লিঙ্গ বৈষম্য কিভাবে নারীদের সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার সুযোগকে সীমাবদ্ধ করে? আলোচনা কর।

অথবা, লিঙ্গ বৈষম্য কিভাবে নারী সাংবাদিকদের কাজ করার সুযোগ হ্রাস করে? আলোচনা কর।
অথবা, লিঙ্গ বৈষম্য কিভাবে নারীদের সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার সুযোগ সীমাবদ্ধ করছে? বর্ননা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বাংলাদেশে একবিংশ শতাব্দীর সূচনা হয়েছে গণমাধ্যমের বিপুল বিস্তার দিয়ে। বাংলাদেশী গণমাধ্যমে সংবাদ সরবরাহের জন্য কাজ করছে ৭টি সংবাদ সংস্থা। এই যে এত সংবাদ মাধ্যম এগুলোতে কাজ করছে প্রচুর সংখ্যক সাংবাদিক। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, মোট সাংবাদিকের মধ্যে নারী সাংবাদিকের সংখ্যা মাত্র ৬ ভাগ। মনে করা হয় সাংবাদিকতা হচ্ছে পুরুষের পেশা, এরা সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার অনুপযুক্ত। নারীদের লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যকেই সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার অনুপযুক্ত মনে করা হয়। আমাদের এ পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যই তাকে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার সুযোগকে সীমাবদ্ধ করে।
সাংবাদিকতায় নারীর অংশগ্রহণের প্রশ্নে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট : নারীর গণমাধ্যমে অংশগ্রহণ কেন আলোচিত? কেননা প্রচারমাধ্যমের মত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি যদি যথেষ্ট না হয়, তবে কর্মজীবনের সকল ক্ষেত্রে নারী সমঅধিকার পেয়েছে একথা বলা যায় না। এছাড়া বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, গণমাধ্যমে নারীর রূপায়ণ প্রান্তিক ও অনেক ক্ষেত্রে নেতিবাচক। এটি সর্বজনস্বীকৃত সত্য যে, গণমাধ্যমের মত একটি অত্যন্ত সামাজিকীকরণ প্রতিষ্ঠান থেকে নারীর অধস্তন ভাবমূর্তি ক্রমাগত প্রচার ও প্রকাশ করা হলে সমাজ থেকে জেন্ডার বৈষম্য
দূর করা সম্ভব হবে না। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন স্থানীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে আলোচনা শুরু হওয়ার পর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারী ও গণমাধ্যম বিষয়টি মাথাচাড়া দেয় প্রায় তিন দশক আগে বিশ্ব নারী বর্ষে। ১৯৭৫ সালে মেক্সিকো সিটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব নারী সম্মেলনের বৈশ্বিক পরিকল্পনাতেও বলা হয়, যোগাযোগ মাধ্যমের উপর নারীর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ও অভিগম্যতার অভাব একদিকে যেমন নারীর অধস্তন অবস্থান প্রমাণ, অন্যদিকে তার অধস্তনতার কারণও। পরবর্তী বছরগুলোতে নানা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমাবেশে আমরা এ প্রসঙ্গটিকে আরও জোরালো হয়ে উঠতে দেখি। জাতিসংঘ এবং রাষ্ট্রগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি হওয়ার ফলে চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনের কর্মমঞ্চে ক্রিটিক্যাল কনসার্ন হিসেবে নারী ও গণমাধ্যমে প্রশ্নটিও যুক্ত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে নারী প্রগতির লক্ষ্যে যে জাতীয় নীতিমালা গৃহীত হয় সেখানেও এ প্রসঙ্গে
কর্মকৌশল সংযোজিত হয়েছে।
সাংবাদিকতায় নারী পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ : সাংবাদিকতায় নারীর পদচারণার ইতিহাস দীর্ঘদিনের। এ উপমহাদেশের সুদীর্ঘ ইতিহাস যদি বাদও দেই, শুধু এ অঞ্চলেই ‘বেগম’ পত্রিকাটির বয়স হয়েছে ৫৮ বছর। ‘বেগম’
পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগম। সম্পাদকীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের দুরূহ দায়িত্ব নিয়ে যে নারীরা বহু বছর আগে পত্রিকার জগতে প্রবেশ করেছেন, এতদিন কাজের পরেও কোন জাতীয় সংবাদ মাধ্যমের সম্পাদক বা প্রধান পদে তাদের স্থান হয় নি। বর্তমানে বাংলাদেশে ৪০৭টি দৈনিক পত্রিকাসহ দুই হাজারের বেশি পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। এসব পত্রিকা ও সংবাদ সংস্থায় সাড়ে সাত হাজার সংবাদকর্মী নিয়োজিত আছেন। এদের মধ্যে নিয়মিত সাংবাদিকের সংখ্যা আড়াই হাজার। এ আড়াই হাজারের মধ্যে নারী সাংবাদিকের সংখ্যা শ’খানেকের বেশি হবে না। এখন পর্যন্ত কোন নারী রিপোর্টার রাজনীতি, কূটনীতি, অর্থনীতি, আদালত, জাতীয় সংসদ অধিবেশন ইত্যাদি অ্যাসাইনমেন্ট কভার করেছেন বলে দেখা যায় নি।
লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য যেভাবে নারীদের সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার সুযোগকে সীমাবদ্ধ করে : আমাদের দেশে গত এক দশকে গণমাধ্যমের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। কিন্তু যে হারে গণমাধ্যম বেড়েছে সে হারে কেন নারী সংবাদকর্মীর সংখ্যা বাড়েনি। লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য যেভাবে নারীদের নাংবাদিক হিসেবে কাজ করার সুযোগকে সীমাবদ্ধ করে তা নিম্নে
