শালিস কী? গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোয় শালিসের স্বরূপ বা প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, শালিস বলতে কী বুঝ? গ্রামীণ পরিবেশে শালিসের প্রকৃতি বর্ণনা কর।
অথবা, শালিস কী? গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোয় শালিসের ধরন তুলে ধর।
অথবা, শালিস কাকে বলে? শালিসের স্বরূপ বর্ণনা কর।
অথবা, শালিস বলতে কী বুঝ? শালিসের প্রকৃতি সম্পর্কে যা জান লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যগত বিচার প্রথা হচ্ছে শালিস।শালিস প্রধানত গ্রাম ও পাড়াভিত্তিক স্থানীয় লোক সমাজের বিচারব্যবস্থা। অতি প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশের পল্লি এলাকায় দুই ধরনের বিচারব্যবস্থা প্রচলিত। একটি হচ্ছে সুনির্দিষ্ট আইনের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় বিচার বিভাগের কার্যক্রম,অন্যটি হচ্ছে শালিসি ব্যবস্থা। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, গ্রাম প্রধান, মাতব্বর প্রভৃতি লোকের নেতৃত্বে শালিস ব্যবস্থা পরিচালিত হয়ে থাকে। শালিসি ব্যবস্থার কার্যক্রম গ্রাম, সমাজ, মহল্লা প্রভৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
শালিস (Salish) : শালিস গ্রামের পুরনো প্রথাজাত প্রতিষ্ঠান। শালিস শব্দের উৎপত্তি আরবি ভাষা থেকে যার আভিধানিক অর্থ মধ্যস্থতা। শালিসের ইংরেজি প্রতিশব্দ Arbitration অর্থাৎ মধ্যস্থতার দ্বারা নিষ্পত্তি। শালিস গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসা একটি বিচারিক ব্যবস্থা।শালিস গ্রামীণ দ্বন্দ্ব, সংঘাত, বিরোধ, মনোমালিন্যসহ যাবতীয় অসহযোগিতা ও বিরুদ্ধবাদিতা মীমাংসার অন্যতম প্রধান উপায় হিসেবে পরিগণিত হয়। বিশেষত কোনো অভিন্ন বিষয় নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে অমীমাংসের অবস্থার সৃষ্টি হলে কিংবা সামাজিক অপরাধ, দ্বন্দ্ব, সংঘাত ইত্যাদি দেখা দিলে তা প্রতিরোধ করার মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয় গ্রামীণ শালিস ব্যবস্থাকে যা গ্রামের স্থিতিশীলতা আনয়ন করে থাকে। শালিস সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, শালিস মধ্যস্থতার কাজ করে, বিচারসভার মাধ্যমে মধ্যস্থতা সম্পন্ন হয়ে থাকে। বিচারসভা অনেক বেশি মাত্রায় আনুষ্ঠানিক। প্রত্যেকেই গ্রাম বা পাড়ার সদস্য, তাই এটি গ্রামভিত্তিক হয়ে থাকে। এখানকার বিচার সভায় সদস্য পদ সীমিত যার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করে মাতব্বর বা গ্রাম প্রধান।সুতরাং শালিসের মূল লক্ষ্য হচ্ছে বিবাদমান দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টি করা।কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে শালিসের ব্যাপক অপব্যবহার করা হচ্ছে। কেননা এর পিছনে ক্ষমতা সংহতিকরণ, ধর্মের অপব্যাখ্যা প্রভৃতি কাজ করছে।
গ্রাম্য শালিসের স্বরূপ (Nature of rural arbitration) : অতীতে গ্রামে গ্রাম পঞ্চায়েত ব্যবস্থা থাকলেও বর্তমানে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে গ্রাম পঞ্চায়েতের আদলে গ্রামের ক্ষমতাবান, প্রভাবশালী, গ্রাম্য সরকার, ইউনিয়ন পরিষদের নেতা প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গ গ্রাম্য শালিসের মাধ্যমে গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোয় অবদান রাখেন। নিম্নে গ্রাম্য শালিস ব্যবস্থার প্রকৃতি ও স্বরূপ তুলে ধরা হলো:
