধ। সংস্কৃতিচর্চার মধ্য দিয়েই প্রগতি বিকশিত হয়। সংস্কারমুক্তি প্রগতির পূর্বশর্ত। অন্যদিকে, সংস্কারমুক্তি সংস্কৃতির একটা শর্ত মাত্র। সাধারণ লোকের কাছে প্রগতি আর সভ্যতায় কোন পার্থক্য নেই। যা সভ্যতা তাই প্রগতি, অথবা যা প্রগতি তাই সভ্যতা। কিন্তু সংস্কৃতিবান লোকেরা তা স্বীকার করে না। এ দুয়ের সূক্ষ্ম পার্থক্য সম্বন্ধে তারা সচেতন। প্রগতি তাদের কাছে জ্ঞানের ব্যাপার। কেননা জ্ঞানের ক্ষেত্রেই পরিবর্তনশীলতা অবধারিত। সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে নয়। তাই জ্ঞানবিজ্ঞানপ্রসূত কল্যাণকেই তারা প্রগতি বলে মনে করে। প্রকৃতি বিজয়লব্ধ সমৃদ্ধির সার্থক বিতরণই তাদের কাছে প্রগতি। সংস্কৃতির সাথে প্রগতির সম্পর্ক নিবিড়। সংস্কৃতির উপর দাঁড়িয়েই প্রগতি নিজেকে বিকশিত করে। সুতরাং সংস্কৃতিকে প্রগতির সূতিকাগার বললে ভুল হবে না।
সংস্কৃতির সাথে সভ্যতার সম্পর্ক : সভ্যতা শুধু প্রগতি নয় আরো কিছু। প্রগতির সাথে সৌন্দর্যের এবং প্রেমের সম্বন্ধ স্থাপিত না হলে সভ্যতা হয় না। সভ্যতা মূল্যবোধের ব্যাপার। জীবনে সোনা ফলাতে হলে প্রগতিকে চলতে হবে সভ্যতার দিকে মুখ করে। নইলে তার কাছে বড় কিছু পাওয়া যাবে না। কিন্তু আজকাল প্রগতি কথাটা যত্রতত্র শুনতে পাওয়া গেলেও সভ্যতা কথাটা তত শোনা যায় না। এর কারণ মানুষের মধ্যে সংস্কৃতিরচর্চা কমে গিয়েছে। সংস্কৃতি চর্চা থেকে জন্ম নেয় প্রগতি আর প্রগতির ভিত্তির উপর রচিত হয় সভ্যতা। তাই সংস্কৃতির সাথে প্রগতির সম্পর্কও অত্যন্ত নিবিড়। যে সমাজে সংস্কৃতিচর্চা নেই সে সমাজ সভ্য সমাজ নয়, সে সমাজে সভ্যতা গড়ে উঠে না।
সংস্কৃতির স্বরূপ : সংস্কৃতি সমাজতান্ত্রিক নয়, ব্যক্তিতান্ত্রিক। নিজেকে বাঁচাও, নিজেকে মহান করো, সুন্দর করো, বিচিত্র করো, এটাই সংস্কৃতির আদেশ এবং এ আদেশের সফলতার দিকে নজর রেখেই তা সমাজতন্ত্রের সমর্থক। সমাজতন্ত্র সংস্কৃতির লক্ষ্য নয়, উপলক্ষ মাত্র। সংস্কৃতি ব্যক্তিতান্ত্রিক এ কথা বললে এটা বুঝায় না যে, সংস্কৃতিবান মানুষ সমাজের ধার ধারে না, সে দলছাড়া গোত্রছাড়া জীব। কিন্তু তা নয়, সমাজের ধার সে খুবই ধারে। নইলে প্রাণ পাবে কোত্থেকে? ব্যক্তিতো নদী, আর সমাজ সমুদ্র। সমুদ্রের সাথে যোগযুক্ত না হলে সে বাঁচবে কী উপায়ে? সুতরাং, নিজের স্বার্থের দিকে নজর রেখেই সংস্কৃতিবান মানুষ সমাজের কথা ভাবে। এমনকি দরকার হলে সমাজের জন্য সে প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত থাকে। সংস্কৃতিবান মানুষ ব্যক্তিতান্ত্রিক এই অর্থে যে, সমাজ বা অর্থনীতির কথা ভেবে সে নিজের অসৌন্দর্যকে ক্ষমা করে না। এ সমাজে, এ অর্থনীতির অধীনে এর চেয়ে বেশি সুন্দর হওয়া যায় না, এ কথা বলে নিজেকে কি অপরকে সান্ত্বনা দিতে সে লজ্জাবোধ করে।
সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য : ধর্ম, প্রগতি ও সভ্যতার সমন্বয়ই সংস্কৃতি। এর কোন একটাকে বাদ দিলে সংস্কৃতি পঙ্গু হয়ে পড়বে। এ সংস্কৃতি মানে জীবনের মূল্যবোধ সম্পর্কে ধারণা। সংস্কৃতি মানে পরিপক্ক হওয়ার সাধনা। সেজন্য জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রেম, প্রগতি ও সভ্যতার প্রয়োজন । সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে, মহৎভাবে, বিচিত্রভাবে বাঁচা। ধর্মচর্চার মাধ্যমে, কাব্য পাঠের মাধ্যমে, বিচিত্র দেশ- জাতির সাহচর্যের মাধ্যমে, মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের মাধ্যমে নিজেকে পরিপূর্ণ করে তোলার নাম সংস্কৃতি।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ধর্ম, প্রগতি ও সভ্যতা সংস্কৃতিরই অঙ্গ। ধর্মের অন্ধত্ব থেকে মুক্ত হয়ে প্রগতির পথ ধরে সভ্যতা গড়ে তোলাই সংস্কৃতির কাজ। জীবনের মূল্যবোধ সৃষ্টি এবং জীবনকে বর্জন করে নয় ভালোবেসে সমৃদ্ধ করাই সংস্কৃতি চর্চার উদ্দেশ্য। যদি তা সম্ভব হয় তবে ধর্ম, প্রগতি ও সভ্যতা উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি লাভ করতে পারে।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!