আলোচনা করা হলো :
১. সাংবাদিক হিসেবে নারীকে অবমূল্যায়ন করা : সাংসাদিকতাকে নারীদের জন্য অনুকূল মনে করা হয় না। সাংবাদিকতায় এসে বা বিভিন্ন জনের কাছে জেনে নারীরা সাংবাদিকতা পেশায় আসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। সাংবাদিকতায় নারীরা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয় সেগুলো হলো
ক. পুরুষ সহকর্মীরাই নারীকে পরোপুরি সাংবাদিক মনে করেন না।
খ. এ পেশার বেতনভাতা অনেক ক্ষেত্রেই নগণ্য এবং কিছু ক্ষেত্রে অনিয়মিত। নারী পান আরও কম। কারণ নারীকে পুরুষের চেয়ে অদক্ষ মনে করা হয়। তাই কম বেতন হওয়ার কারণে নারীরা এ কাজ করতে আগ্রহী হয় না।
গ. পদোন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা বিশেষ নেই। অথচ এমন অনেক পেশাই সাংবাদিকত। ছাত্রীরা বেছে নিতে পারেন যেখানে নারী হওয়ার কারণে তাকে অবমূল্যায়ন করা হবে না। সেক্ষেত্রে এমন পেশাতেই তারা আগ্রহী হন
যেখানে তাদের যথাযথ সম্মানী ও সম্মান দেওয়া হবে।
২. নিয়োগদান পদ্ধতি নারীর অনুকূল নয় : অনেক নারীর কাছে সাংবাদিকতাকে একটি গ্রহণযোগ্য পেশা বলে মনে হলেও সাংবাদিকদের নিয়োগদান পদ্ধতিটি খুব পেশাদারি ঠেকে না। কর্মখালির বিজ্ঞাপন ছেপে সংবাদ মাধ্যমে সাধারণত নিয়োগদান হয় না। সাংবাদিকতায় একজনকে যোগ দিতে হয় ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে। পুরুষপ্রধান সাংবাদিকতা জগতে ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে পথ খুলে নেওয়া সাংবাদিকতায় উৎসাহী একজন নারীর জন্য প্রথমেই কঠিন হয়ে দাড়ায়।
৩. পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ : বহিঃপরিসরে অনেকটা সময় কাটাতে হয় এমন কাজ নারীর উপযোগী নয় বলে ধারণা বিদ্যমান। আর সাংবাদিকতায় যেহেতু অনেক সময় বাইরে কাটাতে হয় তাই এটা নারীর জন্য উপযুক্ত মনে করা হয় না। এছাড়া পিতৃতান্ত্রিক সমাজ অর্পিত নারীর সংসার ও সন্তান পালনের যে দায়িত্ব সেটা পালন করতে গিয়ে সে বাইরে কাজ করার সময় পায় না।
৪. নারীর জন্য নিরাপদ মনে না করা : সম্প্রতি নারীর সাংবাদিকতা জগতে দৃশ্যমান না হওয়ার পিছনে সাংবাদিকদের অনিরাপত্তাকে অন্যতম একটি কারণ বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। কোনই সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতন একটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক হারে রয়েছে। তেমনই উদ্বেগজনক হারে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন পোশাক শিল্পের নারী। আরও বেশি হারে নারী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন ঘরে, ফতোয়ার শিকার হচ্ছেন সমাজে, ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হচ্ছেন প্রায় সর্বত্রই।
৫. সাংবাদিকতা পেশায় সুনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই : সাংবাদিকতা পেশায় সুনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই, গভীর রাতে কাজ করতে হতে পারে খবরের সন্ধানে, রাজনীতি উত্তাল বাংলাদেশে নারী-পুরুষের সঙ্গে জনসভা, মিছিল-মিটিং-এ দৌড়াদৌড়ি করে সংবাদ সংগ্রহ করতে পারবে না এটা মনে করা হয়। যুক্তি দিয়ে দেখলে বুঝা যায়, এ সমস্যাগুলো বাস্তবে যতখানি, তার চেয়েও অনেক বেশি দুর্লঙ্ঘ করে রাখে আমাদের মানসিকতা। ডাক্তার বা নার্সরা বহু বছর আগে থেকেই অসময়ে কাজ করে আসছেন। রাজনৈতিক সভায়, মিছিলে, স্লোগানে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ এমনকি লাঞ্ছিত বা প্রহৃত হওয়ার দৃশ্য এ সংবাদ মাধ্যমগুলোই ক্রমাগত প্রচার করছে। কিন্তু সেই দৃশ্যে ধারণ করতে বা সে সম্পর্কে রিপোর্ট করতে নারী সক্ষম হবে। না কেন? সুতরাং দেখা যাচ্ছে নারীরা সাংবাদিকতায় দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারবে কিন্তু আমাদের মানসিকতার কারণেই তারা এগিয়ে আসতে পারছে না।
৬. পুরুষের পেশা বলে মনে করা : নির্মোহভাবে বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করলে যে কোন যুক্তিবান মানুষই বুঝতে পারবেন, সাংবাদিকতায় নারীর প্রান্তিক অবস্থানের পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ হল এ পেশাটিকে ‘পুরুষের পেশা’ বলে মনে করা। এরই ভিত্তিতে সচেতন ও অসচেতনভাবে নানাবিধ মিথ তৈরি হয়। সে মিথগুলে আবার এমন আবহ তৈরি করে, যার ফলে নারী সাংবাদিকের এ পেশায় স্বচ্ছন্দে প্রবেশ ও সাবলীল বিচরণ কঠিন হয়ে পড়ে।
উপসংহার : উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম কিভাবে লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য নারীর সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার সুযোগকে সীমাবদ্ধ করে। এ সীমাবদ্ধতা থেকে নারীকে বের করে নিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে।

পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*