i. শালিস বৈঠক (Arbitration meeting) : সামাজিক নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করার জন্য গ্রাম্য শালিস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। গ্রাম্য শালিসে সাধারণত গরিব, অসহায়, পরিবারের দাম্পত্য কলহ, বিবাহবিচ্ছেদ, যৌতুক, তালাক, দেনমোহর সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর সমাধান করা হয়ে থাকে। মাঝে মধ্যে হত্যা, ধর্ষণ, এসিড সন্ত্রাসের মতো মারাত্মক অপরাধের বিচারও গ্রাম্য শালিসের মাধ্যমে সমাধান করা চেষ্টা করা হয়। সমাজের নেতারা শুধু নিজেদের সমাজের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান করেন না,বরং দুটি সমাজের মধ্যে যদি কোনো দ্বন্দ্ব থাকে তবে তা মিটানোর চেষ্টা করেন। শালিস বৈঠকের পূর্বে বাদী বিবাদী উভয়কেই ডেকে উদ্ভূত বিবেচনায় শালিসনামা বা অঙ্গীকার পত্র প্রণয়ন করা হয়। এ শালিসনামা অনুযায়ী শালিস বৈঠক হয়।
ii. শালিসে নেতৃত্বের ধরন ও জনগণের অংশগ্রহণ (Pattern of the leadership and participation of the people) : গ্রামীণ শালিসে নেতৃত্বে দান করে থাকেন গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তি, মহাজন, গ্রামের মোড়ল বা মাতব্বর প্রভৃতি লোকজন। গ্রামীণ শালিস হচ্ছে ক্ষমতাবানদের ক্ষমতা প্রদর্শনের একটা উর্বর ক্ষেত্র। শালিসে নেতৃত্বদানকারী অভিজাত শ্রেণি তাদের নিজেদের শ্রেণি স্বার্থের দিকটি বিশেষভাবে বিবেচনা করে থাকেন। গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিভিন্ন কারণে শালিসে নেতৃত্ব দানের ক্ষেত্রে অযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। শালিসে তারা বাদী, বিবাদী কিংবা দর্শক হিসেবে উপস্থিত থাকে।
iii. স্থানীয় সরকার ও গ্রাম্য শালিস (Local govt. and rural arbitration): স্থানীয় পর্যায়ে শালিসের অধিকার ক্রমশ দুর্বলতা প্রাপ্ত হচ্ছে। স্থানীয় বিচারব্যবস্থাকে এক রকম বাধ্য করে কোর্টমুখী করে তোলার ফলে স্থানীয় সমাজব্যবস্থা অন্তর্গতভাবেই দুর্বল ও কর্মহীন হয়ে পড়ছে। যা স্থানীয় নেতৃত্বের বিকাশে বাধা প্রদান করছে। শালিসের এই বর্তমান দুরবস্থার জন্য গ্রাম সরকার দায়ী বহুলাংশেই দায়ী। সঠিক সামাজিক মীমাংসার শালিসের যে সমস্ত মানদগুগুলো মেনে চলা উচিত, তা বর্তমান গ্রাম সরকার অনুসরণ তো করছে না, বরং রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাত দুষ্ট হয়ে শালিসের গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সদস্যদেরকে শালিসের একজন উচ্চপদস্থ সদস্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যখন সমাজের নেতারা শালিসের মাধ্যমে কোন্দল মিটাতে ব্যর্থ হয়। তখন বিষয়টি মিটানোর জন্য ইউনিয়ন পরিষদের মত প্রতিষ্ঠানের কাছে উত্থাপন করা হয়।
iv. শালিসে NGO এর ভূমিকা (Role of NGO in arbitration) : গণসাহায্য সংস্থা জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে গ্রামীণ দরিদ্রদের সচেতন ও সংগঠিত করে গ্রামীণ শালিসে সংযুক্ত করার প্রয়াস চালায়।তারা সংগঠিত দরিদ্র নারী-পুরুষদের সংগঠিত করে গণসংগঠন গড়ে তোলে। শালিসের মাধ্যমে বিবাদ মীমাংসা করতে ব্যর্থ হলে গণসংগঠন কোর্টে মামলা করে এবং সেক্ষেত্রে গণ সাহায্য সংস্থার নিজস্ব আইনজীবী তাদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করে। এছাড়া বাংলাদেশে ব্র্যাক এবং আইন ও শালিস কেন্দ্র গ্রাম্য শালিসের চর্চা করছে এবং গরিব মানুষের
ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে সহায়তা করছে।
v. শালিসের রায় (Judgement of arbitration) : গ্রামীণ কাঠামোতে একটি গুরুত্বপূর্ণ আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংঘ হিসেবে পরিচিত হচ্ছে শালিস। গ্রামীণ সুবিধা বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে শালিস তাদের অধিকারের পক্ষে কথা বলছে। রায় প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করছে এবং রায় যাতে স্বেচ্ছাচারিতার ভিত্তিতে না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখছে, প্রয়োজনবোধে আইনের স্মরণাপন্ন হচ্ছে। বর্তমানে NGO-দের সহায়তা ও সচেতনতার শক্তিতে বলীয়ান হয়ে গ্রামীণ দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষেরা ক্ষমতাবানদের রায়কে চ্যালেঞ্জ করছে।
বিচারব্যবস্থায় শালিস উত্তম পন্থা কি না (Is arbitration the best policy in judicial system) : বিরোধ নিরসনে মামলা নয়, বরং শালিসের মাধ্যমে নিষ্পত্তিই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। শালিসের মাধ্যমে কথা বলার সুযোগ পাওয়ার মধ্য দিয়ে সমাজের সুবিধা বঞ্চিত মানুষ শালিস ব্যবস্থার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। কিন্তু শালিস নামের একটা আধুনিক, সহজ ও বিজ্ঞানসম্মত বিচার ব্যবস্থাকে যখন তখন, যেখানে সেখানে ব্যবহার করে এর সত্যিকার ভাবমূর্তি নষ্ট করছে সমাজের কিছু কলুষিত লোক।শালিসের নামে চলছে মধ্যযুগীয় বর্বরতা, নৃশংসতা ও অমানষিক নির্যাতন। ভাঙছে সমাজের প্রচলিত নিয়মকানুন আইন যা লঙ্ঘন করছে মানবাধিকারকে। তাই বিচার ব্যবস্থায় শালিস এক অর্থে উত্তম পন্থা, অন্য অর্থে উত্তম পন্থা নয়। পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে শালিস কিভাবে, কখন, কোনো, কোনো প্রক্রিয়ায় সংগঠিত হচ্ছে ইত্যাদি বিষয়ের উপর।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার নিরিখে বলা যায় যে, গ্রাম্য শালিস এক ধরনের বিচারব্যবস্থা। প্রতিটি গ্রামেই মানুষ সহজ সরল প্রকৃতির হতে থাকে। তারা আইনের এই ধরনের বিচারব্যবস্থার অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। গ্রামের বুঝে উঠতে পারে না। তাই নিজেদের মধ্যকার বিরোধ নিরসনের জন্য গ্রামের নেতৃস্থানীয় লোকদের অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় এই সমস্ত নেতৃস্থানীয় লোকজনই মূলত বিবাদের জন দায়ী। তাই পরিশেষে মারপ্যাচ তেমনিভাবে দ্বারস্থ হয়। কিন্তু এতটুকু বলা যায় যে, গ্রামীণ শালিসের প্রকৃতি ও স্বরূপ অনেক বেশি মাত্রায় জটিল।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*